ইউরোপের ‘সুয়েজ খাল’ চালু হচ্ছে ২০৩০ সালে

বণিক বার্তা ডেস্ক

১০৭ কিলোমিটারের সেইন-নর্ড ইউরোপ ক্যানেল সংশ্লিষ্ট তিন দেশে যোগাযোগ সাশ্রয়ী ও দ্রুত করবে ছবি: এসএনইসি

সময়, চাহিদা ও প্রযুক্তির পরিবর্তনে আন্তর্জাতিক ও আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্য নিয়ে দেশগুলো নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে। এর অন্যতম দিক হলো, বাণিজ্যের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় পুরনো পরিবহন ব্যবস্থা চাহিদা অনুসারে সাড়া দিচ্ছে না। এ পরিপ্রেক্ষিতে রুট ব্যবস্থাপনা ও নতুন প্রযুক্তিকে গুরুত্ব দিতে হচ্ছে, এমনকি পিছিয়ে নেই ভূরাজনীতি ও পরিবেশসংক্রান্ত চ্যালেঞ্জ। এসব জটিলতার মধ্যে ইউরোপের প্রধান অর্থনীতিগুলোয় নতুনভাবে প্রাণ সঞ্চার করতে যাচ্ছে আন্তঃসীমান্ত নদীপথ সেইন-নর্ড ইউরোপ ক্যানেল (এসএনইসি)। এ দশকের শেষ নাগাদ চালু হবে ইউরোপের ‘সুয়েজ খাল’ খ্যাত রুটটি। খবর ইউরো নিউজ।

এসএনইসি বাস্তবায়ন হলে ফ্রান্স, বেলজিয়াম ও নেদারল্যান্ডসের মধ্যে বড় জাহাজ চলাচল সহজ হবে। এ অনুসারে জলপথটি হতে যাচ্ছে ইউরোপীয় প্রধান বাণিজ্য রুট, যা ব্লকের অর্থনৈতিক ভাগ্যকে পাল্টে দেবে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, রুটের কাজ সম্পূর্ণ হতে ২০৩০ সাল লেগে যাবে। ১০৭ কিলোমিটারের বিশাল এ অবকাঠামো প্রকল্প জলপথে যোগাযোগ সাশ্রয়ী ও দ্রুত করবে। এছাড়া তুলনামূলক কম দূষণ ছড়ায় এমন প্রযুক্তি নদী বাণিজ্যের সক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে দেবে।

দেশ তিনটির মধ্যে ক্যানাল ডু নর্ডের মধ্য দিয়ে বাণিজ্য চলমান রয়েছে। তবে ক্রমবর্ধমান চাহিদার তুলনায় সরু খালটির সক্ষমতা সীমিত, যা বাণিজ্যের মসৃণ প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করছে। মূলত সনাতনী ধাঁচের নদী ব্যবস্থাপনা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সুবিধা করতে পারছে না। নতুন প্রজন্মের বড় আকারের কার্গো জাহাজের সঙ্গে মানিয়ে নিতে হিমশিম খাচ্ছে এ রুট।

প্রতিবেদন অনুসারে, বর্তমান নদীপথে দুর্ঘটনার হার কম নয়। এছাড়া সরু পথ ধরে চলাচলে প্রায়ই জট দেখা যায়। এ কারণে ইউরোপীয় সরবরাহ চেইন বিলম্বিত হওয়া একটি সাধারণ ঘটনা। এতে ব্যবসার প্রতিষ্ঠানগুলোর মূল্যবান সময় ও অর্থ ব্যয় হচ্ছে।

এ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা নিয়ে ইউরোপে কথা ওঠে বেশ আগেই। ২০০৩ সালে দেশগুলো নতুন বাণিজ্য রুট ও খাল প্রকল্পে বাস্তবায়নে সবুজ সংকেত দেয়। কিন্তু জরুরি প্রয়োজন সত্ত্বেও রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, তহবিল নিয়ে মতবিরোধ ও খালের চূড়ান্ত রুট নিয়ে বিরোধ প্রকল্পের অগ্রগতি থামিয়ে দেয়। তবে ২০০৯ সাল থেকে সে কাজ এগিয়ে যাচ্ছে, ২০৩০ সাল নাগাদ খুলে দেয়ার আশা করছেন কর্তৃপক্ষ। 

বিশ্লেষকদের মতে, এ সংযোগ হলো ইউরোপের অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ভবিষ্যৎ। নতুন রুটটি বিপুল পরিমাণ পণ্য পরিবহন করতে পারবে। এতে প্রতি বছর ফ্রান্সের সড়ক থেকে ১০ লাখের মতো ভারী পণ্যবাহী যানবাহন সরে আসবে।

এসএনইসি প্রকল্পে ফরাসি সরকার, স্থানীয় কর্তৃপক্ষগুলো ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ৫১০ কোটি ইউরো বিনিয়োগ করেছে। এ উদ্যোগে জলপথে উন্নয়নের পাশাপাশি রয়েছে ৬০টি সেতু, তিনটি ক্যানেল ব্রিজ ও সাতটি ওয়াটার লক। এছাড়া পরিবেশ সুরক্ষায় ৭০০ হেক্টর এলাকায় করা হচ্ছে বন।

প্রকল্পের যুক্ত প্রতিষ্ঠান আর্কাডিস ফ্রান্সের সিইও নিকোলা লদুর মতে, এসএনইসির বহুমাত্রিক গুরুত্ব রয়েছে। তিনি বলেন, ‘সেইন-নর্ড ইউরোপ ক্যানাল শুধু সড়ক থেকে নদীতে একটি পরিবহন ব্যবস্থাকে স্থানান্তর করবে হবে, এমনটা নয়। এর মাধ্যমে অঞ্চলটিতে অর্থনৈতিক, লজিস্টিক, কৃষি ও জলবায়ুর নতুন মান তৈরি হবে।’

নিকোলা লদু জানান, ‘নদীপথে পণ্য পরিবহনের প্রচারে যুক্ত হতে পেরে আমরা খুবই গর্বিত। এটি উচ্চ মাত্রায় কার্যকর ও পরিবেশবান্ধব। পরিবহন অর্থনীতিতে জ্বালানি ব্যবহারে পরিবহন এসেছে, এ প্রকল্প সে চ্যালেঞ্জের একটি সাড়া।’

৫৪ মিটার চওড়া নতুন খালটি সেইন-এসকাট জলপথ ব্যবস্থার অংশ হবে। এটি ইউরোপে প্রথম নদী নেটওয়ার্ক, যা বড় জাহাজ পরিচালনা করতে সক্ষম। এতে পণ্য পরিবহন আরো দক্ষ ও বাণিজ্য রুট উন্নত হবে, যার মাধ্যমে উত্তর ফ্রান্স ও ইউরোপের প্রধান জলপথের সঙ্গে যুক্ত হবে সেইন বেসিন।

আর্কাডিস ফ্রান্সের পরিকল্পনা অনুসারে, প্রকল্পটি শুধু ফরাসি অর্থনীতিকে উৎসাহিত করবে না। বরং নদীপথে যুক্ত অঞ্চলগুলোর স্থানীয় অর্থনীতি সম্প্রসারণে ভূমিকা রাখবে।

জলবায়ু পরিবর্তন বৈশ্বিক অর্থনীতি ও জ্বালানি ব্যবহারকে নতুন রূপ দিয়েছে। এ উদ্দেশ‍্য একাধিক ফোরামে দেশগুলো একসঙ্গে বা আলাদাভাবে কার্বন নিঃসরণ কমানোর লক্ষ্য ঘোষণা করেছে। এ পরিকল্পনায় বিশ্বের অনেক অঞ্চল থেকে এগিয়ে রয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এসএনইসি প্রকল্পও এর আওতার বাইরে নয়। বিশেষ করে সড়ক থেকে ভারী যানবাহন কমে আসায় কার্বন নিঃসরণের মাত্রা কমে আসবে। 

এক হিসাবে দেখা যাচ্ছে, নদীপথে দেড় হাজার টন বহনকারী একটি বার্জ যে পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ করে, তা সড়কে ব্যবহৃত ট্রাকের তুলনায় তিন গুণ কম। এছাড়া ১৮৫ মিটার লম্বা একটি পুশ-টো সামুদ্রিক বন্দরে ৩০০টি কনটেইনার আনলোড করতে পারে। একই পরিমাণ পণ্য পরিবহন সড়কে পাঁচটি সম্পূর্ণ লোড করা ট্রেন ও ২০০টি ট্রাকের সমতুল্য।

সেইন-নর্ড ইউরোপ ক্যানেল সুরক্ষিত এলাকা ও প্রাকৃতিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নতুন সবুজ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে বলে জানানো হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে বন্যপ্রাণী করিডোর, যা প্রাণীদের খালজুড়ে নিরাপদে চলাচল করতে সহায়তা করবে। একই সঙ্গে প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য রক্ষায় বৃক্ষরোপণ ও অন্যান্য ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন