‘সংস্কার করতে হবে জনগণের মতামতের ভিত্তিতে’

ছবি : বণিক বার্তা

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত আছেন স্বাধীনতারও আগে থেকে। প্রায় ছয় দশক ধরে। মাঝে কিছুদিন শিক্ষকতা করলেও রাজনীতিতে পুরোপুরি সক্রিয় হন আশির দশকের মাঝামাঝি। কিছুদিনের মধ্যেই যুক্ত হন বিএনপির রাজনীতিতে। দলটির মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করছেন ২০১১ সাল থেকে। দেড় দশকেরও বেশি সময় ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটির ক্রান্তিকালে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ও আগামী নির্বাচন নিয়ে বিএনপির ভাবনা প্রসঙ্গে কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনিকা মাহজাবিন

অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের এক মাস পূর্ণ হলো। এ নিয়ে আপনার মূল্যায়ন জানতে চাই। 

বাংলাদেশে এর আগেকার অন্তর্বর্তী সরকারগুলোর যে অভিজ্ঞতা, সেগুলো থেকে এখনকারটি একটু ভিন্ন। এখানে ছাত্র-জনতার স্বতঃস্ফূর্ত একটি গণ-অভ্যুত্থানের পর এ সরকার এসেছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস এখানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তিনি প্রায় সবার কাছেই অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য মানুষ। সবাই তাকে পছন্দ করে। তার ওপর মানুষের আস্থা আছে। রাজনীতিতে তিনি সেভাবে সক্রিয় ছিলেন না। কিন্তু অর্থনীতি ও মানুষের জন্য তার যে কর্মকাণ্ড, সেটিই তাকে সমগ্র বিশ্বে এবং এ জায়গাটায় গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে। 

এক মাসের একটি সরকার সম্পর্কে খুব বেশি কিছু বলা কঠিন। কিন্তু এখানে যারা সদস্য হয়েছেন, তাদের মধ্যে কয়েকজন ছাড়া বেশির ভাগই সরকারি কাজে এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় খুব বেশি অভিজ্ঞ নন। কয়েকজন আছেন, যাদের অভিজ্ঞতা আছে। কয়েকজন অর্থনীতিবিদ, আমলা ও এনজিও-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি আছেন, তাদের অভিজ্ঞতা রয়েছে। সুতরাং তাদের কাছ থেকে রাতারাতি সবকিছু পেয়ে যাব, সেটি মনে করার কোনো কারণ নেই।

তবে অতিসম্প্রতি ড. মুহাম্মদ ইউনূস যে বক্তব্য দিয়েছেন সেখানে একটি রূপরেখা দিয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি কী করতে চান, তার দৃষ্টিভঙ্গিটা কী, ভিশন কী—সেগুলো তুলে ধরেছেন। বিশেষ করে সংস্কারের জন্য যে কমিশন তিনি গঠন করেছেন, সেগুলো অত্যন্ত ভালো বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি। যোগ্য মানুষদের তিনি রেখেছেন এবং তা ভালো ফলাফল আনবে বলেই আমার কাছে মনে হয়। তবে যত তাড়াতাড়ি হবে ততই ভালো। যত দ্রুত এটি করা যাবে, তত দ্রুতই সমস্যা সমাধানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। কারণ জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়া কোনো সরকারের পক্ষেই বেশিকিছু টেকসই করা সম্ভব হয় না। সেজন্য আমরা আশা করি যে খুব দ্রুতই এ সংস্কার কাজগুলো শেষ হবে। 

কিন্তু এখানে জনগণের অংশগ্রহণের দরকার আছে। জনগণের মতামতের ভিত্তিতেই সংস্কারগুলো করতে হবে। জনগণের মতামতকে তারা কীভাবে সম্পৃক্ত করবেন, সে প্রক্রিয়া উনারা ঠিক করবেন। তারপর তো পার্লামেন্টে যেতেই হবে। নির্বাচন করতে হবে। সেভাবেই এটিকে রেটিফাই করতে হবে এবং এটিকে সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। 

রাষ্ট্র সংস্কারের একটি পর্যায়ে নির্বাচন হবে বলে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে সময়টি কেমন হবে বলে আপনি মনে করেন? 

আমি এখানে আনুমানিক সময়টা বলতে চাই না এজন্য যে এটি খুব কঠিন একটি কাজ। একটি নির্দিষ্ট সময় বলতে যাওয়াটা হাইপোথিটিক্যাল হবে বলে আমি মনে করি। হাইপোথিটিক্যাল কথা খুব বেশি বলতে চাই না। তবে খুব বেশি সময় নেয়া উচিত না। যৌক্তিক সময় যেটা সেটা নেয়া উচিত এবং নির্বাচন যত দ্রুত হতে পারে সেটা সরকারের জন্যই মঙ্গলজনক এবং জনগণের জন্যও মঙ্গলজনক। 

অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের নিয়ে আপনার মূল্যায়ন জানতে চাই। 

আমি ব্যক্তিগতভাবে কোনো উপদেষ্টা সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতে চাই না। তাদের কাজের মধ্য দিয়ে সব বিষয় আসবে বলে আমি মনে করি। যেটি আমি বলেছি, তাদের বেশির ভাগেরই সরকারের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা নেই বললেই চলে। সেক্ষেত্রে তাদের কাছ থেকে রাতারাতি সবকিছুই সুন্দর পাওয়া যাবে তা আশা করি না। তবে তারা তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন। অনেকেই ভালো করছেন। বেশ ভালো করছেন। আমি আশাবাদী। 

অন্তর্বর্তী সরকারে এবার রাজনীতিবিদদের নেয়া হয়নি। সরকার গঠনের সময় এ বিষয়ে আপনাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল কী? 

যখন অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত হয় সেটি আমাদের উপস্থিতিতেই হয়েছে। সব রাজনৈতিক দল প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর প্রধানদের সঙ্গে সবাই আমরা বঙ্গভবনে গিয়েছি। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে কথা বলেছি। সেখানেই সিদ্ধান্ত হয়েছে যে এটি একটি অন্তর্বর্তী সরকার হবে। সেই অন্তর্বর্তী সরকারের চরিত্র কেমন হবে তা তো আমাদের সবার জানার কথা। বাংলাদেশের সবাই চাই যে নির্বাচনের আগে এখানে একটি দলনিরপেক্ষ সরকার থাকা দরকার, যেটাকে আমরা বলি ননপার্টিজান। এখানে দলীয় কিছু নেই বলে খুব একটা অসুবিধা হওয়ার কথা, তা কিন্তু নয়। তারা যদি কিছুদিন পর পর দলগুলোর সঙ্গে কথা বলেন তাহলে এ অভাবটি পূরণ করা সম্ভব হবে।

অন্তর্বর্তী সরকার গত এক মাসে আপনাদের সঙ্গে কথা বলেছে? 

হ্যাঁ। এরই মধ্যে তারা আমাদের সঙ্গে দুইবার কথা বলেছে। আলাপ হয়েছে। আমরা আমাদের কথাগুলো তাদের কাছে বলে এসেছি। 

সাম্প্রতিক সময়ের বন্যায় সরকারের ভূমিকা নিয়ে জানতে চাই।

এবারের বন্যায় সেনাবাহিনী বড় ভূমিকা পালন করেছে। আর বেসরকারি সংস্থা ও রাজনৈতিক দলগুলো ভূমিকা রেখেছে। সরকারও তার যেটুকু দায়িত্ব, তা পালন করেছে। হয়তো আরো বেশি করতে পারত। এটি তো দায়িত্বে থাকা আমলাদের ওপর নির্ভর করে। তারা সবটা হয়তো করতে পারেনি। চেষ্টা করেছে। সে অভাব পূরণ করে দিয়েছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। সেনাবাহিনীও যথেষ্ট কাজ করেছে। 

জনপ্রশাসনে ডিসি নিয়োগ নিয়ে ঝামেলা চলছে। এছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নানাবিধ কারণে সঠিকভাবে পরিচালনা করা যাচ্ছে না। অন্তবর্তী সরকার কি প্রাতিষ্ঠানিক এ সংকট থেকে উত্তরণ ঘটাতে সক্ষম?

গত ১৫ বছর এদেশের মানুষ কথা বলতে পারেনি। অভাব-অভিযোগের কথা বলতে পারেনি। বিচার পায়নি। সে জায়গায় স্বাভাবিকভাবে যখন এমন একটি মুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, সব মানুষই তাদের কথাগুলো বলতে চায়; তাদের অভিযোগগুলো আনতে চায়। এটি অস্বাভাবিক না। তবে আমি মনে করি যৌক্তিক আচরণ হচ্ছে যে এখন কিছুদিন এ সরকারকে সময় দেয়া। সরকার কাজ করছে। কাজ করতে দিতে হবে। পরামর্শগুলো দিতে হবে এবং এমন কিছু করা উচিত হবে না যাতে এ সরকার একটি বিরূপ ও প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়ে। 

এ সরকার কী বিশৃঙ্খলা সামাল দিতে সক্ষম বলে আপনি মনে করেন?

চেষ্টা করছে। একেবারে মুহূর্তের মধ্যে সব হয়ে যাবে না, সেটি আমি বিশ্বাস করি। যেহেতু একটা ফ্যাসিবাদী সরকার ছিল, একেবারে পুরো দলবাজ একটি সরকার ছিল। সেখানে বিভিন্ন জায়গায় বেশির ভাগই ছিল দলীয় লোক। রাতারাতি তো এ লোকগুলোকে সরিয়ে দেয়া সম্ভব হবে না। তাদের তো কাজ করতে দিতে হবে। তবে অভিজ্ঞতা বেশি থাকলে হয়তো আরো ভালো করতে পারত। অথবা অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও হয়তো আরো ভালো করত। এ যোগাযোগের জায়গাটায় অভাব আছে বলে আমার কাছে মনে হয়। এখানে যারা পুরনো লোক আছেন, অভিজ্ঞ লোক আছেন তাদের সঙ্গে ঘন ঘন কথা বললে বা যারা সরকার চালিয়ে অভিজ্ঞ, তাদের সঙ্গে কথা বলে সমস্যা সমাধান করা সম্ভব হয়। 

দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনো নিয়ন্ত্রণ না হওয়াকে আপনি কীভাবে দেখেন? 

বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপ না। এজন্য একটি বিষয় লক্ষ্য করে দেখতে হবে যে শিল্পনগরী ছাড়া কোথাও কোনো মেজর সমস্যা কিন্তু নেই। প্রথম কয়েকদিন পুলিশ ছিল না এবং এখনো নেই। যেখানে ছাত্ররা রাস্তাঘাট সামলেছে। সাধারণ মানুষ সহযোগিতা করেছে। তারা পাড়ায় পাড়ায় পাহারা দিয়েছে যাতে কোনো চুরি-ডাকাতি না হয়, এটা আমি নিজের চোখে দেখেছি।

আমাদের দলের লোকেরাও নেমেছে। তারাও পাহারা দিয়েছে। অর্থাৎ এখানে কিন্তু সব রাজনৈতিক দল সহযোগিতা করেছে এজন্য যে তারা আশা করে যে এত বড় একটা ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর, ফ্যাসিবাদের পতনের পর এখানে সুবাতাস বইছে। গণতন্ত্রের সুবাতাস এখানে বইবে, সে প্রত্যাশা সবার মধ্যে আছে। 

এ সরকার সঠিকভাবে প্রশাসন পরিচালনা করতে ব্যর্থ হলে বিএনপি কী ধরনের পদক্ষেপ নেবে?  

এ সরকার সম্পর্কে এ ধরনের কথা বলার সময় এখনো আসেনি। এখনই এ ধরনের আনুমানিক প্রশ্নে যেতে চাই না। সম্ভব হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। আমরা আশা করি যে তারা সম্ভব করতে সক্ষম হবে। আমরা প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করব। এ প্রশ্নের উত্তর আমি এখন দেব না। 

২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

আমরা যারা রাজনীতি করি, তারা বাংলাদেশকে ভালো করে চিনি। বাংলাদেশের ইতিহাসই বলছে, এখানকার মানুষ একটা সময়ে তাদের প্রয়োজনে বিদ্রোহ করেছে। এখানে আমরা সবসময়ই আশাবাদী ছিলাম। যার জন্য এক সময় আমরা রাস্তায় আন্দোলন করেছি। এ ছাত্র গণ-অভ্যুত্থান তো একদিনে হয়নি। গত ১৫-১৬ বছরে বহু ত্যাগ স্বীকারের বিনিময়ে আমরা আজকের এ জায়গায় আসছি এবং দল হিসেবে আমরা সবচেয়ে বেশি ত্যাগ স্বীকার করেছি। আমরা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছি। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। আমরা আন্দোলন করেছি। আমাদের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ছয় বছর জেলে বন্দি ছিলেন। এখনো অসুস্থ। আমাদের ৬০০-এর বেশি মানুষকে গুম করা হয়েছে। হাজার হাজার লোককে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। শেখ হাসিনা সরকার ৬০ লাখ মানুষের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়েছে। গায়েবি ও মিথ্যা মামলা। সুতরাং এ আন্দোলন তো আমরা প্রথম থেকেই করে আসছিলাম। আন্দোলনের জন্য কিছুদিন আগেও আমি জেলে গিয়েছি।

যখন এ আন্দোলন শুরু হলো, তখনো আমাদের ২৭ হাজার নেতাকর্মীকে জেলে নিয়েছে। নেতৃত্বস্থানীয় নেতা থেকে শুরু করে সবাইকে। ওই কয়েকদিনেই ১৭০০ মামলা হয়েছে। সব আমাদের দলের বিরুদ্ধে হয়েছে। আমাদের দলের নেতারা জেলে গেছেন, নিগৃহীত হয়েছেন, নির্যাতিত হয়েছেন। কারাগারের মধ্যে সাতদিন-আটদিন কাপড় বদল করতে পারেননি। ওই সময়ও আমাদের দলের কিছু নেতাকর্মীকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। আমাদের হিসাবে এ সংখ্যা প্রায় দুশোর মতো। সুতরাং গণ-অভ্যুত্থানের পরিস্থিতি আমরাই সৃষ্টি করেছি। গত ১৫ বছর ধরে আমরা লড়াই করছি। এটা একদিনে হয়নি। 

বিএনপি আওয়ামী লীগের মতো একই ধারায় রাজনীতি করবে বলে কিছু মানুষ আশঙ্কা প্রকাশ করছে। বিএনপি কি আওয়ামী লীগ থেকে আলাদা হতে পারবে?

আমি এটির সঙ্গে পুরোপুরি দ্বিমত পোষণ করি এবং প্রতিবাদ জানাই। বিএনপি সবসময়ই আওয়ামী লীগ থেকে ভিন্ন। আওয়ামী লীগ যত খারাপ কাজ করেছে বিএনপি সেগুলোকে ভালোর দিকে নিয়ে এসেছে। আওয়ামী লীগ ১৯৭৫ সালে একদলীয় শাসনব্যবস্থা বাস্তবায়নের জন্য বাকশাল করেছে। বিএনপি সেটিকে বহুদলীয় ব্যবস্থায় নিয়ে এসেছে। আমরা সংসদীয় গণতন্ত্র নিয়ে এসেছি। আমরা সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে সংযোজন করেছি। সুতরাং বিএনপিকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে তুলনা করা একেবারেই সঠিক নয়। এটি ইনজাস্টিস। 

আওয়ামী লীগ আর বিএনপি এক হতে পারে না। আওয়ামী লীগ একটি ফ্যাসিবাদী দল। বিএনপি একটি গণতান্ত্রিক দল। গণতন্ত্রের জন্য বিএনপি সবচেয়ে বেশি ত্যাগ স্বীকার করেছে। আমি জোর গলায় বলতে পারি যে খালেদা জিয়ার মতো এত ত্যাগ স্বীকার কোনো রাজনৈতিক দলের কোনো নেতা করেনি। আমাদের বিএনপির নেতাদের মতো এত ত্যাগ স্বীকার কোনো রাজনৈতিক দলের নেতারা করেনি। কেউ কল্পনা করতে পারবে একটি গণতান্ত্রিক দলের ৬০ লাখ মানুষের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা? আমাদের কতবার জেলে যেতে হয়? আমাদেরকে কতবার পুলিশ কী রকম সাংঘাতিকভাবে অত্যাচার-নির্যাতন করেছে! এগুলো সবাই ভুলে যাচ্ছে? কোনো জিনিস রাতারাতি হয়ে যায় নাকি? এই ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পেছনে আমাদের বিগত ১৬ বছরের ত্যাগ রয়েছে। বিএনপির ত্যাগ রয়েছে। বিএনপির নেতাকর্মীদের ত্যাগ রয়েছে। আজকে ঢাকা শহরের এ রিকশাওয়ালা থেকে শুরু করে হকার, বাইক রাইডার বেশির ভাগই বিএনপির। তারা নিজ এলাকায় থাকতে না পেরে ঢাকায় চলে এসেছে। এগুলো বাস্তবতা।

আওয়ামী লীগের বর্তমান অবস্থাকে আপনি কীভাবে দেখেন?

আওয়ামী লীগ একটি পুরনো রাজনৈতিক দল। এখন আওয়ামী লীগের রাজনীতি নেই। এটি এখন রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া একটি দল। সংগঠনের দিক থেকে সে আবার ফিরে আসতে পারবে কি পারবে না তা নির্ভর করবে তার ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনার ওপর।

বাংলাদেশের গত ১৫ বছরের রাজনীতিতে ভারতের প্রভাব দেখেছি। বিশেষ করে ভোটারবিহীন নির্বাচনগুলোয় তারা শেখ হাসিনা সরকারকে সব ধরনের সমর্থন দিয়ে গেছে। চলমান রাজনীতিতে ভারতের প্রভাব কেমন রয়েছে বলে আপনি মনে করেন?    

ভারত তো আমাদের রাজনীতিতে প্রভাব ফেলার চেষ্টা সবসময়ই করেছে। এখনো যে করছে না তা না। এখনো নিশ্চয়ই করছে। আগেও ভারতের প্রত্যক্ষ প্রভাব ছিল। যদিও এখন আমরা দৃশ্যমান কিছু দেখি না। কিন্তু শেখ হাসিনাকে সেখানে আশ্রয় দেয়ায় মনে হয় বাংলাদেশের মানুষের রাজনৈতিক যে আকাঙ্ক্ষা সেটি তারা ঠিক সেভাবে বুঝতে পারছে না। 

শেখ হাসিনা সরকার যেমন বলেছিল—ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ সম্পর্ক অন্য একটি মাত্রায় নিয়ে গেছে সেটিই কী ভারত রক্ষা করার চেষ্টা করছে?

নিশ্চয়ই। তারা তো তা করবেই। প্রত্যেক রাষ্ট্র তার নিজের স্বার্থে কাজ করবে। আমাকে আমার কাজ করতে হবে। বাংলাদেশ বাংলাদেশের স্বার্থে কাজ করবে। এখন সেটিই করবে আশা করি। 

জামায়াতের সঙ্গে আপনাদের সম্পর্ক নিয়ে জানতে চাই।

প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যেমন সম্পর্ক হওয়া উচিত তেমনই। জামায়াত একটি আলাদা রাজনৈতিক দল, আমরাও আলাদা রাজনৈতিক দল। জামায়াতের উদ্দেশ্য-আদর্শ এক রকম, আমাদের অন্য রকম। আমরা মুক্তিযুদ্ধের দল। আমাদের প্রতিষ্ঠাতা স্বাধীনতার ঘোষক। আমাদের একটি আলাদা অবস্থান অবশ্যই আছে। আমরা পুরোপুরি একটি উদার গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। আর তারা ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় বিশ্বাস করে। এখানে তো ভিন্ন ব্যাপার আছেই। 

জামায়াতের প্রভাব বৃদ্ধির ফলে বিএনপির ভোট ব্যাংকে প্রভাব পড়বে কি?

জামায়াতের প্রভাব বাড়ছে কেন বলছেন আপনারা? এটি কিসের ভিত্তিতে বলছেন? তারা বেশি কথা বলছে সেজন্য? তাদের ছবি বেশি করে ছাপা হচ্ছে সেজন্য? এটা একটি প্রোপাগান্ডা মিডিয়াতে দেখতে পাচ্ছি।

মিডিয়াতে আসতেই পারে, যেহেতু মুক্ত গণতন্ত্র আছে। তাদের চেয়ে অনেক বেশি প্রভাব আমাদের আছে। সুতরাং আমাদের ভোটে প্রভাব ফেলা অর্থাৎ ভোট কমার কোনো সম্ভাবনাই নেই। বরং ভোট আরো বাড়বে। বিএনপি একমাত্র রাজনৈতিক দল যাদের ওপর জনগণের আস্থা আছে। 

বিএনপি যখনই ক্ষমতায় এসেছে তখনই জনগণের কল্যাণে কাজ করেছে। মুক্তবাজার অর্থনীতির জন্য কাজ করেছে। গণতন্ত্রের জন্য কাজ করেছে। অসাম্প্রদায়িক পরিবেশ তৈরিতে কাজ করেছে। আজকে বাংলাদেশের অর্থনীতির যেটুকু ভিত্তি সেটি বিএনপির জন্য। তৈরি পোশাক খাত, রেমিট্যান্স বা মুক্তবাজার অর্থনীতির সূচনা বিএনপির হাতে। সুতরাং বিএনপির ওপর জনগণের আস্থা অনেক বেশি। আজকে যারা বলতে চায় জামায়াতে ইসলামীর প্রভাব বাড়ছে বা অন্য দলের প্রভাব বাড়ছে, তাদের সঙ্গে আমি কোনোভাবেই একমত নই। 

বিএনপির ৩১ দফার একটি হলো জাতীয় সরকার গঠন করা। এ সরকার নিয়ে জানতে চাই। 

এখানে বলেছি যে নির্বাচন হবে। এ নির্বাচনে যারা জয়ী হয়ে আসবে, সে দলগুলোর মধ্যে আমরা একটি জাতীয় সরকার গঠন করার কথা ভাবব আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে। সেখানে ৩১ দফা বাস্তবায়নের জন্য আমরা কাজ করব। 

শেখ হাসিনা সরকারের সময়ে হওয়া বিদ্যুৎ চুক্তিগুলো সরকার কীভাবে দেখবে?

বিদ্যুৎ চুক্তিগুলো রিভিউ করা উচিত বলে আমি মনে করি। চুক্তিগুলো জনগণের সামনে তুলে ধরা উচিত। কুইক রেন্টাল চুক্তিগুলোয় অনেক দুর্নীতি হয়েছে। সেগুলোয় জনগণের বিরাট টাকা চলে যায় বিদ্যুতের পেছনে কিন্তু সে ফল দেশ ও জনগণ পাচ্ছে না। অবশ্যই রিভিউ করে সেগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া দরকার। 

মূল্যস্ফীতি কমেছে বলছে অন্তর্বর্তী সরকার। কিন্তু খাদ্যপণ্যের দাম কমেনি। এ বৈসাদৃশ্যের কারণ কী? 

মুহূর্তের মধ্যে তো হবে না। আমাদের ব্যবসায়ীদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, রাজনৈতিক পরিবেশ, বিভিন্ন ক্ষেত্র মাথায় রাখতে হবে। রাতারাতি তো পরিবর্তন হয় না। সুশাসন লাগে। একটু সময় লাগবে। চর্চা করতে হবে। 

অর্থ উপদেষ্টা এবং গভর্নর এখন যে পদক্ষেপ নিচ্ছেন, সেগুলো নিয়ে আমি খুব আশাবাদী। পদক্ষেপগুলো নিঃসন্দেহে দেশকে ভঙ্গুর অবস্থা থেকে ভালো জায়গায় নিয়ে আসবে। মূল্যস্ফীতি কমে আসবে বলে আমি বিশ্বাস করি। 

পশ্চিমা রাষ্ট্রের সঙ্গে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ভালো সম্পর্ক রয়েছে। এখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে পশ্চিমাদের প্রভাব বেশি বলে কি আপনি মনে করেন?

কোনো নির্দিষ্ট দেশ বা শক্তির প্রভাবের কথা আমি বলছি না। এখানে বাংলাদেশের মানুষের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশের মানুষ যে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র চায়, সেটির প্রভাবই এখানে বেশি পড়েছে। এখানে পশ্চিমা বিশ্ব আমাদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে সমর্থন করেছে। এটিকে ও সমর্থন করেছে যেহেতু জনগণের অভ্যুত্থান ছিল। সুতরাং আমি মনে করি শুধু পশ্চিমা বিশ্ব নয়, সমস্ত বিশ্বই এটিকে সমর্থন করবে।

আয়নাঘর নিয়ে জানতে চাই।

ফ্যাসিবাদী সরকারের চরম নির্যাতনের একটি প্রতীক হলো এ আয়নাঘর। আমাদের এমপি ইলিয়াস আলীকে দিয়ে এটির শুরু। টিপাইমুখ বাঁধের মুখে আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন সিলেটের ইলিয়াস আলী। তাকে গুম করে শুরু। এরপর চৌধুরী আলম, পারভেজকে গুম করা হলো। এরপর ২০১৩-১৪ সালে আমাদের আন্দোলনে ছাত্রনেতাদের গুম করেছে। প্রায় কমপক্ষে ৭০০ জনকে গুম করেছে।

সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা, সাধারণ ব্যক্তি কিংবা সরকারি কর্মকর্তা যারাই প্রতিবাদ করেছে তাদেরকে সেখানে নিয়ে গেছে; নির্যাতন করেছে। যেটি ফ্যাসিবাদী চরিত্র। নাৎসী বাহিনীদের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পেরই প্রতিফলন। তবে যেহেতু নতুন সরকার এসেছে এরপর থেকে এগুলোর আর পুনরাবৃত্তি হবে না।

কেউ কেউ আয়নাঘরকে হাওয়া ভবনের সঙ্গে তুলনা করছে। 

এটি চূড়ান্তভাবে একটি ভ্রান্ত ধারণা। এটি অন্যায়, পক্ষপাতদুষ্ট ও উদ্দেশ্যমূলক। হাওয়া ভবন ছিল একজন বা একাধিকজনের অফিস। পরবর্তী সময়ে এটি বিরোধী দলের অফিস ছিল। এখানে নির্যাতনের খবর কেউ কোনো দিন করতে পেরেছে? এখানে আটকে রাখার খবর কেউ কোনোদিন করতে পেরেছে? এ ধরনের কথা বলে তারা বিএনপিকে হেয়প্রতিপন্ন করতে চায়। তারা এ আয়নাঘরকে ছোট করে দেখাতে চায় যেখানে আয়নাঘর শুধু বৃহৎ নয়, ভয়াবহ। 

ছাত্র রাজনীতি নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে। এক্ষেত্রে বিএনপি কী ভাবছে?

ছাত্র রাজনীতি আইনগতভাবে আমাদের মূল রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত না। এখন ছাত্রদল আমাদের সহযোগী বা ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন। এখন তারা তাদের মতো করে রাজনীতি ঠিক করবে। 

গত ১৫ বছরে কোনো ছাত্র রাজনীতিই ছিল না। এ গণ-অভ্যুত্থানের আগ পর্যন্ত অবস্থাটি এমনই ছিল। ছাত্রদের রাজনীতি থেকে সরিয়ে দিয়েছিল। এ কথা আমি বহুবার বলেছি। সেক্ষেত্রে আমি খুব আশাবাদী যে এ ছাত্ররা রাজনীতিতে এসেছে, রাজনীতির কথা বলছে। দেশ সম্পর্কে তারা সচেতন হয়েছে। দেশ সম্পর্কে তারা কথা বলছে। যেহেতু আজকালকার ছেলেরা অনেক বুদ্ধিদীপ্ত, তারাই এটি ঠিক করবে। তবে অবশ্যই এটি দেশের স্বার্থে হতে হবে; কোনো ব্যক্তির স্বার্থে নয়। 

ছাত্র রাজনীতি বরাবরই দিকনির্দেশনা দিয়েছে। এবারের ছাত্র রাজনীতিতে যারা অংশগ্রহণ করেছে, তারা কোনো দলীয় রাজনীতি করেনি। তারা যে কাজটুকু করেছে, সেটি দেশের পক্ষে এসেছে। এভাবেই তারা দেশের পক্ষে থাকবে। তবে ছাত্র রাজনীতিকে বন্ধ করে দেয়ার পক্ষে আমি নই। ছাত্র রাজনীতি অবশ্যই থাকা উচিত। এর মধ্য দিয়েই নেতৃত্ব বেরিয়ে আসে, সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা বাড়ে বলে আমি মনে করি। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন