বিশ্ববিদ্যালয়ের উৎকর্ষ সাধনে চাই উপাচার্য নিয়োগ নীতিমালা

ড. মো. মুনিবুর রহমান

ছবি: বণিক বার্তা

গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী ১৬ আগস্ট পর্যন্ত দেশের ১৯টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদত্যাগ করেছেন। সংখ্যাটি আরো বাড়তে পারে। দ্রুত উপাচার্য নিয়োগ না দিলে অচিরেই এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়বে। ফলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে এ ১৯টিসহ আরো কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিদ্রুত উপাচার্য নিয়োগ দিতে হবে। এ কারণেই বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগের যে সংস্কৃতি বা অপসংস্কৃতি চালু রয়েছে, তা পরিবর্তনের এখনই উপযুক্ত সময়। রাজনৈতিক সরকারগুলো যেসব সীমাবদ্ধতা কারণে বা সদিচ্ছার অভাবে এ বিষয়ে একটা উপযুক্ত নীতিমালা তৈরি করতে পারেনি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সেই সীমাবদ্ধতা নেই।

দেশের উচ্চ শিক্ষার বিকাশ ও বিস্তারে উপাচার্যদের ব্যাপক ভূমিকা থাকে। উপাচার্য যদি সৎ, উদ্যমী ও যোগ্যতাসম্পন্ন না হন, তাহলে অবশ্যই উচ্চ শিক্ষার বিকাশ ও বিস্তার বাধাপ্রাপ্ত হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত উপাচার্য নিয়োগের কোনো প্রকাশিত বা গ্রহণযোগ্য নীতিমালা নেই। ফলে একজন উপাচার্যের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কী কী গুণ চায়, তার কোনো তালিকা বা নির্ধারিত নীতিমালা না থাকায় এক্ষেত্রে উপাচার্য নিয়োগে চলে যথেচ্ছাচার। একজন উপাচার্যের মধ্যে একাডেমিক ও প্রশাসনিক নেতৃত্বের গুণ যেমন থাকতে হয়, তেমনি থাকতে হয় সততা, সদিচ্ছা, দূরদর্শিতা এবং দেশ ও মানুষের প্রতি পরম মমত্ববোধ।

দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় উপাচার্য নিয়োগের সময় এসব বিষয় কি আদৌ বিবেচনায় নেয়া হয়? আমার জানামতে, এগুলোর কিছুই গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নেয়া হয় না। উপাচার্য নিয়োগের জন্য কোনো বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয় না, গঠন করা হয় না কোনো সার্চ কমিটিও। তৈরি করা হয় না ফিট লিস্ট। নেই যোগ্যতার কোনো সুনির্দিষ্ট মাপকাঠি। তাহলে কীভাবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগ হয়?

যেসব শিক্ষকের উপাচার্য হওয়ার খুব শখ থাকে, তারা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে জীবনবৃত্তান্ত জমা দিয়ে আমলাতন্ত্র ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিভিন্ন স্তরে তদবির শুরু করেন। যে শিক্ষক আমলাতন্ত্র ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে নিজেকে সবচেয়ে বেশি আজ্ঞাবহ ও তাঁবেদার প্রমাণ করতে পারেন, তিনিই লাভ করেন উপাচার্যের আসন। আমার জানামতে, এটাই এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় উপাচার্য নিয়োগের অলিখিত ও বহুল চর্চিত নীতিমালা। এটা কি কোনো সভ্য দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্ণধার নিয়োগের নীতিমালা হতে পারে?

কে উপাচার্য হতে সবচেয়ে আগ্রহী, সেটা বিবেচ্য না হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কে সবচেয়ে উপযুক্ত বা বিশ্ববিদ্যালয় কাকে চায় সেটাই হওয়া উচিত ছিল উপাচার্য নিয়োগের মূল মানদণ্ড। একজন একাডেমিক নেতা হিসেবে উপাচার্য নির্বাচনে কখনই রাজনৈতিক বিবেচনা অভিপ্রেত নয়। তার পরও যুক্তির খাতিরে ধরে নিলাম, একটা রাজনৈতিক সরকার সমযোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থীদের মধ্য থেকে তার পছন্দের মতাদর্শের ব্যক্তিকে নিয়োগ দেবে, এটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু একই মতাদর্শের অনুসারীদের মধ্যেও সততা ও যোগ্যতার ফারাক থাকে। একই রাজনৈতিক মতাদর্শের অনুসারীদের মধ্যে থেকেও যোগ্যতম ব্যক্তিকে চয়ন করা যায়। কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাসে সেটা কদাচিৎ ঘটেছে।

একজন সৎ, যোগ্য ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন শিক্ষক কখনই পদলোভী, আজ্ঞাবাহী, তাঁবেদার ও তদবিরবাজ হতে পারেন না। অথচ উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে তদবির নাকি একমাত্র মানদণ্ড হিসেবে কাজ করে। এমন ভাবার যথেষ্ট কারণও আছে। তদবির করেননি অথচ উপাচার্য নিযুক্ত হয়েছেন, বাংলাদেশে গত তিন বা সাড়ে তিন যুগে এমন ঘটনা একটিও ঘটেছে কিনা সন্দেহ। এটা শুধু উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রেই নয়, বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার থেকে প্রশাসনিক পদে নিয়োগের ক্ষেত্রেও একই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। অর্থাৎ সেখানেও তদবির ছাড়া প্রশাসনিক পদে পদায়ন একটি বিরল ঘটনা।

তাঁবেদার ও তদবিরবাজ কখনো রুচিশীল ও উন্নত ব্যক্তিত্বের অধিকারী হতে পারেন না। অথচ তারাই সাধারণত সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাণ্ডারি হওয়ার দায়িত্ব পেয়ে থাকেন। তাই তাদের কর্মকাণ্ডেও অধিকাংশ সময় উন্নত রুচি ও ব্যক্তিত্বের প্রতিফলন ঘটে না। ব্যক্তিস্বার্থে নিমজ্জিত থাকা এবং দূরদর্শিতা ও সদিচ্ছার অভাবে তারা বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষাকে কাঙ্ক্ষিত উচ্চতায় নিতে পারেননি। উপরন্তু ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধার ও তাঁবেদারি করতে গিয়ে তারা অনেক বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্ম দিয়েছেন যা কোনোভাবেই একজন উপাচার্যের কাছ থেকে মানুষ প্রত্যাশা করে না। ফলে বাংলাদেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের সম্পর্কে জনমনে অনেক নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে। এমন ধারণার মূলে রয়েছে এই প্রশ্নবিদ্ধ উপাচার্য নিয়োগ নীতিমালা।

তাহলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগের প্রক্রিয়া কেমন হওয়া উচিত? একাডেমিক ও প্রশাসনিক নেতা হিসেবে একজন উপাচার্যের যেসব যোগ্যতা থাকা উচিত, তা দেশের নির্মোহ ও গুণী শিক্ষাবিদদের দ্বারা নির্ধারণ করা উচিত। তারপর উপাচার্য নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা যেতে পারে, যেখানে এসব যোগ্যতার কথা উল্লেখ থাকবে। শুধু যোগ্যতা নির্ধারণ করলেই হবে না, অধিকতর যোগ্যতাসম্পন্ন অধ্যাপকদের আকৃষ্ট করার জন্য উপাচার্যদের বেতন-ভাতাও বাড়ানো উচিত। বাংলাদেশে একজন উপাচার্য শিক্ষক হিসেবে যে বেতন-ভাতা পেয়ে থাকেন, উপাচার্য হিসেবেও তিনি সেই একই বেতন-ভাতা পেয়ে থাকেন। কিন্তু আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে একজন উপাচার্যের বেতন স্কেল আলাদা, যা একজন অধ্যাপকের থেকে বেশ বেশি। একজন উপাচার্যকে অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হয়, ঝুঁকি নিতে হয়। তাহলে সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো না হলে একজন সৎ ও অধিকতর যোগ্য অধ্যাপক কেন এ বাড়তি পরিশ্রম ও ঝুঁকি নেবেন?

উপাচার্য নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর সৎ, যোগ্য ও নির্মোহ অধ্যাপক বা শিক্ষাবিদদের দ্বারা গঠিত সার্চ কমিটি আবেদনপত্রগুলো যাচাই-বাছাই করে একটি ফিট লিস্ট তৈরি করতে পারেন। সরকার সেই ফিট লিস্ট থেকে উপাচার্য নিয়োগ দিতে পারে। যোগ্যতার পাশাপাশি খুব গুরুত্ব দেয়া উচিত একজন উপাচার্য পদপ্রার্থীর সততার দিকে। কারণ বাংলাদেশে প্রায় সব সেক্টরে যে গুণটির ঘাটতি সবচেয়ে প্রবলভাবে দৃশ্যমান, তা হলো সততা। ফলে উপাচার্যদের অতীত কর্মকাণ্ডের রেকর্ড খুব গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেয়া উচিত। একজন সৎ ব্যক্তি তার যেকোনো ঘাটতি সময় ও শ্রম দিয়ে পূরণ করে নিতে পারেন। কিন্তু সততার ঘাটতি কোনো কিছু দিয়েই পূরণ করা যায় না। একজন উপাচার্য নিয়োগে যদি ভুল হয় বা ভুল ব্যক্তিকে যদি নিয়োগ দেয়া হয়, তাহলে কয়েক বছর ধরে হাজার হাজার গ্র্যাজুয়েট খারাপ শিক্ষা ব্যবস্থায় বেড়ে উঠবে। এ খারাপ শিক্ষা ব্যবস্থায় গড়ে ওঠা হাজার হাজার গ্র্যাজুয়েট আবার দেশকে যুগ যুগ ধরে খারাপ বা নিম্নমানের সেবা দেবে যা উন্নত দেশ গড়ার পথে বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে।

বাংলাদেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান বা আচার্য হলেন মহামান্য রাষ্ট্রপতি। আচার্য হিসেবে মহামান্য রাষ্ট্রপতি যদি বছরে অন্তত একবার উপাচার্যদের নিয়ে বসেন, তাদের সুবিধা-অসুবিধার কথা শোনেন, কোনো উপাচার্যের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ থাকলে আচার্য হিসেবে যদি জবাবদিহি চান, তাহলে বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনেক বেশি গতিশীল হবে, খুব দ্রুত এগিয়ে যাবে সামনের দিকে।

সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব ছাড়া রাষ্ট্র সংস্কার বা টেকসই উন্নয়ন কোনোটাই সম্ভব নয়। শিক্ষার মানোন্নয়ন ছাড়া দেশের সরকারি-বেসরকারি খাতের নেতৃত্বের মানোন্নয়ন যেমন সম্ভব নয়, তেমনি নেতৃত্বের মানোন্নয়ন ছাড়া দেশের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। কারণ দেশের সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন খাতে উচ্চ পর্যায়ে যারা নেতৃত্ব দেন তাদের অধিকাংশই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট। ফলে আগামীর বাংলাদেশের উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে আগে দেশের অনাগত গ্র্যাজুয়েটদের জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। দেশের অনাগত গ্র্যাজুয়েটদের জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষার আদর্শ মান ও পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। আবার শিক্ষার আদর্শ মান ও পরিবেশ নিশ্চিত করতে হলে আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাণ্ডারী বা উপাচার্যের যোগ্যতা, সততা ও দেশপ্রেম নিশ্চিত করতে হবে। এ কারণে রাষ্ট্র সংস্কার বা টেকসই উন্নয়ন এবং বিশ্বটিবদ্যালয়গুলোর জন্য সৎ, যোগ্য, সদিচ্ছাসম্পন্ন, রুচিশীল ও নির্মোহ উপাচার্য নিয়োগ একই সূত্রে গাঁথা।

ড. মো. মুনিবুর রহমান: সহযোগী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ

যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন