জ্বালানি তেল

সরকারকে জনগণের জন্য স্বস্তিদায়ক পদক্ষেপ নিতে হবে

ছবি : বণিক বার্তা

বিশ্ববাজারে বর্তমানে জ্বালানি তেলের দাম নিম্নমুখী। কিন্তু বাংলাদেশের বাজারে পণ্যটির দাম কমছে না। জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ে মধ্যম ও নিম্ন আয়ের মানুষ। কেননা জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি পরিবহন ব্যয় ও উৎপাদন ব্যয় বাড়িয়ে দেয়। ফলে মূল্যস্ফীতি খুব বেশি মাত্রায় প্রভাবিত করে এটি। দেশে গত দুই বছরেরও অধিক সময় উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিদ্যমান। অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত হবে জ্বালানি তেলের দাম বিশ্ববাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে সুলভে প্রাপ্তির বিষয় নিশ্চিত করা। এর মাধ্যমে জনমনে স্বস্তি ফিরে আসবে।  

চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের ব্যারেলপ্রতি গড় মূল্য প্রাক্কলন করেছিল প্রায় ১২১ ডলার ৯১ সেন্ট। বিশ্ববাজারে পণ্যটির প্রধান দুই বাজার আদর্শ ব্রেন্ট ও ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট (ডব্লিউটিআই)। সেখানে বর্তমানে কেনাবেচা হচ্ছে যথাক্রমে ৮১ ডলার ১৯ সেন্ট ও ৭৭ ডলার ১৫ সেন্টে। আর পরিশোধিত জ্বালানি তেলের (গ্যাস অয়েল) ব্যারেলপ্রতি দাম এখন ১১৬ ডলার। সামনে জ্বালানি তেলের দাম আরো কমার পূর্বাভাস রয়েছে। বিশ্ববাজারে নিম্নমুখী থাকলেও দেশের বাজারে এখনো দাম কমানো হয়নি জ্বালানি তেলের। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে ভোক্তার কাছে সাশ্রয়ী মূল্যে জ্বালানি তেল সরবরাহের পরিবর্তে মুনাফা অর্জনে বেশি মনোযোগ বিপিসির। 

জ্বালানি তেল আমদানিতে প্রতি অর্থবছর বিপুল পরিমাণ লোকসানের কথা বিপিসির বাজেটে উল্লেখ করা হয়। এসব হিসাবের ভেতর বিভিন্ন খরচ অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পরে জ্বালানি তেলের দামের সঙ্গে যোগ করা হলে তা ভোক্তার ওপর গিয়ে পড়ে। যদিও প্রতিষ্ঠানটির এ প্রাক্কলনের সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। কেননা জ্বালানি তেল বিক্রি করে ২০১৪-১৫ অর্থবছরের পর থেকে মুনাফার ধারায় রয়েছে বিপিসি। ওই সময় থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত ৪৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বেশি মুনাফা করেছে সংস্থাটি। এর মধ্যে কেবল ২০২১-২২ অর্থবছরে ২ হাজার ৭০৬ কোটি টাকা লোকসান হয়েছিল।  আর বিগত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিপিসির লোকসানের প্রাক্কলন ছিল ১০ হাজার কোটি টাকার ওপরে। অথচ ওই অর্থবছরেও ৩ হাজার ৮৪১ কোটি টাকা মুনাফা করেছে বিপিসি। 

বিপিসি একটি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান। সরকারকে ট্যাক্স-ভ্যাট পরিশোধ করার পর বিপিসির পরিচালন ব্যয় নির্বাহ ছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে মুনাফাভোগী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়া উচিত নয়। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে তাকে জনকল্যাণের বিষয়টি অগ্রাধিকার দেয়াই কাম্য। বিপিসির মুনাফালোভের কারণে দেশের বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমানো যাচ্ছে না। জ্বালানি বিভাগ তেলের দাম নির্ধারণে যে প্রক্রিয়ায় স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি চালু করেছে, সেটিও এখন বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) গণশুনানির মধ্য দিয়ে পরীক্ষা করা দরকার। যেহেতু বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম এখন নিম্নমুখী, এ অবস্থায় বিপিসি যদি মুনাফার মার্জিন কমায়, তাহলে দেশের বাজারে সাশ্রয়ী দামে জ্বালানি তেল পাবেন ভোক্তারা। বিপিসিকে এখন মুনাফাভোগী চরিত্র থেকে বের করে আনতে পারলেই বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমার সুফল দেশের জনগণ ভোগ করতে পারবে। যেহেতু দেশের জ্বালানি তেল আমদানি ও বিপণন বিপিসির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়, সেহেতু তাকে শুধু মুনাফার কথা চিন্তা করলে হবে না; তাকে সর্বোচ্চ জনকল্যাণের বিষয়টিও চিন্তা করতে হবে। দেশে যে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে, সেটি নিয়ন্ত্রণে আনতে জ্বালানি তেলের দাম কমানোর বিকল্প নেই। 

জ্বালানি তেল হলো একটি কৌশলগত আবশ্যিক পণ্য। জ্বালানি তেল ব্যতীত এখনো কোনো উন্নয়নকাজ সমাধানের কথা চিন্তা করা যায় না। বিশ্ববাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে দেশের বাজারে জ্বালানির দাম নির্ধারণে নতুন কোনো ফর্মুলার প্রয়োজনও নেই, শুধু সদিচ্ছা প্রয়োজন। আমদানি করা জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণে বিশ্বে প্রধানত তিনটি পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। অধিকাংশ দেশ মার্কেট ডিটারমাইন্ড বা বাজারদরের সঙ্গে সমন্বয় পদ্ধতি অনুসরণ করে। আবার কোনো কোনো দেশ সর্বোচ্চ দর বা প্রাইস সিলিং পদ্ধতি অনুসরণ করে। বাংলাদেশের মতো কিছু দেশ ফিক্সড প্রাইস বা নির্ধারিত দরে জ্বালানি তেল বিক্রি করে। প্রতিবেশী দেশ ভারতে বহুদিন ধরেই ডায়নামিক ডেইলি প্রাইসিং মেথড অবলম্বন করা হচ্ছে। সেখানে প্রতিদিন ব্রেন্ট ক্রুড অয়েল বা অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম বিবেচনায় দেশের বাজারে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করা হয়। বিশ্বের যেসব জায়গা থেকে তেল আমদানি করা হয়, তার সঙ্গে সরকারি কর ও মুনাফা যোগ করে প্রতিদিন তেলের দাম নির্ধারণ করে দেয়া হয় ভারতে। প্রতিদিন সরকারের জ্বালানি মন্ত্রণালয় ঠিক করে দেয়, কত দামে ডিজেল-পেট্রল বিক্রি হবে। অনেক কিছু বিকেন্দ্রীকরণ করা হলেও এখানে ভারত সরকারের কড়া নিয়ন্ত্রণ আছে। আবার যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ঘণ্টায় তেলের দাম নির্ধারণ করা হয়। যুক্তরাজ্যে প্রতিদিনই জ্বালানি তেলের দাম ওঠানামা করে। কিন্তু সেখানে সরকারি কোনো সংস্থা সেটা নির্ধারণ করে না। ক্রুড অয়েলের দাম, সরকারি কর, ভ্যাট ইত্যাদির সঙ্গে নিজেদের মুনাফা মিলিয়ে পাম্প মালিকরাই প্রতিদিন সেটা ঠিক করেন। ফলে একই দিন একেক এলাকায় তেলের দাম একেক রকমও হতে পারে। ভারতেও এলাকাভেদে তেলের দাম ভিন্ন হয়। বাংলাদেশের সব জায়গায় একই দামে তেল বিক্রি হয়। দাম নির্ধারণেও বাংলাদেশে কোনো স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নেই। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে (বিইআরসি) এড়িয়ে বিগত সরকার নির্বাহী আদেশে জ্বালানির দাম নির্ধারণ করে। এতে বিপিসি অতিমুনাফা ও চুরি-দুর্নীতি করলেও তা রোধে কোনো ব্যবস্থাই নেয়া হয় না। এর চড়া মূল্য দিতে হচ্ছে দেশের সাধারণ জনগণকে। 

বাংলাদেশে তেলের দামের সঙ্গে অনেক কিছুর সম্পর্ক আছে। বোরো চাষ শতভাগ সেচনির্ভর, যাতে ডিজেল ব্যবহার হয়। তেলের দামের সঙ্গে মূল্যস্ফীতির বিরাট সম্পর্ক আছে। এরই মধ্যে নিত্যপণ্যের দাম আকাশ ছুঁয়েছে। মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ও খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ ভয়াবহ চাপে আছে। এ অবস্থায় সরকার যদি আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় না করে তাহলে মানুষের দুর্ভোগ আরো বাড়বে। আমরা আশা করব, সবদিক বিবেচনা করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবার তেলের দাম কমাবে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় কৃষি, শিল্পসহ পরিবহন খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতির হারও বেড়েছে। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দামও বেশি। এ মুহূর্তে উদ্যোক্তাদের কিছুটা স্বস্তি দিতে পারে জ্বালানি তেলের মূল্যহ্রাস। এক্ষেত্রে অনেকে বলেন, জ্বালানির দাম কমালেও জনগণ তার সুফল পাবে না। কারণ ব্যবসায়ীরা দাম কমাবেন না। এটি কোনো যৌক্তিক কারণ হতে পারে না। জ্বালানি তেলের দাম কমানোর সুফল ব্যক্তির কাছে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব সরকারের। জ্বালানির দাম বাড়ানোর সময় সরকার এক সপ্তাহের মধ্যে পরিবহনের মূল্য নির্ধারণ করে দিতে পারলে কমানোর সুফল নিশ্চিত করা সম্ভব। সরকারের সদিচ্ছাই এক্ষেত্রে যথেষ্ট।

বিগত সরকার একক আমদানিকারক হিসেবে জ্বালানির মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি পণ্য নিয়ে উচ্চ মুনাফাভিত্তিক ব্যবসা পরিচালনা করছে। কোনো বেসরকারি কোম্পানি এটি করলে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও সরকার তাকে জেল-জরিমানার আওতায় নিয়ে আসত। বিপিসির বেলায় কোনো পদক্ষেপ কেন নেয়া হচ্ছে না—তা একটি প্রশ্ন বটে। বাংলাদেশে বিপিসি জ্বালানি পণ্যের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ করে। তারা ব্যবসা করে বিধায় রেগুলেটরের আওতায় জ্বালানির দাম নির্ধারণ করা উচিত। সরকারের জ্বালানি তেলের আন্তর্জাতিক দামের সঙ্গে দেশীয় দামের সমন্বয় করা উচিত। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন