প্রবাসী কর্মীদের বিদেশযাত্রায় বাড়তি খরচের চাপ

সেবার মান বৃদ্ধি না করে ফি আরোপ যৌক্তিক নয়

কভিড-১৯ ভাইরাসের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের শ্রমবাজার এক ধরনের সংকটের মধ্য দিয়েই যাচ্ছে। স্বাভাবিক সময়ে বিভিন্ন দেশে বছরে প্রায় ১০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ হলেও চলমান মহামারীর কারণে গত কয়েক মাসে কোনো দেশেই নতুন করে বাংলাদেশের কর্মীরা যেতে পারছেন না। বিপরীতে দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন লক্ষাধিক। পুনরায় কর্মস্থলে যোগদানের বিষয় নিয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তায় রয়েছেন তারা। এর সঙ্গে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিদেশগামী প্রত্যেক যাত্রীর জন্যই কভিড-১৯ নেগেটিভ সনদ বাধ্যতামূলক হওয়ার কারণে বাড়তি অতিরিক্ত খরচ যোগ হয়েছে, যা ব্যয়ের সামর্থ্য নেই বেশির ভাগের। অবস্থায় নতুন করে বিমানবন্দরে নিরাপত্তা উন্নয়ন ফি ধার্য করার বিষয়টি বিদেশযাত্রায় প্রবাসী কর্মীদের ওপর বাড়তি চাপেরই নামান্তর। অনেক কর্মীই এসব খরচ মেটাতে অপারগ। কারণে বিদেশে কর্মস্থলে ফেরা নিয়ে প্রবাসী কর্মীদের মধ্যে অনেকেই ভুগছেন বড় ধরনের অনিশ্চয়তায়, যা দেশের জনশক্তি রফতানিকে বাধাগ্রস্ত করবে।

বলা বাহুল্য, যেসব প্রবাসী কর্মী ছুটি নিয়ে দেশে এসেছেন, অর্থাৎ যাদের আকামার মেয়াদ আছে, বর্তমানে তারাই কেবল বিদেশে ফিরতে পারছেন। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে যে দীর্ঘদিন দেশে থাকায় এসব কর্মী এক ধরনের অর্থ সংকটে রয়েছেন। অনেকেই কভিড পরিস্থিতির শুরুর সময় এক রকম বাধ্য হয়ে দেশে এসেছেন। প্রয়োজনীয় অর্থ সঙ্গে নিয়ে আসতে পারেননি। কেউ কেউ হয়তো কয়েক মাসের মজুরি রেখেই দেশে চলে এসেছেন। বিদেশে কর্মরত এসব শ্রমিক কর্মীদের অবস্থা বিবেচনায় যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। চলমান অবস্থায় অতিরিক্ত মূল্যে টিকিট কেটে কর্মস্থলে ফিরতে গিয়ে অনেকেই সমস্যায় পড়ছেন। তার ওপর  সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী বিদেশগামী সব যাত্রীর কভিড-১৯ পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করার কারণে সনদ প্রাপ্তির জন্য ল্যাবে গিয়ে নমুনা দেয়ার ক্ষেত্রে হাজার ৫০০ টাকা এবং বাড়ি থেকে নমুনা সংগ্রহে হাজার ৫০০ টাকা ফি দিতে হচ্ছে। সমস্যা রয়েছে এলাকাভেদে কভিড-১৯ পরীক্ষা কেন্দ্র না থাকার বিষয়টি ঘিরেও। নমুনা দেয়ার সময় পাসপোর্টসহ যাত্রীদের টিকিট পাসপোর্ট উপস্থাপন এবং নির্ধারিত ফি পরিশোধ করতে হচ্ছে, যা একজন বিদেশগামী প্রবাসী কর্মীর জন্য ব্যয় পরিশ্রমসাপেক্ষ। প্রক্রিয়াগত এসব জটিলতার কারণে যেসব প্রবাসী কর্মী সময়মতো কর্মস্থলে পৌঁছতে সমর্থ হবেন না, স্বাভাবিকভাবেই তারা চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে পড়বেন। গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, করোনা পরীক্ষার জন্য প্রবাসীদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। বিপুল অর্থ দিয়েও কাঙিক্ষত সেবা মিলছে না। বিমানবন্দরে সুরক্ষা নিশ্চিত না করেই সুরক্ষা ফি আরোপ করার অভিযোগ আসছে। এর সঙ্গে উড়োজাহাজের টিকিটের বাড়তি ব্যয়ের বিষয় তো রয়েছেই।

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সৌদি আরব আরব আমিরাত। এর পরই রয়েছে কুয়েত, কাতার, বাহরাইনসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশ। মধ্যপ্রাচ্যের এসব দেশ থেকে এরই মধ্যে ফেরত এসেছেন দুই লক্ষাধিক শ্রমিক। বলার অপেক্ষা রাখে না যে করোনার কারণে বাংলাদেশের শ্রমবাজার কঠিন সময় পার করছে। বিদেশে থাকা অনেক শ্রমিক এরই মধ্যে কাজ হারিয়েছেন। তাছাড়া বিদেশ থেকে ফেরত আসা বেশির ভাগ প্রবাসীরই দেশে আয়ের কোনো উৎস নেই। তাই চলমান পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রবাসী কর্মীদের জন্য সহায়তা কেন্দ্র খোলার পাশাপাশি বিনা মূল্যে কভিড টেস্টের বন্দোবস্ত করে বিদেশে তাদের স্ব-স্ব কর্মস্থলে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। দেশে ফিরে আসা যেসব প্রবাসী কর্মীর পুনরায় বিদেশে নিজ কর্মস্থলে ফিরে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে, তারা যাতে সময়মতো সেখানে পৌঁছতে পারেন, তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। আমাদের মনে রাখতে হবে প্রবাসী কর্মীদের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে অনেকেই আর কাজে ফিরতে পারবেন না। তাই কভিড টেস্ট থেকে শুরু করে বিদেশ গমনের হঠাৎ সৃষ্ট প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করতে হবে।

আমরা জানি, জনশক্তি রফতানির ক্ষেত্রে বড় তিনটি শ্রমবাজারের মধ্যে দুটি কার্যত বন্ধ হয়ে আছে কভিড পরিস্থিতির কারণে। নতুন করে বড় কোনো শ্রমবাজারেও আমরা প্রবেশ করতে পারিনি। এদিকে ধারাবাহিকভাবে কমে আসছে বিদেশে কর্মী পাঠানো। নির্দিষ্ট কয়েকটি দেশের ওপর নির্ভরতা থাকায় সংকুচিত হয়ে পড়ছে প্রবাসী শ্রমবাজার। বিশ্বজুড়ে দক্ষ কর্মীর চাহিদা আছে, যা ধরতে পারছে না বাংলাদেশ। বর্তমান পরিস্থিতিও আশাজাগানিয়া কোনো সংবাদ বয়ে আনছে না। অবস্থায় জনশক্তি রফতানি প্রক্রিয়াকে অগ্রসর করতে এবং প্রবাসী কর্মীদের নিজ নিজ কর্মস্থলে ফিরে যাওয়ার প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করা জরুরি। কভিড-১৯ টেস্টের অতিরিক্ত ফি এবং বিমানবন্দরে নিরাপত্তা উন্নয়ন বাবদ অর্থ প্রদানের বিষয়টি বিদেশে কর্মীদের কর্মস্থলে ফিরে যাওয়ার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করবে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, এর কোনোটির সেবার মান সন্তোষজনক নয়। এতে প্রবাসীরা হেনস্তাই হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। কভিড টেস্ট করতে পারছেন না, আবার বিমানবন্দরে পর্যাপ্ত কভিড সুরক্ষাও মিলছে না। অবস্থার অবসান জরুরি। আমরা চাইব, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এক্ষেত্রে সেবার মান বৃদ্ধির উদ্যোগও নেবে। কিন্তু আমরা দেখছি, সেবার মান বৃদ্ধির চেয়ে অর্থ আদায়েই তাদের মনোযোগ বেশি। এতে প্রবাসীদের বিদেশ গমন বিলম্বিত এবং তারা হেনস্তার শিকার হবেন। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর পক্ষ থেকে কার্যকরী ভূমিকা রাখা জরুরি। ভুলে গেলে চলবে না, চলমান পরিস্থিতিতে জনশক্তি রফতানি বাধাগ্রস্ত হলে আমাদের অর্থনীতির ওপর বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন