যে গল্পে ছিল হার না মানার অঙ্গীকার

আজরফ ইসলাম অর্ক

‘‌সিসু’র দৃশ্যে আতামি কোর্পি চরিত্রে জোরমা তোম্মিলা ছবি: আইএমডিবি

কান ফাটানো গুলির আওয়াজ, সাইরেনের শব্দ ক্ষণে ক্ষণে ভেসে আসছে। একটু পরপর চারদিক কেঁপে কেঁপে উঠছে বিস্ফোরণের তীব্রতায়। যতদূর দেখা যায় শুধু গুঁড়িয়ে যাওয়া দালানকোঠা। মাইলের পর মাইল পুড়ে যাচ্ছে আগুনে। এখানে ওখানে পড়ে আছে রক্তাক্ত, ঝলসানো মানুষের লাশ। ইতিউতি চোখে পড়ে আতঙ্কগ্রস্ত যন্ত্রণাকাতর মানুষের ফ্যাকাশে মুখ। সমুদ্রের ওপরে যুদ্ধজাহাজের তাণ্ডব কিংবা উড়ে যায় একের পর এক যুদ্ধবিমান। যুদ্ধভিত্তিক সিনেমার কথা বলা মাত্রই দর্শকের মানসপটে উঁকি দেয় এসব দৃশ্য। জীবনের প্রতিচ্ছবি হওয়া সিনেমার গল্প তখন যেন হয়ে যায় ‘‌লার্জার দ্যান লাইফ’। এসব দৃশ্যের সঙ্গে ভাবগম্ভীর পরিবেশে দীর্ঘ বিরতিতে ছুড়ে দেয়া সংলাপ, টেবিলের ওপর ঝুঁকে ওয়াইনের গ্লাস হাতে চিন্তামগ্ন হর্তাকর্তার আঁকা ষড়যন্ত্রের নীলনকশা, দিকে দিকে আহাজারি আর কান্না দর্শকমনকে সিক্ত করতে পারলেও এ ধরনের সিনেমায় কোথাও কিছু একটা যেন একঘেয়ে হয়ে ওঠে—এ কথা সচেতন দর্শকমাত্রই স্বীকার করবেন। যুদ্ধভিত্তিক সিনেমার যেন টেমপ্লেট হয়ে উঠেছে একটা। ২০২৩ সালে মুক্তি পাওয়া ফিনিশ সিনেমা ‘সিসু’ তাই গতানুগতিকের বাইরে এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রমী উদাহরণ। ইতিহাসকে ছুঁয়ে থাকা অ্যাকশনধর্মী সিনেমা ‘‌সিসু’ নাৎসিদের বিরুদ্ধে এক ভেটেরান সৈনিকের একা হাতে লড়াইয়ের গল্প, তার হার না মানার অঙ্গীকারের গল্প। 

‘‌সিসু’র পটভূমি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফিনল্যান্ড। সিনেমাটিকে বুঝতে সে অস্থির সময়ের ইতিহাসটা একটু জানা দরকার। স্ক্যান্ডিনেভীয় দেশ ফিনল্যান্ড বরাবরই নিজেদের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে বেশ সচেতন। যুদ্ধের ডামাডোলে সে সময় নিজের স্বাধীনতাকে বজায় রাখতে গিয়ে ফিনল্যান্ড পড়েছিল বেশ দুর্বিপাকে। নীতিনির্ধারক দুটো দেশের মাঝে পিষে গিয়ে তাদের ‘‌শ্যাম রাখি না কুল রাখি’ পরিস্থিতি। যুদ্ধের শুরুটা হয় রাশিয়ার বিরুদ্ধে। তবে অবাক করার মতো ব্যাপার হলো আজকের পরাক্রমশালী রাশিয়া তখন ফিনল্যান্ডকে পুরোপুরি পরাস্ত করতে ব্যর্থ হয়। যুদ্ধাস্ত্র, লোকবলের দিক থেকে এগিয়ে থাকলেও শুধু কৌশলগত যুদ্ধবিদ্যা, দানবীয় মনোবলের জোরে রাশিয়াকে সেবার বেশ নাকানিচুবানি খাইয়েছিল ফিনিশরা। ফিনিশরা সেবার রাশিয়াকে প্রতিহত করতে পারলেও রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে তাদের গুনতে হয় বেশ চড়া মূল্য। যুদ্ধে মৃতের সংখ্যা গিয়ে ঠেকে ৮৬ হাজারে। তাদের মধ্যে ততদিনে বেড়ে ওঠে প্রতিশোধস্পৃহা, রক্তপিপাসা। এদিকে জার্মানিতে ঘটেছে হিটলারের উত্থান, ক্রমশ বাড়ছে রাশিয়া-জার্মান দ্বন্দ্ব। অতঃপর শত্রুর শত্রু বন্ধু এ নীতিতে আস্থা রাখতে হয় ফিনিশদের। নরওয়ে দখল করে ততদিনে জার্মানরা ঢুকে পড়ছে ফিনল্যান্ডে। 

‘‌সিসু’র গল্পটার সূচনা ঠিক সে সময়ে যখন জার্মান সেনারা ফিনল্যান্ডে কোণঠাসা হয়ে পড়ায় দ্রুত ফিরে যাচ্ছে নিজ পিতৃভূমিতে। তবে যাওয়ার পথে যতটা সম্ভব ক্ষতি করে দিয়ে যাচ্ছে। শহরের পর শহর গুঁড়িয়ে, জ্বালিয়ে, রক্তের বন্যা বইয়ে দিয়ে যাচ্ছে নাৎসিরা। সে একই সময়রেখায় দেখা যায়, এক বৃদ্ধ গোল্ড-মাইনার নদীতীর ঘেঁষে খুঁজে চলেছেন সোনা। ঘটনাপ্রবাহে তা জার্মান সেনারা জানতে পারে প্রবীণ মানুষটি আতামি কোর্পি, সাবেক ফিনিশ এ সৈন্য এক সাক্ষাৎ যমদূত। এরপরই দর্শকদের জন্য অপেক্ষা করছে টানটান উত্তেজনাপূর্ণ এক রুদ্ধশ্বাস আখ্যান, এক হার না মানা অঙ্গীকারের গল্প।

‘‌সিসু’ শব্দের কোনো আভিধানিক অর্থ খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে সিনেমায় এর মানে হিসেবে দেখানো হয়েছে শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত হার না মানার প্রবণতার কথা, সংকল্পের কথা। প্রকৃত অর্থে, শব্দটি দিয়ে ফিনিশদের অন্যের কাছে মাথা না নোয়ানোর ইস্পাতদৃঢ় মানসিকতাকেই বোঝানো হয়েছে। ফিনিশ ভাষায় একটি প্রবাদ আছে Sisulla siitä selviää, বাংলায় যার অর্থ ‘‌সিসু থাকলে, সবকিছু সম্ভব’। সিনেমার শেষভাগে ফিনিশীয় নারীশক্তির উত্থানের দিকটি লক্ষ করার মতো।

আতামি কোর্পির চরিত্রটি লেখা হয়েছে সিমো হ্যালহা নামের এক কিংবদন্তি ফিনিশ সেনার আদলে। রাশিয়ার সঙ্গে শীতকালীন যুদ্ধের সময় সিমো প্রায় একা হাতে ৫০০ রাশিয়ান সৈন্যকে হত্যা করেন। সিমোকে পৃথিবীর সর্বকালের সেরা স্নাইপার মনে করা হয়। রাশান রেড আর্মি তার নাম দিয়েছিল ‘‌দ্য হোয়াইট ডেথ’। যদিও তাকে হত্যার চেষ্টাও করা হয়েছে অসংখ্যবার, কিন্তু প্রতিবারই মৃত্যুদেবতার আঙুল গলে বেরিয়ে এসেছেন কিংবদন্তি এ যোদ্ধা।

দেড় ঘণ্টার মোট ছয়টি অধ্যায়ে বিভক্ত এ সিনেমা দর্শককে দম ফেলারও সুযোগ দেয় না। ওয়ান-ম্যান-আর্মি ধারার অ্যাকশনধর্মী এ সিনেমায় দেখা মেলে আশির দশকের অ্যাকশন সিকুয়েন্সের। আতামি কোর্পির চরিত্রে জোরমা তোম্মিলার অতিমানবীয় অভিনয়ে যেমন চোয়াল ঝুলে যাওয়ার উপক্রম হয়, তেমনি নাৎসি টিম লিডার ব্রুনোর চরিত্রে আকসেল হানের নিখুঁত অভিনয় মনে ঘৃণার জন্ম দেয়। জেলমারি হেল্যান্ডারের চমৎকার পরিচালনায় সিনেমাটিতে নৃশংসতা, মানুষের অন্ধকারাচ্ছন্ন দিকগুলোর ওপরও আলোকপাত করার চেষ্টা প্রশংসনীয়। অবাক করার মতো বিষয়, যুদ্ধের সিনেমা হলেও এতে সংলাপ খুবই কম। যথোপযুক্ত সিনেমাটোগ্রাফি, আবহসংগীত এক্ষেত্রে তাই খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। সিসু সে কাজ ভালোভাবেই সম্পন্ন করেছে। দাউ দাউ করে পুড়তে থাকা গ্রাম, টেলিফোন পোল থেকে ঝুলতে থাকা পচাগলা লাশ, ধ্বংসপ্রাপ্ত অবকাঠামো থেকে ফিনল্যান্ডের সৌন্দর্যে মোড়া ভূ-প্রকৃতি যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে প্রতিটি ফ্রেমে। যদিও অন্যান্য অ্যাকশন সিনেমার সাধারণ দোষ এড়াতে পারেনি সিসু। কিন্তু অরিজিনাল অ্যাকশনভক্ত ও ভিন্ন দৃষ্টিতে যুদ্ধকে দেখতে চাওয়া দর্শক এ সিনেমায় তাদের মনের খোরাক পাবেন, তা নিশ্চিত।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন