অভিমত

জুলাই অভ্যুত্থানের গ্রাফিতিগুলো মুছবেন না

মুহাম্মাদ শাখাওয়াত হুসাইন ওয়াদুদ

ছবি : বণিক বার্তা

জুলাই অভ্যুত্থানের দুটি গুরুত্বপূর্ণ কালচারাল অনুষঙ্গ গ্রাফিতি আর কয়েকটি র‍্যাপ গান। আন্দোলনের চূড়ান্ত দিন, অর্থাৎ ৫ আগস্টের আগে ও পরে যেসব গ্রাফিতি হয়েছে সেগুলোর ধরন মোটাদাগে আলাদা। সেটি বক্তব্য বা ‘নান্দনিকতার’ দিক থেকেও আবার ফিজিক্যাল অ্যাপিয়ারেন্সের দিক থেকেও। ৫ আগস্ট স্বৈরাচার পতনের দিন পর্যন্ত দেয়ালগুলোয় যে গ্রাফিতি হয়েছে, তার অধিকাংশ মোটামুটি সাদাকালো রঙ আর স্প্রে কালার দিয়ে করা দেয়াললিখন। অল্পকিছু রঙিন যে হয়নি তা নয়, তবে ওই সময়কার গ্রাফিতিগুলোর বেশির ভাগই লেখা, চিত্রকর্ম কমই। আর শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর, অর্থাৎ ৫ আগস্টের পর যে গ্রাফিতিগুলো হয়েছে, তা প্রধানত রঙিন এবং লেখার পাশাপাশি চিত্রকর্মও এসব গ্রাফিতির অন্যতম বিষয়বস্তু।

সরকার পতনের আগ পর্যন্ত বেশির ভাগ গ্রাফিতি মূলত দেয়াললিখন, ফলে সরকারবিরোধী এবং পতনের দাবিতে বিভিন্ন স্লোগানই লেখা বা আঁকা ছিল দেয়ালগুলোয়। জুলাইয়ের মাঝামাঝি কোটা প্রথা সংস্কারের দাবিতে যেসব গ্রাফিতি হচ্ছিল, সেগুলোর স্লোগান মোটামুটি সমন্বয়বাদী। তখনো সরকারের কাছে সাধারণ দাবি হিসেবেই স্লোগানগুলো লেখা হচ্ছিল। লাল বা কালো রঙে লেখা গ্রাফিতিগুলোয় বৈষম্য কমানোর দাবি-দাওয়াই মুখ্য ছিল। যেমন ‘মুক্তিযুদ্ধের বাংলায়, বৈষম্যের ঠাঁই নাই’, ‘কোটা প্রথার সংস্কার চাই’, ‘মেধা না কোটা?’, ‘মেধাবীরা মুক্তি পাক’ ইত্যাদি।

কিন্তু ১৪ জুলাই প্রভাষ আমিনের প্রশ্নের উত্তরে যখন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী আন্দোলনকারীদের রাজাকারের বংশধর বলে কটাক্ষ করেন, তখনকার গ্রাফিতিগুলো স্পষ্ট ক্ষোভ ধারণ করতে শুরু করে। ওই সময়কার কিছু দেয়াললিখনে দেখা গেছে— ‘চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’, ‘কথায় কথায় বাংলা ছাড়, বাংলা কি তোর বাপদাদার?’, ‘তুমি কে আমি কে? রাজাকার, রাজাকার—কে বলেছে, কে বলেছে? স্বৈরাচার স্বৈরাচার’,  ‘আপস না সংগ্রাম—সংগ্রাম’, ‘দালালি না রাজপথ—রাজপথ’ ইত্যাদি। শিক্ষার্থীদের ক্ষোভের রূপান্তর দেয়ালগুলোয় তখন স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল।

ঘটনার পর পরই আন্দোলন দমনে পুলিশের কার্যকলাপ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। ১৬ জুলাই রংপুরে আবু সাঈদসহ সারা দেশে ছয়জন নিহতের খবর ছাপা হয়। জুলাই আন্দোলন দমনে এটাই প্রথম রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ডের খবর। আবু সাঈদের গুলিবিদ্ধ হওয়ার দৃশ্য বেশ কয়েকটি সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরায় ধরা পড়ে। এ ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে দেয়ালের ক্ষোভ নতুন মাত্রা ধারণ করে। টেলিভিশন ও সোশ্যাল মিডিয়ায় সাঈদের মায়ের আর্তনাদের ভিডিও আসে। যেখানে তাকে বলতে দেখা যায়—‘হামার ছাওয়াক তুই চাকরি দিবু না, না দিবু—মারলু কেনে?’ শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রথম প্রকাশ্য হত্যাকাণ্ডের এ অভিযোগ ঢাকা শহরের দেয়ালেও লেখা হতে থাকে—‘হামার ব্যাটাক মারলু কেনে?’।

রাজাকার অভিযোগ পেয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা যেসব স্লোগান লিখছিলেন, আবু সাঈদসহ কয়েকজনের মৃত্যুর পরের স্লোগানগুলো তার চেয়ে তীব্র হয়ে ওঠে। এ সময় দেয়ালে লেখা হয়—‘আমার খায়, আমার পরে, আমার বুকেই গুলি করে’, ‘বন্দুকের নলের সাথে ঝাঁজালো বুকের সংলাপ হয় না’, কোথাও কোথাও স্লোগানের পাশে সাঈদের বুক পেতে দেয়া ছবিও আঁকা ছিল। ঢাকার অসংখ্য দেয়ালে লেখা দেখেছি—‘খুনি হাসিনা’, ‘শেখ হাসিনার ফাঁসি চাই’ ইত্যাদি। বাংলাদেশের দেয়ালে অন্তত গত দুই যুগে এ ধরনের স্লোগান দেখা যায়নি। 

এরপর ১৯ জুলাই শিক্ষার্থীদের কমপ্লিট শাটডাউন এবং পাশাপাশি সরকারের ঘোঘিত কারফিউর শুরু থেকে ৪ আগস্ট পর্যন্ত কোনো কোনো দিন শতাধিকসহ কয়েকশ মানুষের নিহত হওয়ার খবর ছাপে পত্রিকাগুলো। এর মধ্যে একদিন বণিক বার্তা প্রথম পাতায় পুলিশের গুলিতে নিহত কিশোরের মরদেহের ছবি ছাপে। পাশাপাশি মিছিলে গুলি ও শত শত মানুষের মৃত্যুর খবর অব্যাহত ছিল পত্রপত্রিকায়। 

এসব হত্যার বিচার এবং শেখ হাসিনার ক্ষমা প্রার্থনার দাবিতে শিক্ষার্থীরা অসহযোগ কর্মসূচি ঘোষণা করেন—কারফিউ তো চলছিলই। ওই উত্তাল সময়গুলোয় আঁকা বা লেখা গ্রাফিতিগুলোর মধ্যে কিছু কিছু দেখা যায় অসম্পূর্ণ। দেখে মনে হতে পারে, হয়তো লেখার মধ্যে রঙ শেষ হয়ে গেছে অথবা পুলিশ বা সরকারদলীয় অঙ্গসংগঠনের লোকজন তাদের ধাওয়া করায় লেখাটি অসম্পূর্ণ রেখেই পালিয়ে যেতে হয়েছে। কিন্তু স্লোগান পুরোটা না লেখা হলেও বক্তব্য অসম্পূর্ণ থাকেনি। কারওয়ান বাজারে মেট্রোরেলের পিলারে লেখা এ রকমই একটি অর্ধসমাপ্ত স্লোগান, ‘এক দুই তিন চার, শেখ হাসিনা...’, ‘গণতন্ত্র কই? শেখ হাসিনা...’।

এর মধ্যে জুলাইয়ের তৃতীয় সপ্তাহে কোটা নিয়ে আদালতের রায়ে সব পক্ষকে সন্তুষ্ট মনে হলেও বিক্ষোভ সমাধান হয় না। কেননা এর মধ্যে অনেক রক্তহানি ঘটে গেছে। ফলে হত্যার বিচার ও সরকারপ্রধানের ক্ষমা প্রার্থনার দাবি চলতে থাকে। কিন্তু সরকার যখন হত্যার দায় স্বীকার না করে অব্যাহত অহম প্রদর্শন করতেই থাকে, তখন ৩ আগস্ট এক দফা—সরকার পতনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেন শিক্ষার্থীরা। রাজপথের মতো দেয়ালগুলোও আগুন হয়ে ওঠে ওই সময়— ‘এক দফা এক দাবি, স্বৈরাচার তুই কবে যাবি’, ‘লাশের ভিতর প্রাণ দে, নইলে গদি ছেড়ে দে’, ‘স্টেপ ডাউন হাসিনা’, ‘দড়ি ধরে মারো টান, রাজা হবে খান খান’, ‘খুনি হাসিনা স্বৈরাচার, এই মুহূর্তে গদি ছাড়’, ‘মাদার অব জেনোসাইড’, ‘ব্লাড সাকার হাসিনা’, ‘তোমার দিন শেষ’, ‘স্টপ জেনোসাইড’, ‘ফাইট ফর ইওর রাইটস’, ‘আঁর ন হাঁইয়্য, বৌতদিন হাঁইয়্য’ ইত্যাদি ওই সময়কার গ্রাফিতির ভাষার উদাহরণ।

৫ আগস্ট শেখ হাসিনা যুগের সমাপ্তির দিনেও সাভার ও যাত্রাবাড়ীসহ বিভিন্ন জায়গায় গুলি চলে। ওইদিনও অনেকের নিহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। সেদিন স্বৈরাচার পতনের এক দফা দাবি আদায় হলেও মানুষের, বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের ভাই হারানোর ক্ষত তখনো দগদগে। ফলে ক্ষুব্ধ স্লোগান লেখা হয় সেদিনও—‘শেখ হাসিনা ভাগসে, বাংলাদেশ বাঁচছে’, ‘শেখ হাসিনা পলাইসে’, ‘খুনি হাসিনার পতন—ডান’ ইত্যাদি।

২০১৮ সালে শিক্ষার্থীরা যখন নিরাপদ সড়কের জন্য আন্দোলন করেছিলেন, তখন শিক্ষার্থীদের দেয়া কিছু স্লোগান বা তাদের ব্যানারের সঙ্গে কিছু মিল পাওয়া যেতে পারে—‘পুলিশ কী করছে—স্বৈরাচারের পা চাটছে’ ইত্যাদি দেয়াললিখনে। ছয় বছর আগে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ভাষা নিয়ে সুশীল মহলে বেশ আলোচনা হয়েছিল। তবে তাতে প্রজন্মের স্লোগান বা দেয়ালচিত্রের ভাষা প্রভাবিত হয়নি। নতুন প্রজন্মের সংস্কৃতির মতো বিপ্লবের ভাষাও অন্যান্য সময়ের তুলনায় আলাদা এবং আর্থসামাজিক রাজনৈতিক বা মনস্তাত্ত্বিক কারণেই সেটি বাস্তব। অবশ্য এ সময়কার দেয়ালেও আগের প্রজন্মের স্লোগান যে একেবারেই দেখা যায়নি, তা নয়। যেমন মোহাম্মদপুরের দেয়ালে দেখা গেছে—‘যে হাত গুলি করে, সে হাত ভেঙে দাও’, ‘একাত্তরের হাতিয়ার গর্জে ওঠো আরেকবার’ এবং ‘অ্যাকশন অ্যাকশন ডাইরেক্ট অ্যাকশন’, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের স্লোগান ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ ইত্যাদি লেখা।

এতক্ষণ যেসব গ্রাফিতি বলা হচ্ছিল, তার বেশির ভাগ আনাড়ি হাতে লেখা এবং কোনো কোনোটি পহেলা বৈশাখসংশ্লিষ্ট বাঙালি সাংস্কৃতিক নান্দনিকতার প্রশ্নে অশ্লীলও বটে। তবে যেকোনো কারণেই হোক আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে এসে গ্রাফিতিগুলো মুছে ফেলতে দেখা যাচ্ছে। কিশোরসুলভ নান্দনিকতার সঙ্গে আপস করেই হোক অথবা জুলাইয়ের ওপর আগস্ট প্রলেপের উদ্দেশ্যেই হোক অভ্যুত্থানের র‍্যাডিক্যাল ইমার্জেন্সির চিহ্নধারী গ্রাফিতিগুলো মুছে ফেলা হচ্ছে। তার বদলে আঁকা হচ্ছে রঙিন ও চকচকে সব ছবি। এসব ছবিতেও সামাজিক ও রাজনৈতিক বক্তব্য আছে।

ছবিগুলোর গ্রাফিতিমূল্য নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, যদিও কেউ কেউ বলছেন, গ্রাফিতি বলতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আঁকা স্ট্রিট আর্টকেই বোঝা উচিত। এখন যেগুলো আঁকা হচ্ছে এর বেশির ভাগকে শুধু স্ট্রিট আর্ট বলা যেতে পারে। আবার কেউ কেউ এর গড়পড়তা শিল্পমান নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় একজন এখনকার আঁকা বেশির ভাগ ছবিকে প্রাইমারি স্কুলের দেয়ালে আঁকা ছবির সঙ্গে তুলনা করেছেন। তবে ‘শিল্পমানের’ চেয়ে রাজনৈতিক গুরুত্ব লেখকের কাছে বেশি। অভ্যুত্থানের লক্ষ্য অর্জনের আগে সাদাকালো স্প্রে করা স্লোগানসর্বস্ব গ্রাফিতিগুলোকে বিদ্যায়তনিক শিল্পমানের প্রশ্নে অনান্দনিক বলা হতেও পারে। তবে এর রাজনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম। এগুলোয় স্বৈরাচারের মধ্যে তৈরি হওয়া ক্ষোভ, দ্রোহ, হতাশা, জিজ্ঞাসা, আকাঙ্ক্ষা ও পরিবর্তনের আকুতি মেশানো আছে। এর যে বাস্তবভিত্তিক সৌন্দর্য, তা রঙিন অ্যাস্থেটিকে পাওয়া যাবে না।

নতুন যে দেয়ালচিত্রগুলো আঁকা হচ্ছে, সেগুলোয় জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ ও আন্দোলনের অভিজ্ঞতার স্মৃতি যেমন রয়েছে, পাশাপাশি রয়েছে সংস্কারের বার্তা—দুর্নীতিমুক্ত দেশ, সুন্দর শহর, গণতন্ত্র, সেক্যুলারিজম, ইনক্লুসিভ সমাজ ইত্যাদির আকাঙ্ক্ষা। এছাড়া দীর্ঘ স্বৈরাচারের মধ্যে অনেক কমিউনিটি তাদের সাংস্কৃতিক কার্যক্রম চালাতেও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগেছে। সরকার পতনের পর তারাও দেয়ালে গ্রাফিতি আঁকছেন। এর মধ্যে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের আঁকা কয়েকটি গ্রাফিতি সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ আলোচিত হয়েছে। তাদের গ্রাফিতির অধিকাংশ আরবি ক্যালিগ্রাফি। পাশাপাশি অতিসম্প্রতি সংস্কৃত শ্লোক লেখা গ্রাফিতিও ঢাকার দেয়ালে দেখা গেছে। এসব গ্রাফিতিকে অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশের উপাদান হিসেবেই দেখছে মানুষ।

বলা বাহুল্য, অভ্যুত্থান-পরবর্তী দেয়ালচিত্রগুলোরও রাজনৈতিক গুরুত্ব আছে। যে প্রজন্ম দেশকে স্বৈরাচারমুক্ত করল, ছবিগুলো প্রধানত তারাই আঁকছে। সময়সাপেক্ষে তাদের বার্তা ও আকাঙ্ক্ষারও গুরুত্ব আছে। চলতি দেয়ালচিত্রগুলোও সময়ের রাজনৈতিক পাঠের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এর জন্য পুরনো গ্রাফিতিগুলো মোছার প্রয়োজন নেই বলে মনে হয়। সাদাকালো রঙে লেখা আপাত অশ্লীল স্লোগানের পাশাপাশি থাকতে পারে নতুন বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষার বার্তাবাহী নতুন ছবিও। তাছাড়া যে কথাটি প্রকাশ্য দেয়ালে লিখতে দেড় যুগ অপেক্ষা করতে হয়েছে, যত অশ্লীলই হোক—সেটি বাস্তব। তাই এখনই মুছে ফেলবেন না।


মুহাম্মাদ শাখাওয়াত হুসাইন ওয়াদুদ

সহসম্পাদক, বণিক বার্তা

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন