ফের আসর জমাচ্ছেন তানসেন

মাহমুদুর রহমান

মঞ্চে চলছে ‘তানসেন’ ছবি: স্ক্রল ডটইন

মিয়া তানসেনের নাম জানেন না এমন লোক ভারতে দুর্লভ। আর কিছু না জানলেও এটুকু জানেন যে মোগল বাদশাহ আকবরের দরবারের নবরত্নের একজন তানসেন। এটা না জানলেও কোনো একদিন শুনেছেন তানসেন নামের এক শিল্পী গান গেয়ে আগুন জ্বালাতে, বৃষ্টি নামাতে পারতেন। কিন্তু সে তো বহুকাল আগের কথা। বাস্তবের চেয়ে মিথ বেশি। একাডেমিক গবেষণা থেকে সিদ্ধান্তে আসা যায়, তানসেন নামে একজন ব্যক্তি ছিলেন। তিনি হিন্দুস্তানি খেয়ালের জনক। সেই সঙ্গে ভারতের শাস্ত্রীয় সংগীতে তার অবদান অনেক। সেই তানসেনকেই দিল্লির মঞ্চে এনেছেন তিনজন। দক্ষিণ দিল্লির একটি বাংলোর বেজমেন্টে কয়েকজন অভিনেতা নতুন করে জন্ম দিয়েছেন তানসেনকে।

একটি সাধারণ সেটে তিনজন অভিনেতা তানসেনের গল্পটা বলেন। তাদের প্রধান হলেন ঋকহরি। তানসেনের চরিত্রে তিনিই অভিনয় করেন। আর সঙ্গে থাকেন ফাহিম ও ঋদ্ধিমা বাগগা। নাটকটির প্রযোজক ট্রায়ালগ কোম্পানি। এটি তাদের প্রযোজিত প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য নাটক। আবুল ফজল ও সমসাময়িক আরো অনেক ইতিহাস লেখকের কলম থেকে তানসেনের যে পরিচয় পাওয়া যায়, তাকেই মঞ্চে মূর্ত করেছে নাটকটি। এতে ১৯৭২ সালে লেখা গিরিশ চতুর্বেদীর উপন্যাস ‘তানসেন’-এর ছাপ পাওয়া যায়। তবে ট্রায়ালগ কোম্পানি নাটকটি সাজিয়েছে নিজেদের মতো করে। গল্প বলার ধরনটা সরল নয়। কেননা গল্পের পাশাপাশি তারা রেখেছে গান, নাচ, রাজা-রাজরা ও পারিষদের উপস্থাপনা।

তানসেন নাটক দেখতে থাকলে একসময় দর্শকের মনে হবে তিনি ষোড়শ শতকে প্রবেশ করেছেন। কেননা নাটকে ফকির, নর্তকী, সংগীতকারদের গল্প তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন প্রযোজকরা। মজার ব্যাপার, এ নাটক নিয়ে শুরুতে আত্মবিশ্বাসী ছিল না কেউ। ট্রায়ালগ জানত না নাটকটা গৃহীত হবে। কিন্তু এরই মধ্যে ১৮১ বার মঞ্চায়ন হয়েছে নাটকের। ইতিহাস, গল্প, নাটক ও কমিকেও উপস্থিত তানসেন। তাকে নিয়ে ট্রায়ালগের তাই চেষ্টা ছিল সংগীতকার ও ব্যক্তি তানসেনকে বের করে আনা। এছাড়া ইতিহাস বা মিথের তানসেনের বাইরে এ সময় তানসেনের প্রভাব দেখাতে চেয়েছেন তারা।

তানসেন ও এ নাটকের তানসেন নিয়ে ঋকহরি বলেন, ‘তার সম্পর্কে অনেক কথাই প্রচলিত। অনেক গল্প আছে। আমরা চাইনি কোনো গল্পে তাকে সীমাবদ্ধ করে ফেলতে। বরং আমাদের আগ্রহ ছিল তানসেনের জীবন ও কর্ম আজ আমাদের কাছে কী অর্থে গৃহীত, তা খুঁজে বের করা। ইতিহাস আমাদের জন্য বিশ্বাস ও শিল্প সম্পর্কে কী রেখে গেছে, তা দেখার চেষ্টা করেছি।’

মূলত নাটকে সে কাজ করতেও পেরেছেন এর নির্মাতারা। ২ ঘণ্টা দৈর্ঘ্যের এ নাটক তানসেনের পাশাপাশি ইতিহাসের সেই সময়, হাস্যরস ও রাজনৈতিক নানা বিষয়কে স্পর্শ করে।

ভারতের সিনেমায় বহু সময় তানসেনকে দেখা গেছে। দীর্ঘ সময় তানসেন বলতে লোকে জানত কেএল সায়গলকে। ওপরের দিকে বাঁকানো গোঁফের সেই মানুষ ও তার গলায় ‘দিয়া জ্বালাও’ অনেকের কণ্ঠে উঠেছে। ছিলেন ভারত ভূষণ। মুকেশের গলায় তিনি ঠোঁট মিলিয়েছেন ‘ঝুমতি চালি হাওয়া’য়। সিনেমার নাম ‘সংগীত সম্রাট তানসেন’। আমীর খানের কণ্ঠ বেজেছিল ‘বৈজু বাওয়া’য় তানসেন হিসেবে। আর কে আসিফের ‘মোগল-এ-আজম’-এ তানসেন হয়ে গেয়েছিলেন বড়ে গোলাম আলী খান। সেটা ছিল খেয়াল।

যেমনটা শুরুতে বলা হয়েছে, তানসেনকে নিয়ে আছে নানা গল্প ও মিথ। যেমন গান গেয়ে আগুন জ্বালানো বা বৃষ্টি নামানো। ঋকহরি এ নিয়ে বাস্তবসম্মত ভাবনা রাখেন। তিনি মনে করেন, বিষয়গুলো আসলে রূপক। ঋক বলেন, ‘আমার মনে হয় বোঝা দরকার যে বিষয়গুলো কী প্রকাশ করে। তাপ বা আগুনের কথার সঙ্গে রাগ দীপকের মিল পাওয়া যায়। হতে পারে এ দিয়ে ইগো, গর্ব, অহমিকা বোঝানো হয়। আবার মল্লারে থাকতে পারে নম্রতার শক্তি।’ এ কারণেই ঋক তাদের নাটকে শিল্প, উচ্চাভিলাষের সঙ্গে ভালোবাসা ও অধাত্ম্যবাদ রেখেছেন।

নাটকটি নিয়ে ঋকহরিরা ২০১৭ সালে কাজ শুরু করেন। প্রথম চিন্তাটাই ছিল নাটক কেমন করে উপস্থাপন করা হবে। তারা কি তানসেন জমানার ধ্রুপদেই থেকে যাবেন? কিন্তু সেটা নিয়ে পরে বেশি সমস্যা হয়নি। কেননা প্রধান দুই অভিনেতা ঋক ও ফাহিম দুজনই অসাধারণ গায়ক। তারা তানসেনের ধ্রুপদ ‘তুম রব তুম সাহিব’ দিয়ে শুরু করেন নাটক। ঋক বলেন, ‘আমরা কতগুলো প্রশ্নের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে থাকতে চাইনি। সময় ও তানসেনকে পরিচয় করাতে যা প্রয়োজন তা-ই এনেছি।’

এসব মিলে তানসেন হয়ে উঠেছে একটা পূর্ণাঙ্গ নাটক আর সেই সঙ্গে ষোড়শ শতাব্দীর এক ঐতিহাসিক চরিত্রকে চাক্ষুষ করার সুযোগ হয়েছে নাটকের দর্শকের।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন