তিন বছরে ট্রেজারি বিলের স্থিতি বেড়ে দ্বিগুণের বেশিতে, সুদহার বেড়েছে পাঁচ গুণ

সরকারের উচ্চ সুদের স্বল্পমেয়াদি ঋণই মূল্যস্ফীতি কমাতে বড় প্রতিবন্ধক কি

হাছান আদনান

ছবি : বণিক বার্তা

বছর দুই আগেও ৯১ দিন মেয়াদি সরকারি ট্রেজারি বিলের সুদহার ছিল আড়াই শতাংশেরও কম। স্বল্পমেয়াদি এ ঋণের সুদহার এখন ১১ শতাংশ ছাড়িয়েছে। মেয়াদ বেশি হলে ঋণ নিতে সরকারকে আরো বেশি সুদ গুনতে হচ্ছে। ব্যাংকগুলো এখন ব্যক্তি খাতের চেয়ে সরকারকে ঋণ দেয়াকেই বেশি লাভজনক মনে করছে। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের ডিসেম্বরে ৯১ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের গড় সুদহার ছিল ২ দশমিক ৩৬ শতাংশ। ধারাবাহিকভাবে বেড়ে চলতি এপ্রিলে এ বিলের সুদহার ১১ দশমিক ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছে। সে হিসেবে সবচেয়ে কম মেয়াদি এ বিলের সুদহার বেড়েছে ৩৮১ শতাংশ বা প্রায় পাঁচ গুণ। ১৮২ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের সুদহার ২৫৭ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে এ ট্রেজারি বিলের গড় সুদহার ছিল ৩ দশমিক ১৯ শতাংশ। চলতি এপ্রিলে ছয় মাস মেয়াদি এ বিলের সুদহার ১১ দশমিক ৪০ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছে। এক বছর বা ৩৬৪ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের সুদহার বেড়েছে ২৩৪ শতাংশ। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে সর্বোচ্চ মেয়াদের এ বিলের সুদহার ৩ দশমিক ৪৪ শতাংশ থাকলেও তা এখন ১১ দশমিক ৫০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।

ইল্ড রেট বা সুদহারের পাশাপাশি ট্রেজারি বিল ব্যবহার করে সরকারের নেয়া ঋণের স্থিতিও দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের ডিসেম্বরে ট্রেজারি বিলের মাধ্যমে নেয়া সরকারের ঋণ স্থিতি ছিল ৬২ হাজার ১৫০ কোটি টাকা। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে এ ঋণের স্থিতি ১ লাখ ৩৬ হাজার ২১০ কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। এ সময়ে সরকারের স্বল্পমেয়াদি এ ঋণ স্থিতি বেড়েছে ৭৪ হাজার ৬০ কোটি টাকা বা ১১৯ শতাংশ। চলতি এপ্রিল পর্যন্ত সরকারের নেয়া এ ঋণের স্থিতি আরো স্ফীত হয়েছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সরকার নিজেই ঋণের দুষ্টচক্রে আটকে গেছে। গত বছর কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দিয়েছিল। এবার সেটি করতে না পারায় ট্রেজারি বিলের সুদহার এতটা উচ্চতায় উঠে গেছে। দেশের ব্যাংক খাতে সরকারই এখন সবচেয়ে বড় ভোক্তা। সরকার উচ্চ সুদে ঋণ নেয়া অব্যাহত রাখলে মূল্যস্ফীতি কমবে না। উচ্চ সুদের এ ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে সরকারের অর্থ সংকট আরো তীব্র হবে। তখন আরো বেশি সুদে ঋণ নিয়ে সরকারকে ঋণ পরিশোধ করতে হবে।

অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, সরকার ঋণের দুষ্টচক্রে যেভাবে জড়িয়ে পড়ছে, সেখান থেকে বের হওয়া অনেক কঠিন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘‌রাজস্ব ঘাটতি সত্ত্বেও সরকার প্রতি বছর বিরাট আকারের বাজেট ঘোষণা করছে। বাজেট ঘাটতি মেটাতে দেশী-বিদেশী উৎস থেকে ঋণ নিচ্ছে। এ মুহূর্তে মুদ্রাবাজারে টাকা নেই। এ কারণে উচ্চ সুদে সরকার ঋণ নিতে বাধ্য হচ্ছে। এত বেশি সুদে ঋণ নেয়ার কারণে সরকারের সংকট আরো তীব্র হবে। সরকার ১১ শতাংশের বেশি সুদে স্বল্পমেয়াদি ঋণ নিচ্ছে। অথচ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি সুদহার ৮ শতাংশ। ব্যাংকগুলোর কাছে এখন সরকারই সবচেয়ে বড় ভোক্তা। ব্যাংক নির্বাহীরা সরকারকে ঋণ দিয়ে “‍নাকে তেল দিয়ে’’ ঘুমাতে পারছেন। ব্যক্তি খাতে ঋণ দেয়ার কোনো প্রয়োজনীয়তাই ব্যাংকের এখন নেই। কেবল পরিচালকদের স্বার্থসংশ্লিষ্টদের ব্যবসা দেখলেই হলো।’

আগামী দুই মাসে সরকার ব্যাংক খাত থেকে আরো ৮০-৯০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিতে বাধ্য হবে বলে মনে করেন এ অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, ‘গত বছর কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দিয়েছে। সে ঋণ দেশের মূল্যস্ফীতি উসকে উঠতে সহায়তা করেছে। এবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, তারা নতুন টাকা ছাপাবে না। তার মানে বাজার থেকে সরকারের নেয়া ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা। ব্যাংক খাতে যে পরিমাণ আমানত বাড়বে, তার পুরোটাই সরকারের ঋণে চলে যাবে। তাহলে ব্যক্তি খাত এখানে কী পাবে?’

মূল্যস্ফীতির হার কমানোর কথা বলে গত বছরের জুলাইয়ে ব্যাংক ঋণের সুদহার বাড়ানোর নীতি গ্রহণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চলতি এপ্রিলে ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার নির্ধারণ করা হয়েছে ১৩ দশমিক ৫৫ শতাংশ। গত বছরের জুন পর্যন্ত ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদ ৯ শতাংশ নির্ধারিত ছিল। মাত্র নয় মাসের ব্যবধানে সুদহার ৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ বাড়লেও সেটির প্রভাব মূল্যস্ফীতিতে দৃশ্যমান হয়নি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ ফেব্রুয়ারিতেও দেশে মূল্যস্ফীতির গড় হার ছিল ৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ। এ নিয়ে টানা ২০ মাস ধরে দেশের মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশের ওপরে রয়েছে। যদিও অর্থনীতিবিদদের দাবি, দেশের প্রকৃত মূল্যস্ফীতির হার বিবিএসের তথ্যের চেয়ে অনেক বেশি।

উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে শ্রীলংকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকও ঋণের সুদহার বাড়িয়েছিল। দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপ দেশটি তার আর্থিক খাত সংস্কার ও সুদহার বৃদ্ধির সুফল হাতেনাতে পেয়েছে। ২০২২ সালে শ্রীলংকার মূল্যস্ফীতির হার উঠে গিয়েছিল প্রায় ৬০ শতাংশে। রিজার্ভ সংকটে জ্বালানি তেলের মতো পণ্য আমদানিও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল দেশটির। আমদানি দায় আর বিদেশী ঋণ পরিশোধের ব্যর্থতায় নিজেকে দেউলিয়াও ঘোষণা করেছিল শ্রীলংকা সরকার। কিন্তু ইতিহাসের সবচেয়ে নাজুক সে পরিস্থিতি দ্রুতই কাটিয়ে উঠছে শ্রীলংকা। দেশটির মূল্যস্ফীতির হার কমতে কমতে মার্চে ১ শতাংশেরও নিচে নেমে এসেছে।

আহসান এইচ মনসুরের ভাষ্যমতে, ‘‌শ্রীলংকা তাদের অর্থনৈতিক সংকটের কারণ দ্রুততম সময়ের মধ্যে চিহ্নিত করতে পেরেছিল। সংকট কাটাতে দূরদর্শী ও ত্বরিত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ কারণে মূল্যস্ফীতির হার ১ শতাংশের ঘরে নামিয়ে আনতে পেরেছে। কিন্তু আমরা এখনো সংকটের কারণই অনুসন্ধান করে চলছি। সুদহার বাড়ানোসহ যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, সেগুলো যথেষ্ট নয়।’

বাজেট ঘাটতি মেটাতে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সরকার ব্যাংক খাত থেকে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্য স্থির করেছে। যদিও বাস্তবতা বলছে, লক্ষ্যের চেয়েও ব্যাংক খাত থেকে সরকারকে বেশি ঋণ নিতে হতে পারে। দেশের ব্যাংক খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশের ঘরে। অর্থাৎ চলতি অর্থবছরে ব্যাংকগুলোয় দেড় লাখ কোটি টাকার আমানত বাড়লে তার প্রায় সমপরিমাণ ঋণ কেবল সরকারকেই নিতে হবে।

অর্থের সংকটে থাকা সরকার বিদ্যুৎ-সারসহ বিভিন্ন খাতের ভর্তুকির অর্থও পরিশোধ করতে পারছে না। এজন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বিশেষ বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে ভর্তুকি পরিশোধের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে বিদ্যুৎ ও সারে বকেয়া ভর্তুকির বিপরীতে ২০ হাজার কোটি টাকারও বেশি বন্ড ইস্যু করা হয়েছে। প্রক্রিয়াধীন রয়েছে আরো ৭ হাজার কোটি টাকার বন্ড। দেশের ব্যাংকগুলো নগদ টাকা না পেয়ে এসব বন্ডের সাবস্ক্রিপশন করছে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারকে অবশ্যই ব্যয় কমাতে হবে বলে মনে করছেন সাবেক অর্থ সচিব মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে প্রধান লক্ষ্য স্থির করেছে। এজন্য নীতি সুদহার বাড়ানোর পাশাপাশি ব্যাংক ঋণের সুদহার বাড়িয়ে বাজারে তারল্যের সরবরাহ নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু আমরা দেখছি, ব্যয় নির্বাহের জন্য সরকার নিজেই ব্যাংক খাত থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিচ্ছে। এ ধরনের ঋণ নেয়া বন্ধ না করলে মূল্যস্ফীতি ও তারল্য পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে না। বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারকে অবশ্যই তার ব্যয় কমাতে হবে। অপ্রয়োজনীয় উন্নয়ন প্রকল্প, নতুন গাড়ি কেনার মতো প্রকল্প বন্ধ করতে হবে। সরকারের রাজস্ব নীতি সংস্কারের পাশাপাশি আয় বাড়াতে হবে।’ 

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরকারের নেয়া ঋণের স্থিতি ছিল ৮ লাখ ২২ হাজার ৫৩২ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৩ লাখ ৯২ হাজার ৫২১ কোটি টাকার ঋণ নেয়া হয়েছে ব্যাংক খাত থেকে। ট্রেজারি বিল ও বন্ডের মাধ্যমে ব্যাংকগুলো থেকে এ ঋণ নিয়েছে সরকার। প্রতি অর্থবছরের বাজেটে সরকারের পক্ষ থেকে সুদ খাতে ব্যয়ের লক্ষ্য স্থির করা হয়। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সুদ খাতে সরকারের ব্যয়ের বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৯৪ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রথমার্ধেই এ খাতে ৫০ হাজার ২২৩ কোটি টাকা ব্যয় হয়ে গেছে। ট্রেজারি বিল-বন্ড ও বিদেশী ঋণের সুদহার বেড়ে যাওয়ায় অর্থবছর শেষে সুদ খাতে সরকারের ব্যয় ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

ঋণের সুদহার বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি দেশের ব্যাংক খাতে তারল্যের সংকটও তীব্র হয়ে উঠেছে। দেশের আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে (কলমানি) একদিন মেয়াদি ধারের সর্বোচ্চ সুদহার এখন সাড়ে ৯ শতাংশ। সুদহার এত বেশি হওয়া সত্ত্বেও কলমানি বাজারে প্রত্যাশা অনুযায়ী অর্থ মিলছে না। এজন্য ব্যাংকগুলোকে দৈনন্দিন লেনদেন সম্পন্ন করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অর্থ ধার বাড়াতে হচ্ছে। যদিও বাজারে অর্থের সরবরাহ কমানোর কথা বলে নীতি সুদহার (রেপো) কয়েক দফায় বাড়িয়ে ৮ শতাংশে উন্নীত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকগুলো এখন প্রতিদিন ১৫ থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার করছে। দেশের অনেক ব্যাংক এখন রেপোতে ৮ শতাংশ সুদে ধার করে সরকারের ট্রেজারি বিল কিনছে। এর মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অর্থে সরকারকে ঋণ দিয়ে ৩ শতাংশের বেশি মার্জিন পাচ্ছে ব্যাংকগুলো। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঘোষিত মুদ্রানীতির প্রধান লক্ষ্য ধরা হয়েছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। এ কারণে বাজারে অর্থের সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। এরই মধ্যে ব্যাংক ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে সাড়ে ১৩ শতাংশে উঠেছে। সুদহার আরো বাড়লেও সেটি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের স্বার্থে মেনে নিতে হবে। অর্থের সরবরাহ কমে যাওয়ায় জিডিপির প্রবৃদ্ধিও কিছুটা কমে যেতে পারে।

মেজবাউল হক বলেন, ‘‌রেপোতে ধার নিয়ে কোনো ব্যাংক সরকারের ট্রেজারি বিল-বন্ড কিনলে সে ব্যাংক অবশ্যই বিপাকে পড়বে। কারণ রেপোর মেয়াদ সর্বোচ্চ ১৪ দিন হলেও ট্রেজারি বিলের মেয়াদ অনেক বেশি। মেয়াদ সমন্বয় করতে গিয়ে ব্যাংকগুলো তখন ১৩ শতাংশ সুদ দিয়ে হলেও আমানত সংগ্রহ করতে বাধ্য হবে। তবে কোনো ব্যাংক এ ধরনের তৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে কিনা, সেটি খতিয়ে দেখা হবে।’ 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন