ধ্রুপদকে ভিত্তি ধরে ব্রাহ্ম সংগীত তৈরি করেছিলেন রাজা রামমোহন রায়

মাহমুদুর রহমান

মনি কওলের ‘‌ধ্রুপদ’ থেকে ছবি: মুবি ডটকম, তানসেনকে ধ্রপদ শেখাচ্ছেন স্বামী হরিদাস

শাস্ত্রীয় সংগীত মিশে আছে ভারতের আবহাওয়ায়। মাটিতে আছে কিনা তা নিয়ে তর্ক হতে পারে। কিন্তু বহুকাল ধরে তৈরি হয়েছে এ সংগীত। আজকের দিনে সংগীতকে মনোরঞ্জনের মাধ্যম বা অনুষঙ্গ ধরা হলেও সংগীত নানা কাজেই এসেছে মানুষের। রণসংগীত যেমন উদ্দীপ্ত করে মানুষকে, তেমনি কোনো কোনো সংগীত শীতল করে মন। আবার সংগীতের ধারার মধ্যে কেউ কেউ হয়তো খুঁজে পেয়েছেন সমাজ বদলের চিন্তা। উনবিংশ শতাব্দীতে ভারতে—বিশেষত বাংলায় লেগেছিল সমাজ সংস্কারের হাওয়া। এর অন্যতম কাণ্ডারি ছিলেন রাজা রামমোহন রায়। মজার ব্যাপার, সমাজ সংস্কার ও রাজা রামমোহনের সঙ্গে জুড়ে আছে ভারতের শাস্ত্রীয় সংগীত—বিশেষ করে ধ্রুপদ।

কলকাতার কমল বোসের বাড়িতে প্রতি শনিবার সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত চলত একটি সভা। এর ধারা অনেকটাই ছিল চার্চের মতো। সেখানে ধর্মোপদেশের সঙ্গে আয়োজন হতো সংগীতের। সভায় উপস্থিত থাকতেন সমাজের অভিজাতরা। সে সভার সংগীতের একটি ধারা ছিল ভারতের শাস্ত্রীয় সংগীতের প্রাচীনতম শাখা ধ্রুপদ। পরবর্তী সময়ে ব্রাহ্ম সমাজের প্রার্থনায় যুক্ত হয় সংগীত এবং ব্রাহ্ম সমাজের সভা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে ধ্রুপদের ব্যবহার ছিল। আর সবারই জানা, ব্রাহ্ম সমাজের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রাজা রামমোহন রায়।

রাজা রামমোহন রায় যখন ব্রাহ্ম সমাজ প্রতিষ্ঠা ও সামাজিক সংস্কারের কাজ শুরু করেছেন, সে সময়ই সমান্তরালভাবে বেড়ে উঠছিল ধ্রুপদের চর্চা। এক্ষেত্রে প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিল স্থানীয় নানা এস্টেট ও জমিদারদের সভা। বিষ্ণুপুর, কৃষ্ণনগর ও বর্ধমানের রাজা অন্যতম। এছাড়া কলকাতার নানা অভিজাত পরিবারে এর চর্চা ছিল। এ সময়ই রামমোহন রায় অনুভব করেন দুটো বিষয়কে এক সুতায় গাঁথা সম্ভব। কেননা ধ্রুপদে ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্র ও এর অন্যান্য অনুষঙ্গ ছিল সবার পরিচিত। ধ্রুপদের প্রভাব শাস্ত্রীয় সংগীতে এতই যে এখনো এ নিয়ে গবেষণা হয়, সিনেমা নির্মিত হয়।

রাজা রামমোহন রায় ও ধ্রুপদ নিয়ে জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটির সংগীতের শিক্ষক পার্থ দত্ত বলেন, ‘তার (রামমোহন) আন্দোলনটি ছিল গঠনমূলক ও বিজ্ঞানভিত্তিক দৃষ্টিতে সংস্কার করা এবং এর সঙ্গে যুক্ত ছিল আমাদের ধর্মীয় আচরণ। সে কারণে তিনি অনুভব করেন এখানে নতুন একটি গোষ্ঠী তৈরি করা প্রয়োজন। এতে বুদ্ধিবৃত্তির প্রয়োজন যেমন ছিল তেমনি ছিল সংগীতের। সংগীতকে তিনি গোষ্ঠী তৈরি করার একটি নিয়ামক হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন, যেমনটা করে থাকে চার্চ।’

এ কাজের জন্যই ধ্রুপদকে ভিত্তি ধরে রামমোহন একটি নতুন ধারার সংগীত তৈরি করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন তার অনুসারীরা নিজেদের যুক্ত করতে পারবে এ সংগীতের সঙ্গে। ধ্রুপদকে ভিত্তি ধরে তৈরি করা এ সংগীতই পরে ব্রাহ্ম সংগীত হিসেবে পরিচিতি পায়। রাজা রামমোহন রায় নিজেই প্রায় ৩২টি প্রার্থনা সংগীত রচনা করেছিলেন। আরো একটি কারণে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। রামমোহনই প্রথম বাংলায় ধ্রুপদ লিখেছিলেন। এসব গানে তিনি অধাত্ম্য, সর্বশক্তিমান, বিশ্ব, বিশ্বাস, প্রকৃতির কথা বলেছেন। এরপর সংগীতের ধারা বদলেছে। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি থেকে তৈরি হয়েছে নতুন ধারা। টপ্পা, খেয়াল, ঠুংরি হয়েছে জনপ্রিয় কিন্তু এখনো ‘ভাবো সেই একে’, ‘ভয় করিলে যারে’ ও ‘নিত্য নিরঞ্জন’-এর মতো গানগুলো জনপ্রিয়।

দুই বছর আগে রাজা রামমোহন রায়ের ২৫০তম জন্মবার্ষিকী পালিত হয়েছে। সে সময় তার গানের জগতের প্রতি নতুন করে মন দিয়েছেন গবেষকরা। ধ্রুপদকেই কেন রামমোহন বেছে নিলেন সে বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন গবেষকরা।

মোগলদের পতনের পর উত্তর ভারতের সংগীতকাররা পূর্বের দিকে আসতে থাকেন। বাংলার দিকে একটা বণিক শ্রেণী গড়ে উঠেছিল। সেই সঙ্গে স্বাধীন নবাবির কারণেও গড়ে উঠেছিল একটা ধনিক শ্রেণী। তারা উত্তর থেকে আসা সংগীতকারদের পৃষ্ঠপোষণ করতেন। স্থানীয় জমিদার ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে যথেষ্ট অর্থ এবং অন্যান্য সাহায্য পেয়ে নতুন নতুন ঘরানাও তৈরি হয়েছিল। রামনিধি গুপ্তর হাত ধরে এসেছিল টপ্পা। ওয়াজিদ আলী শাহর সঙ্গে আসা ঠুংরির জনপ্রিয়তা উত্তরোত্তর বেড়েছে। ধ্রুপদের ক্ষেত্রেও তেমনই হয়েছিল। তবে অনেকে মনে করেন ধ্রুপদ আগে থেকেই পরিচিত ছিল বাংলায়। প্রবন্ধ সংগীত ছিল ধ্রুপদের একটি ধর্মীয় ধারা। তবে সত্যিকার অর্থে এটি উনবিংশ শতাব্দীতেই মুসলিম ধ্রুপদ শিল্পীদের হাতে আরো পরিণত হয়েছিল।

রিচার্ড ডেভিড উইলিয়ামস তার ‘দ্য স্ক্যাটার্ড কোর্ট: হিন্দুস্তানি মিউজিক ইন কলোনিয়াল বেঙ্গল’ বইয়ে জানিয়েছেন যে দিল্লির দুই ধ্রুপদ শিল্পী হাসনু খান ও দিলওয়ার খানকে কৃষ্ণনগরের দরবারে ডাকা হয়েছিল। সেখানে তারা ভানুচন্দ্র চক্রবর্তীকে ধ্রুপদ শেখান, যিনি কলকাতার ওস্তাদ রহিম খানের কাছেও শিখেছিলেন। এ সময় রামমোহন রায়ও রহিম খানের কাছে ফার্সি শিখতেন। আর ভানুচন্দ্র দেখেছেন ব্রাহ্ম সমাজের সূচনা এবং শুরুর দিকে ব্রাহ্ম সমাজের সংগীত রচনার ক্ষেত্রে তারও অবদান ছিল।

সংগীত সংগ্রাহক রন্তিদেব মৈত্র এ নিয়ে বলেন, ‘ব্রাহ্ম মঞ্চের জন্য যে গভীর ও সুন্দর সংগীত প্রয়োজন ছিল, রামমোহন তা পেয়েছিলেন ধ্রুপদে। সে কারণেই ভানুচন্দ্র চক্রবর্তীর কণ্ঠে একটি মৌলিক ধ্রুপদ দিয়ে শুরু হতো সভা।’ ব্রাহ্ম সমাজের সভার জন্য প্রয়োজনীয় সংগীতের ধারাটি ছিল ধ্রুপদের মধ্যে। তখন রামপ্রসাদী, ঠুংরি প্রচলিত থাকলেও ধ্রুপদেই তিনি পেয়েছিলেন মূল সুরটি।

সে মূল সুর থেকে ব্রাহ্ম সংগীত তৈরি হলেও এর পরিণতি এসেছিল আরো কয়েক বছর পর। ধ্রুপদ শিল্পী নির্মাল্য দের মতে, রামমোহন রায় যখন ব্রাহ্ম সমাজ শুরু করেন সে সময় প্রার্থনা সংগীতের ধাঁচটি ছিল পুরোপুরি ধ্রুপদের। কেননা ব্রাহ্ম সমাজের যে রূপটি রামমোহন ভেবেছিলেন তার গভীর কিছু ঋজু চরিত্রটির সঙ্গে তিনি মিল পেয়েছিলেন ধ্রুপদের। আর তারপর ব্রাহ্ম সমাজে ধ্রুপদের চর্চার পাশাপাশি প্রার্থনা সংগীত বাংলায় লেখা হতে শুরু করে এবং একসময় ধ্রুপদের হাত ধরেই তৈরি হয় ব্রাহ্ম সংগীত।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন