আলী ইমাম মজুমদার ও ‘জনপ্রশাসন’ বিতর্ক

শেখ হাসিনা প্রশাসনের ক্ষমতা ঘনিষ্ঠ চক্রের অনেকে পুনর্বাসিত হচ্ছেন

নিজস্ব প্রতিবেদক

ছবি: গেটি ইমেজেস , পিআইডি

২০০৭-০৮ সালে সেনা সমর্থিত ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় মন্ত্রিপরিষদ সচিবের দায়িত্বে ছিলেন আলী ইমাম মজুমদার। জানা যায়, সেই সরকার পরিচালনায় প্রজাতন্ত্রের জনপ্রশাসন ঢেলে সাজানোর মূল কারিগর ছিলেন তিনি। এ আমলা অবসরে যান ২০০৮ সালে। এরপর ১২ আগস্ট তিনি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারীর দায়িত্ব পান। পরে ১৬ আগস্ট তিনি ব্যক্তিগত সহকারীর পরিবর্তে উপদেষ্টা হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের জনপ্রশাসন ঢেলে সাজানোর কাজে প্রধান উপদেষ্টাকে সহযোগিতা করছেন তিনি। আর এজন্য তিনি কাজে লাগাচ্ছেন তার একজন সাবেক ব্যক্তিগত সহকারীকে।

ওই ব্যক্তিগত সহকারী সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক (প্রশাসন) হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউস ও তোফাজ্জল হোসেন মিয়ার সঙ্গেও তার ঘনিষ্ঠতা রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এর আগে ২০০৭-০৮ সালে আলী ইমাম মজুমদারের ব্যক্তিগত সহকারীর দায়িত্বে ছিলেন তিনি।

প্রশাসনের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মনে করেন, আলী ইমাম মজুমদার ও তার সাবেক ব্যক্তিগত সহকারীর পথনকশায় গুরুত্বপূর্ণ সচিব, জেলা প্রশাসক, এসপি পর্যায়ে যে রদবদল হচ্ছে, তা নিয়ে এরই মধ্যে কিছু বিতর্ক তৈরি হয়েছে, যা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে।

এ সম্পর্কে অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌আলী ইমাম মজুমদার ওয়ান-ইলেভেনের সুবিধাভোগী। তিনি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক আহসান কিবরিয়া সিদ্দিকি কোনো কর্মকর্তাকেই সরাতে চান না। তাদের পরিকল্পনায় ১৯৮২ ব্যাচের ছয়জন কর্মকর্তাকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়। ১৯৮৩, ১৯৮৪, ১৯৮৫, ১৯৮৬ ব্যাচের কাউকে নিয়োগ দেননি। ৮২ ব্যাচের সঙ্গে অন্যান্য ব্যাচের বঞ্চিত কর্মকর্তাদের যোগ না করায় অনেকের মনে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। এ ব্যাচের কর্মকর্তারাই গত সরকারের সময় দেশের প্রশাসন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছে। এবার অন্য অংশ এসে বর্তমান সরকারকেও প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে।’

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর ১১৭ জন ‘‌বঞ্চিত’ সিনিয়র সহকারী সচিব পদ্মোন্নতি পেয়ে উপসচিব হয়েছেন। একইভাবে যুগ্ম সচিব হিসেবে ২০১ জন ও অতিরিক্ত সচিব হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন ১৩১ জন কর্মকর্তা। অভিযোগ উঠেছে, এসব কর্মকর্তার মধ্যে অনেকেই আছেন যারা আওয়ামী লীগ প্রশাসনে নানা সুবিধা নিয়েছেন। অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়েছেন।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর এনবিআর চেয়ারম্যানসহ ১১ জন সচিবের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল হয়েছে। চলতি দায়িত্বে থাকা তিন সচিব ওএসডি হয়েছেন। বর্তমান প্রশাসনে সিনিয়র সচিব, সচিব ও সমমর্যাদার আরো ৬০ জন কর্মকর্তা রয়েছেন, যারা বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নিয়োগ পেয়েছেন। আওয়ামী লীগ প্রশাসনের সুবিধাভোগী এসব কর্মকর্তাকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারেও পুনর্বাসন করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আরো অভিযোগ, সম্প্রতি উপসচিব, যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিব হিসেবে পদোন্নতি পাওয়া ‘‌বঞ্চিত’ কর্মকর্তাদের অনেকেই দুর্নীতিবাজ ও আওয়ামী লীগ প্রশাসনের সুবিধাভোগী। পদোন্নতি দিয়ে তাদেরও পুনর্বাসিত করা হচ্ছে।

এসব বিষয়ে সরকারের আরেক অতিরিক্ত সচিব বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌সম্প্রতি আমাদের বঞ্চিত কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে এক ধরনের বৈষম্য তৈরি করা হচ্ছে। প্রথম বৈষম্য প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে অন্য ক্যাডারের। দ্বিতীয় বৈষম্য হলো বঞ্চিতরা বঞ্চিতই থেকে যাচ্ছেন। আওয়ামী প্রশাসনের সুবিধাভোগীরাই পদোন্নতি পাচ্ছেন। এসব ঘটনা সরকারের প্রশাসন যন্ত্রে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে সমস্যাগুলো মিটিয়ে ফেলতে না পারলে প্রশাসনে অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা বাড়বে।’ 

তিনি বলেন, ‘‌বর্তমানে বিসিএস ১১ ব্যাচের ১৯ জন কর্মকর্তা সচিব হিসেবে কর্মরত। ১৩ ব্যাচে সচিব আছেন ২৬ জন। এ ব্যাচের আরো দুজন বর্তমানে ওএসডি। ১৫ ব্যাচেও দুজন সচিব। অথচ মেধা তালিকায় প্রথম দিকে থাকা এবং প্রয়োজনীয় যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও নবম ও দশম ব্যাচের অনেক কর্মকর্তা বঞ্চিত হয়েছেন। প্রতি ব্যাচেই এমন নজির তৈরি করা হয়েছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘‌বিগত সরকারের সময় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে সরকারের অনেক সচিবকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ১৩ ও ১৫ ব্যাচে এমন অনেককে সচিব করা হয়েছে, যাদের চাকরির বয়স এখনো দুই-তিন বছর আছে। অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব করা হয়েছে দল ও সরকারের প্রতি আনুগত্যের ভিত্তিতে। এ কর্মকর্তাদেরই এখন পুনর্বাসন করা হচ্ছে। প্রকৃত বঞ্চিত কর্মকর্তারা বঞ্চিতই থেকে যাচ্ছেন।’

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সরকার পরিবর্তন হলেও এখনো জনপ্রশাসনে মৌলিক কোনো পরিবর্তন আসেনি বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. সালাউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘জনপ্রশাসনের মৌলিক কোনো পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি না, আগের সরকারে যারা কাজ করেছেন তারা এখনো বহাল আছেন।’

তবে কর্মরত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ না থাকলে কিংবা বিভাগীয় মামলা না থাকলে কোনো ব্যবস্থা নেয়া যায় না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘জনপ্রশাসনে কর্মরত কর্মকর্তাদের নামে বিভাগীয় মামলা না হলে ব্যবস্থা নেয়া যায় না। তবে কেউ তাদের বিরুদ্ধে কোনো আপিল বা অভিযোগ করলে ব্যবস্থা নেয়া হয়। বর্তমানে যারা দায়িত্ব পালন করছেন, তারা কিন্তু নিয়মতান্ত্রিকভাবে দায়িত্ব পেয়েছেন। তবে কাউকে বঞ্চিত করে যদি কাউকে বিশেষ সুবিধা দেয়া হয়, সেক্ষেত্রে যিনি বঞ্চিত হয়েছেন তিনি চাইলে মামলা বা অভিযোগ বা বিচার চাইতে পারে। তখন এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। কিন্তু এখন কোনো পদোন্নতি বা রাষ্ট্রপতি যাকে দায়িত্ব দিয়েছেন তার বিরুদ্ধে বেআইনিভাবে কিছু করা যাবে না। সরকার চাইলে তাদের বিভিন্ন দপ্তরে বদলি করতে পারবে। এক্ষেত্রে এ যুক্তি থাকতে পারে। তবে অভিযোগ না থাকলে অপসারণ করা কঠিন।’

শেখ হাসিনা প্রশাসনের ক্ষমতা ঘনিষ্ঠ চক্রের সুবিধাভোগীদের পুনর্বাসনের অভিযোগের বিস্তারিত উল্লেখ করে এ প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হলে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে বক্তব্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করা হয়। 

দেশের আটটি জেলায় চলমান বন্যায় উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রমে ছাত্র-জনতার ব্যাপক সাড়া মিললেও সেখানে স্থানীয় প্রশাসনকে সক্রিয় করতে পারেননি আলী ইমাম মজুমদার। বিষয়টি গোটা উদ্ধার ও ত্রাণ তৎপরতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে বলে উদ্ধার কার্যক্রমে সংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে অভিযোগ উঠেছে।


এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন