এসএমই নীতিমালা পরিকল্পনা ও সুপারিশেই আটকা

ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে সরকারকে

ছবি : বণিক বার্তা

যেকোনো দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) খাত। বিশেষ করে কর্মসংস্থান তৈরিতে এ খাতের উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, খাতটি বিশ্বজুড়ে ৫০ শতাংশ মানুষের কর্মের জোগান দেয়। আবার প্রতিটি দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের সিংহভাগ অংশীদার অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা। বিশ্বের প্রায় ৯০ শতাংশ ব্যবসা-বাণিজ্য এ খাতের অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। এ দেশে শিল্প খাতে শ্রমশক্তির প্রায় ৮০ শতাংশই এসএমই খাতের। যার অর্থ, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে মূল ভূমিকা পালন করে আসছে এ খাত।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে সম্ভাবনাময় এ খাতের বিকাশ নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। বণিক বার্তার এক প্রতিবেদন জানাচ্ছে, খাতটি উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রণীত হয়েছিল পাঁচ বছর মেয়াদি ‘এসএমই নীতিমালা ২০১৯’। যদিও তা কেবল পরিকল্পনা ও সুপারিশের মধ্যেই আটকে ছিল। উপরন্তু এ নীতিমালার অধীনে গৃহীত প্রকল্পের জন্য কোনো অর্থও বরাদ্দ দেয়া হয়নি। এমনকি বিভিন্ন সময় পরিশোধন ও পরিমার্জন করে বাজেট নির্ধারণের সুপারিশ করেও সাড়া মেলেনি বিগত সরকারের আমলে। যে কারণে কোনো পরিকল্পনাই বাস্তবায়ন করা যায়নি। 

বর্তমানে বাংলাদেশ যে অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে, কর্মসংস্থান বাড়ানো অতীব জরুরি হয়ে পড়েছে। কারণ কর্মসংস্থান বৃদ্ধিহীন জিডিপি প্রবৃদ্ধি দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতির উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারে না। স্থবির কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে গতি ফেরাতে হলে এসএমই খাতে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ ও বিনিয়োগের বিকল্প নেই। এডিবির ২০১৫ সালের পরিসংখ্যান অনুসারে, দেশে কুটির শিল্পে প্রায় ৭৮ লাখ অতি ক্ষুদ্র (মাইক্রো), ক্ষুদ্র ও মাঝারি (এসএমই) শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। গত চার দশকে দেশের এসএমই খাতের উৎপাদন ক্রমে বাড়ছে। আর গত দুই দশক দেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) এ খাতের অবদান বাড়ছে ধারাবাহিকভাবে। বর্তমানে জিডিপিতে এসএমই খাতের অবদান ২৫ শতাংশ।

বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর মধ্যে জাপানের জিডিপির ৯০ শতাংশ এসএমই খাত থেকে আসে। চীনের মতো শীর্ষ অর্থনীতির জিডিপিতে ৭০-৭৫ শতাংশ ভূমিকা রাখে এ খাত। বৃহৎ অর্থনীতির বাইরে ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রেও প্রায় ৬০ শতাংশ ভূমিকা রয়েছে এসএমই খাতের। এসব দেশের মতো আমাদের জিডিপিতে এসএমই খাতের অবদান বাড়াতে, ২৫ শতাংশ থেকে উন্নীত করতে হলে বিশেষ নজর দিতে হবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উদ্যোগকে বিকশিত করতে হবে। বর্তমান সরকারকে এ বিষয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। প্রয়োজনে বিদ্যমান নীতিমালার পুনঃসংস্করণ হোক। অবশ্য এরই মধ্যে নতুন নীতিমালা প্রণয়ন বিষয়ে আলোচনা চলমান বলে জানা গেছে।

বিদ্যমান ‘এসএমই নীতিমালা ২০১৯’-এ মোট ১১টি কৌশলগত লক্ষ্য ও ৬০টি কৌশলগত হাতিয়ারের আলোকে তুলে ধরা হয় ১৩৬টি কার্যক্রম। সেগুলো পরিচালনার লক্ষ্যে বাজেট ধরা হয় ১০ হাজার ৫১২ কোটি টাকা। পরবর্তী সময়ে তা পরিশোধন ও পরিমার্জন করে ২ হাজার ১৮৩ কোটি ৪ লাখ টাকার বাজেট নির্ধারণের সুপারিশ করা হয়। সরকারের বাজেটে যদিও এসএমই ফাউন্ডেশনের জন্য কোনো বাজেট বরাদ্দ রাখা হয়নি। এর পরও এসএমই উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া, স্বল্প সুদে অর্থায়ন, নতুন উদ্যোক্তা তৈরি ইত্যাদি কর্মকাণ্ড নিজস্ব অর্থায়নে পরিচালনা করা হচ্ছে। এছাড়া এ নীতিমালা উন্নয়নের লক্ষ্যে গঠন করা হয়েছিল জাতীয় এসএমই উন্নয়ন পরিষদ (এনসিডিসি) ও জাতীয় এসএমই টাস্কফোর্স। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) ফাউন্ডেশনের সূত্রমতে, গুরুত্বপূর্ণ এ খাতের উন্নয়নে গঠিত দুই কমিটির মধ্যে সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী হচ্ছে জাতীয় এসএমই উন্নয়ন পরিষদ বা এনসিডিসি। এ কমিটি কয়েকবার সভার নোটিস জারি করে। কিন্তু ২০২২ সালের পর এনসিডিসির আর কোনো সভা হয়নি। অন্যদিকে টাস্কফোর্সও সর্বশেষ সভা করে ২০২৩ সালে। এ অবস্থায় এসএমই খাতের বিকাশে বর্তমান নীতিমালার পরিবর্তন আবশ্যক।

এমএসএমই খাত ও এ খাতের উদ্যোক্তাদের অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। এর মধ্যে প্রধানতম হচ্ছে অর্থায়ন সংকট, বিশেষ করে ঋণপ্রাপ্তি। উদ্যোক্তারা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে যৎসামান্য ঋণ পান। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর করতে হয়। কিছু ব্যাংক এক্ষেত্রে উদার নীতি অনুসরণ করলেও বেশির ভাগই তাদের অর্থায়ন করতে চায় না। এমএসএমইর উদ্যোক্তাদের দেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান থাকা সত্ত্বেও প্রায় ৬২ শতাংশ এখনো ব্যাংকে যাননি কিংবা ঋণ পাননি। অর্থায়ন না করার পেছনে ওই ব্যাংকগুলোর যেসব যুক্তি রয়েছে, সেগুলোর যথার্থতা যাচাই করে সমাধান করা জরুরি। আর্থিক সহায়তা ছাড়া এ খাতের বিকাশ কঠিন হয়ে পড়বে। উদ্যোক্তারা যেন সহজে ঋণ সুবিধা পান তা নিশ্চিত করতে হবে। সবাইকে ব্যাংক ঋণের আওতায় আনা দরকার। 

দেখা যায়, পর্যাপ্ত অর্থায়নের অভাবে উদ্যোক্তারা দক্ষতা বাড়ানোয় মনোযোগী হতে পারেন না। ফলে তাদের দক্ষতা ঘাটতি তৈরি হয়। ক্রমবর্ধমান সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে খাবি খেতে হয়। প্রযুক্তিগত জ্ঞানে তারা পিছিয়ে থাকেন, যা আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে দৌড়ে পিছিয়ে রাখে তাদের। এক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের পণ্যের গুণগত মান উন্নত করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত সহায়তা দেয়া প্রয়োজন। বিদেশে রফতানি বাড়াতে সরকারের উচিত রফতানি বাজারের জন্য পণ্যের মান নির্ধারণ ও সার্টিফিকেশনের ব্যবস্থা করা। 

আন্তর্জাতিক বাজারের সংখ্যা বাড়াতে ও ধরে রাখতে সমর্থ হলে তা দেশের গ্রামীণ অর্থনীতিকেও সুদৃঢ় করবে। কেননা দেশের এসএমই খাত মূলত গ্রামকেন্দ্রিক ও কৃষিভিত্তিক। এতে গ্রামে কর্মসংস্থান বাড়বে। বর্তমানে এসএমইতে নারী উদ্যোক্তাদের সংখ্যা বাড়ছে। এটি সামষ্টিক অর্থনীতির উন্নয়নের জন্য ইতিবাচক বিষয়। সুতরাং এ খাতের বিকাশে সরকার উদ্যোগী হবে—এটাই কামনা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন