দেশের প্রথম চারুকলা বিভাগ স্থাপন হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে

অধ্যাপক ড. ফয়েজুল আজিম চট্টগ্রাম আর্ট কলেজে শিক্ষকতা করেন প্রায় ছয় বছর এবং ১৯৮২ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। ভারতের রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘বাংলাদেশের শিল্পকলায় ঔপনিবেশিক প্রভাব’ বিষয়ে গবেষণা করে পিএইচডি লাভ করেন। ২০১৯ সালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগ প্রতিষ্ঠার ইতিহাস এবং বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দেবব্রত রায়

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা বিষয়টি কীভাবে এল?

ভারতীয় উপমহাদেশ ভাগ হওয়ার পর ঢাকায় প্রথম ১৯৪৮ সালে ঢাকা আর্ট কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়। তৎকালীন পাকিস্তানের এ অংশে এই একটিমাত্র আর্ট কলেজ ছিল। তবে ১৯৬৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর ১৯৬৯ সালে তৎকালীন বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান বিভাগের শিক্ষা কার্যক্রমে প্রথম চারুকলা বিষয়টি সহশিক্ষা কার্যক্রমে যুক্ত করার জন্য প্রস্তাব দেন। মূলত তার একক প্রচেষ্টা ও প্রভাবের কারণেই চারুকলা বিষয়টি বাংলা বিভাগের একটি বিষয় হিসেবে যুক্ত করা হয়। বাংলা বিভাগের একটি বিষয় হিসেবে চারুকলা কোর্স হিসেবে পড়ানো শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে সিন্ডিকেট পাসের মাধ্যমে। সে সময়ে প্রখ্যাত শিল্পী মুর্তজা বশীর কিংবা দেবদাস চক্রবর্তীকে না পাওয়ায় ঢাকা আর্ট কলেজ এবং বুয়েটে ক্লাস নেয়া শিক্ষক রশিদ চৌধুরীকে চারুকলা বিষয়টি পড়ানোর জন্য বাংলা বিভাগের শিক্ষক হিসেবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে আসেন অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান। মূলত চারুকলা বিভাগ প্রতিষ্ঠার জন্য নয়, বরং বাংলা বিভাগের একটি বিষয় পড়ানোর জন্য চারুকলার সূচনা হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। চারুকলার বিষয়ে পরবর্তী সময়ে সব সিদ্ধান্ত নেন রশিদ চৌধুরী। 

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা বিভাগ কীভাবে প্রতিষ্ঠা হয়?

১৯৬৯ সালে বিষয় হিসেবে চারুকলার ক্লাস শুরু হলেও এক বছরের মধ্যেই ১৯৭০ সালে চারুকলা শুধু বিষয় না রেখে একটি বিভাগ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য সরাসরি একাডেমিক কাউন্সিলে প্রস্তাব দেয় বাংলা বিভাগ।  মূলত এই এক বছর সময়ে একটি বিভাগ তৈরি করতে হলে অর্গানোগ্রাম তৈরি, শিক্ষক নিয়োগ, অবকাঠামো নির্মাণ, সিলেবাস প্রণয়নসহ বিভিন্ন ধরনের প্রস্তুতি নেয়া হয়। এ সময় একাডেমিক কাউন্সিলে সম্ভবত ইতিহাস বিভাগের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক অধ্যাপক আবদুল করিম ছিলেন। বাংলা বিভাগের এ প্রস্তাব একাডেমিক কাউন্সিল হয়ে সিন্ডিকেটে সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয় ১৯৭০ সালের আগস্টে। বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে চারুকলা বিভাগ প্রথম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপন করা হয়।

চারুকলা বিভাগে প্রথম দিকে শিক্ষক কারা ছিলেন এবং বিভাগের চ্যালেঞ্জগুলো কী ছিল?

চারুকলাকে বিভাগ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার পর বিদেশ থেকে ডিপ্লোমা করে আসা নাট্যকলা বিশেষজ্ঞ জিয়া হায়দার, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের ভাইয়ের ছেলে মিজানুর রহিমকে নিয়োগ দেয়া হয় শিক্ষক হিসেবে। ১৯৭১ সালের পরে দেবদাস চক্রবর্তী, মুর্তজা বশীরকে নিয়োগ দেয়া হয়। তবে চবির চারুকলা বিভাগ থেকে পাস করা শিক্ষার্থী হিসেবে ১৯৭৪-৭৫ সালে সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ, মনসুরুল করিম, ঢাকা থেকে আবুল মনসুরকে চারুকলা বিভাগে নিয়োগ দেয়া হয়। তবে কলা অনুষদভুক্ত হওয়ায় চারুকলা বিভাগকে শুরুতে নানা সংকটের মধ্যে পড়তে হয়েছে। বাংলা, ইতিহাস, ইংরেজি ছাড়া অন্যান্য বিভাগের পাশাপাশি চারুকলাকেও একই আঙ্গিকে নিয়ে সাজানো হয় অনুষদের নিয়মকানুন। কিন্তু চারুকলা যে আলাদা ধরনের বিভাগ সেটি কেউ মানতে চায়নি। চারুকলা বিভাগে ব্যবহারিক ছিল বেশি। চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থীদের যেমন বড় জায়গাসম্পন্ন ক্লাস প্রয়োজন হতো, কিংবা সাধারণ পরীক্ষা পদ্ধতির মতো পরীক্ষা নেয়া যায় না, এই বিষয়গুলো নিয়ে চারুকলা বিভাগকে অনেক সমস্যার মুখে পড়তে হয়েছে। চারুকলা বিভাগের অনেক পরীক্ষা নিতে পাঁচদিন লাগে, সেখানে বাংলা বা ইংরেজি বিভাগের পরীক্ষা শেষ হতে মাত্র ৩-৪ ঘণ্টা সময় লাগত। ব্যবহারিকের ক্ষেত্রে ছাপচিত্র ছাড়াও বিভিন্ন কাজের জন্য বিভাগে বিভিন্ন কেমিক্যাল বা অ্যাসিড-জাতীয় জিনিসের প্রয়োজন হতো। চারুকলা বিভাগ থেকে এই অ্যাসিড বা কেমিক্যালের চাহিদা যখন অনুষদের ডিন কিংবা অন্যান্য কমিটিকে দেয়া হতো, তখন তারা ভয় পেত কেন এ জিনিসগুলো দরকার হবে বিভাগে। এ রকম বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে অনেক সময় লেগেছে বিভাগের। 

শুরুর দিকে শিক্ষার্থী পাওয়ার যে সমস্যা ছিল সেটির সমাধান কীভাবে করা হয় চারুকলা বিভাগে?

বিভাগের শুরুর দিকে শিক্ষার্থী পাওয়া ছিল বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। কারণ অনান্য বিভাগে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার মাধ্যমে বিভিন্ন বিষয়ে ভর্তি হতে পারত। কিন্তু চারুকলার মতো বিভাগে কোন শিক্ষার্থীরা ভর্তি হবে কিংবা তাদের যোগ্যতা কী হবে সেটা নিয়েই সমস্যার শুরু হয়। কারণ সে সময়ে ঢাকা আর্ট কলেজ থেকে পাস করা শিক্ষার্থী ছাড়া আর কাউকে ভর্তি করা সম্ভব ছিল না। কেননা ঢাকা আর্ট কলেজে মাধ্যমিক পাস করার পর দুই বছরের জন্য শিক্ষার্থীদের ভর্তি করা হতো। এটাকে বলা হতো প্রিডিগ্রি কোর্স। এ কোর্স পাসের পরে সেখানে তিন বছর মেয়াদি ডিগ্রি কোর্স করতে পারত শিক্ষার্থীরা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করতে হবে ঢাকা আর্ট কলেজের প্রিডিগ্রি পাস করা শিক্ষার্থীদের। কিন্তু তারা ঢাকা ছেড়ে চট্টগ্রামের মতো দুর্গম জায়গায় কেন পড়তে আসবে, সেটাই বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। মূলত চারুকলা বিভাগের শিক্ষকদের টানে কিছু শিক্ষার্থী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসত। কিন্তু তাদের সংখ্যা পর্যাপ্ত ছিল না। 

পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন বিভাগ থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা একটু বেসিক শিল্পকলা সম্পর্কে জানে বা মোটামুটি ধারণা আছে এমন জেনারেল লাইনের শিক্ষার্থীরা যদি পরীক্ষায় পাস করে তাহলে তাদের ভর্তি করে নেয়া হতো। তবে শিক্ষার্থী বেশি পাওয়া  যেত না। তখন রশিদ চৌধুরী একটি পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনাটি হলো চট্টগ্রামে স্থানীয় একটি আর্ট কলেজ প্রতিষ্ঠা করা। ১৯৭৩ সালের মাঝামাঝিতে চট্টগ্রামের বাদশা মিয়া রোডে পাকিস্তান আর্ট কাউন্সিলের পরিত্যক্ত ভবনে বেসরকারিভাবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিডিং ইনস্টিটিউট হিসেবে কলেজটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। রশিদ চৌধুরীর পরিকল্পনা ছিল ম্যাট্রিক পাস করে শিক্ষার্থীরা দুই বছরের জন্য চট্টগ্রাম আর্ট কলেজে প্রিডিগ্রি পড়বে। সেখান থেকে বেসিক শিখে পাস করা শিক্ষার্থীরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা বিভাগে সরাসরি ডিগ্রি কোর্সে পড়ার সুযোগ পাবে। পরে ১৯৭৩-৭৪ শিক্ষাবর্ষে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে অনার্স কোর্স চালু করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ১৯৭৫ সালে বিজ্ঞাপন, শিক্ষক নিয়োগ, সিলেবাস প্রণয়ন করে অনার্স কোর্স চালু করা হয়। অনার্স কোর্সে হিস্ট্রি অব আর্ট (পাশ্চাত্য শিল্প ও প্রাচ্য শিল্প), নন্দনতত্ত্ব, টেকনিক অব আর্ট ফিডিং, পেইন্টিং, স্কাল্পচার, ছাপচিত্র, বেসিক ডিজাইন, নাট্যকলা ও সংগীত বিষয় চালু করা হয়। তবে সংগীত বিভাগে শিক্ষক না পাওয়ায় এ বিভাগে শিক্ষার্থী ভর্তি করা সম্ভব হয়নি। মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরবর্তী সময়ে চারুকলা বিভাগ চালু করলেও সেখানে ব্যবহারিক পড়ানো হতো বেশি। কিন্তু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবহারিকের পাশাপাশি থিওরি পড়ানো হতো বেশি। থিওরি বেশ সমৃদ্ধ ছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। 

চট্টগ্রাম আর্ট কলেজে কেন ডিগ্রি চালু করতে হলো?

চট্টগ্রাম আর্ট কলেজের কতিপয় শিক্ষক ও শিক্ষার্থী হঠাৎ আন্দোলন শুরু করল। আন্দোলনে তারা দাবি করল এ কলেজটি কেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিডিগ্রি হিসেবে থাকবে। এ কলেজটিকে প্রিডিগ্রির পাশাপাশি ডিগ্রি কলেজ হিসেবে অনুমোদন দেয়া হোক। এমনকি তারা রশিদ চৌধুরীকে আলটিমেটাম দিল যে তাদের দাবি পূরণ না করা হলে কঠোর অবস্থানে যাবে। কলেজ কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত পাস কোর্স বা ডিগ্রি কলেজ হওয়ার জন্য আন্দোলন করলে তাদের অনুমোদন দেয়া হয় অনেকটা বাধ্য হয়েই। এখন যে কাজের জন্য এই কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয় সেটাই আর থাকল না। পরে ১৯৮৫-৮৬ সালের দিকে এই কলেজ সরকারি করা হয়। সেই সময়ে সরকারের পরিকল্পনামন্ত্রী সম্ভবত এ কে খান সাহেবের সন্তান ছিলেন। তিনি ঢাকা আর্ট কলেজে এক বছর পড়াশোনা করার কারণে তার এই কলেজের প্রতি সফট কর্নার ছিল। তার জন্য তিনি সে সময়ে প্রায় ৫-৬ কোটি টাকা খরচ করে একটা চারুকলা বিভাগ যেমন হওয়া উচিত সেভাবেই অবকাঠামোগত উন্নয়ন, ক্লাস নির্মাণ, বিভিন্ন ফ্যাসিলিটি নিশ্চিত করেন। যেটা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগও করে উঠতে পারেনি সে সময়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বিশেষজ্ঞ ছিলেন, কিন্তু কলেজের শিক্ষকরা অভিজ্ঞ ছিলেন না। সরকারি কলেজ হওয়ার কারণে সেখানকার শিক্ষকরা বিভিন্ন বিষয় থেকে আসতেন, কিন্তু যে চারুকলা শিক্ষার জন্য কলেজ, সেটি সেভাবে পরিচালনা করা সম্ভব ছিল না। সরকারি হওয়ার পরে বিশেষায়িত কলেজটির জন্য যেভাবে শিক্ষাক্রম পরিচালনা করার কথা ছিল সেভাবে করা সম্ভব হয়নি। যার কারণে শিক্ষা কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়ে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন