বিপিসির প্রক্ষেপণ ছিল ব্যারেলপ্রতি প্রায় ১২২ ডলার এখন গড় দাম ৮০ ডলারের আশপাশে

জ্বালানি তেলের দাম কবে কমাবে অন্তর্বর্তী সরকার?

আবু তাহের

ছবি : বণিক বার্তা

চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের ব্যারেলপ্রতি গড় মূল্য প্রাক্কলন করেছিল প্রায় ১২২ ডলার। যদিও বিশ্ববাজারে জ্বালানি পণ্যটির গড় মূল্য এখন ৮০ ডলারের আশপাশে। সামনে তা আরো কমার পূর্বাভাস রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে নিম্নমুখী থাকলেও দেশের বাজারে এখনো দাম কমানো হয়নি জ্বালানি তেলের। উল্টো বিপিসির কর্মকর্তাদের দাবি, আন্তর্জাতিক বাজারে এ দর পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে লোকসানে পড়বে সংস্থাটি।

এর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যটির দাম বিপিসির প্রাক্কলনের চেয়ে অনেক কম। ফলে পণ্যটি আমদানিতে বিপিসির খরচও অনেক কম। কিন্তু রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিপিসি ভোক্তার কাছে সাশ্রয়ী মূল্যে জ্বালানি তেল সরবরাহের পরিবর্তে মুনাফায় মনোযোগ দিচ্ছে বেশি। তাদের লাভ-লোকসানের প্রাক্কলন নিয়েও রয়েছে অস্বচ্ছতার অভিযোগ। অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত হবে বিগত সরকারের আমলের এ চর্চা থেকে বেরিয়ে জনসাধারণের জন্য সুলভে জ্বালানি তেল প্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত করা। 

গত অর্থবছরের (২০২৩-২৪) সংশোধিত বাজেটে বিপিসি জ্বালানি তেলের ব্যারেলপ্রতি আমদানি মূল্য প্রাক্কলন 

করেছিল ১২৮ ডলার ৩৪ সেন্ট। যদিও অর্থবছরের মার্চ পর্যন্ত হিসাবে দেখা গেছে, ব্যারেলপ্রতি আমদানিতে সংস্থাটির খরচ পড়েছে গড়ে ১০৩ ডলারের কিছু বেশি। এ সময় জ্বালানি তেল বিক্রি করে বিপিসি নিট মুনাফা করেছে ৩ হাজার ৮৪১ কোটি টাকা। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে ব্যারেলপ্রতি অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের আমদানি মূল্য (সিঅ্যান্ডএফ) প্রাক্কলন করা হয়েছে ১২১ ডলার ৯১ সেন্ট। যদিও আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যটির প্রধান দুই বাজার আদর্শ ব্রেন্ট ও ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট (ডব্লিউটিআই) বর্তমানে কেনাবেচা হচ্ছে যথাক্রমে ৮১ ডলার ১৯ সেন্ট ও ৭৭ ডলার ১৫ সেন্টে। আর পরিশোধিত জ্বালানি তেলের (গ্যাস অয়েল) ব্যারেলপ্রতি দাম এখন ১১৬ ডলার। এ সময় সংস্থাটির অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানিতে খরচ কমেছে আগের অর্থবছরের তুলনায় ১৭ শতাংশের বেশি। 

যদিও বিপিসির দাবি, আন্তর্জাতিক বাজারে এখন যে দামে জ্বালানি তেল বিক্রি হচ্ছে, তাতে সংস্থাটি ব্রেক ইভেনেও (যেখানে মোট ব্যয় ও আয় সমান) নেই। দাম এ পর্যায়ে স্থিতিশীল থাকলে আগামী অর্থবছরে বিপিসির কিছুটা লোকসানও হতে পারে। 

সংস্থাটির চেয়ারম্যান মো. আমিন উল আহসান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের (পরিশোধিত ও অপরিশোধিত) বর্তমানে যে দাম রয়েছে, এই দাম স্থিতিশীল থাকলে ফর্মুলা অনুযায়ী বাজারে জ্বালানি তেল বিক্রি করলে তাতে অর্থবছর শেষে বিপিসির কিছুটা লোকসান হবে।’ জ্বালানি তেলের দাম কমানোর সুযোগ রয়েছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আপাতত যে দাম রয়েছে, সেটি বিদ্যমান থাকবে। বিপিসির কাছ থেকে জ্বালানি বিভাগ একটা মতামত নেয়। নিয়ম অনুযায়ী আমরা সেটি দিয়ে যাব। এরপর সরকার যা সিদ্ধান্ত নেবে সেটিই হবে।’

যদিও বিপিসির এ দাবির সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জ্বালানি তেল আমদানিতে প্রতি অর্থবছর বিপুল পরিমাণ লোকসানের কথা বিপিসির বাজেটে উল্লেখ করা হয়। এসব হিসাবের ভেতর বিভিন্ন খরচ অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পরে জ্বালানি তেলের দামের সঙ্গে যোগ করা হলে তা ভোক্তার ওপর গিয়ে পড়ে। বিগত ২০২৩-২৪ অর্থবছরেও ৩ হাজার ৮৪১ কোটি টাকা মুনাফা করেছে বিপিসি। অথচ ওই অর্থবছরে লোকসানের প্রাক্কলন ছিল ১০ হাজার কোটি টাকার ওপরে। এর আগে জ্বালানি তেল বিক্রিতে বিপিসির ২০২২-২৩ অর্থবছরে লোকসানের প্রাক্কলন ছিল ৭ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা। অথচ অর্থবছর শেষে হিসাবে দেখা গেছে বিপিসি ৪ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকা লাভ করেছে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরেও জ্বালানি তেল বিক্রি করে ৫ হাজার ৫৬৩ কোটি টাকা লোকসানের প্রাক্কলন করেছে বিপিসি। যদিও বাস্তব চিত্র তাদের এ প্রাক্কলনের সম্পূর্ণ বিপরীত। 

বিপিসির জ্বালানি তেলের স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় মোট ১০ ধরনের খরচ ধরা হয়। রিফাইনারি থেকে ভোক্তা পর্যায়ে এ তেল পৌঁছতে বিপিসির উন্নয়ন তহবিল, বিপণন প্রতিষ্ঠানকারীর মার্জিন, পরিবহন তহবিল, ডিলার এজেন্ট কমিশনসহ নানা খরচ রয়েছে। এর সঙ্গে বড় আকারের মুনাফা মার্জিনও যোগ করে বিপিসি। সরকারের ভ্যাট-ট্যাক্স ও আনুষঙ্গিক ব্যয় জ্বালানি তেলের ভোক্তার ওপর চাপিয়ে দেয়ার পরও এ মুনাফার মার্জিন কতটা যুক্তিসংগত ও নৈতিক সে বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন জ্বালানিসংশ্লিষ্টরা। 

তাদের ভাষ্য, এ মার্জিনের ফলে দেশের বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমানো যাচ্ছে না। এমনকি জ্বালানি বিভাগ যে প্রক্রিয়ায় স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি চালু করেছে, সেটিও এখন বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) গণশুনানির মধ্য দিয়ে পরীক্ষা করা দরকার। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম এখন নিম্নমুখী। এ অবস্থায় বিপিসি যদি মুনাফার মার্জিন কমায়, তাহলেও দেশের বাজারে সাশ্রয়ী দামে জ্বালানি তেল পাবেন ভোক্তারা। সরকারকে ট্যাক্স-ভ্যাট পরিশোধ করার পর বিপিসির পরিচালন ব্যয় নির্বাহ ছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিপুল পরিমাণ মুনাফার পেছনে ছোটার যুক্তিসংগত কোনো কারণ নেই।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ম. তামিম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিপিসির পেট্রল, অকটেন বিক্রিতে কোনো লোকসান নেই। ডিজেল বিক্রিতে তারা লোকসানের কথা বলে, অথচ লোকসান হয় কিনা সেটি জানার সুযোগ নেই ভোক্তার। বছর শেষে বিপিসির আর্থিক হিসাব দেখলে বোঝা যায় তাদের জ্বালানি তেল বিক্রিতে কোনো লোকসান নেই। বিপিসির জ্বালানি তেল বিক্রিতে একটি মূল্য নির্ধারণ ফর্মুলা জারি করেছে জ্বালানি বিভাগ। সেই অনুযায়ী বাজারে জ্বালানি তেল বিক্রি হচ্ছে। স্বচ্ছতার জন্য হলেও বিপিসির জ্বালানি তেল বিক্রির ফর্মুলা নিয়ে বিইআরসির গণশুনানিতে আলোচনা করা যেতে পারে। তাহলে ভোক্তা জানতে পারবে তারা কোন পণ্য কত টাকায় কিনছে, যেটা এলপিজির দাম নির্ধারণ প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে করা হয়েছে। স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে করা গেলে বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমানো সম্ভব। সরকারের দাম নির্ধারণ পদ্ধতি রহিত করে বিইআরসিকে দেয়া হয়েছে। এখন দেখা যাক বিইআরসি কী করতে পারে।’ 

আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে মিল রেখে চলতি বছরের মার্চ-জুন পর্যন্ত জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় করেছে বিগত সরকার। স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণ ফর্মুলায় দাম নির্ধারণে লিটারপ্রতি ডিজেল-কেরোসিন, পেট্রল ও অকটেনের কিছু মাত্রায় ওঠানামা করেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর গ্যাস-বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ বাতিল করে দিয়েছে। সে সঙ্গে বর্তমানে জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণ আপাতত বন্ধ থাকবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।

জ্বালানি তেল বিক্রি করে ২০১৪-১৫ অর্থবছরের পর থেকে মুনাফার ধারায় রয়েছে বিপিসি। ওই সময় থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত ৪৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বেশি মুনাফা করেছে সংস্থাটি। এর মধ্যে কেবল ২০২১-২২ অর্থবছরে ২ হাজার ৭০৬ কোটি টাকা লোকসান হয়েছিল।

বিপিসির জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণ ফর্মুলায় বলা হয়েছে, ডিজেল ও কেরোসিনের চেয়ে সবসময় ১০ টাকা বেশি থাকবে অকটেনের দাম। যদিও বাজারে এখন ডিজেল বিক্রি হচ্ছে প্রতি লিটার ১০৭ টাকা ৭৫ পয়সায়। আর অকটেন বিক্রি হচ্ছে লিটারপ্রতি ১৩১ টাকা। এতে ডিজেলের চেয়ে দাম বেশি রাখা হচ্ছে ২৩ টাকা ২৫ পয়সা। এ বিষয়ে জ্বালানি বিভাগসংশ্লিষ্ট দুজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বক্তব্য হলো অকটেন ও পেট্রলে বিপিসির কোনো লোকসান নেই। ডিজেলে লোকসান হলে সেটিও পেট্রল-অকটেন থেকে পুষিয়ে নেয়া যাচ্ছে। 

এর আগে ২০২২-২৩ অর্থবছরের অনুমোদিত বাজেটে ৩ হাজার ৩৬৪ কোটি ৮৪ লাখ টাকা লোকসানের প্রাক্কলন করেছিল বিপিসি। পরে সংশোধিত বাজেটে তা আরো বাড়িয়ে ৭ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা দেখানো হয়। অথচ জ্বালানি তেল বিক্রি করে ওই অর্থবছর শেষে সংস্থাটির কর-পূর্ববর্তী মোট মুনাফা হয়েছিল ৬ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা। আর কর-পরবর্তী নিট মুনাফা হয় ৪ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। এ সময় সরকারি কোষাগারে আমদানি শুল্ক, ভ্যাট, লভ্যাংশ, আয়করসহ বিভিন্ন খাতে মোট ১৫ হাজার ৪৯২ কোটি ৬৫ লাখ টাকা জমা দিয়েছে বিপিসি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শুরুতে জ্বালানি তেল বিক্রি করে বিপিসির লোকসানের প্রাক্কলন ছিল ১০ হাজার ১৯ কোটি টাকা। অথচ সংশোধিত বাজেটে অর্থ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ৩ হাজার ৮৪১ কোটি টাকা মুনাফা হবে সংস্থাটির। সে অনুযায়ী, গত দুই অর্থবছরে বিপিসির মোট মুনাফার প্রাক্কলিত পরিমাণ ৮ হাজার ৪২৭ কোটি টাকায়।


এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন