নভেরা আহমেদ মূলত ভাস্কর। ভাস্কর হলেও তিনি কিছু ছবি এঁকেছিলেন। পাসপোর্টের দরখাস্তে নিজের পরিচয় লিখতেন ‘ভাস্কর ও চিত্রকর’। তার জন্ম ১৯৩৯ সালে, মৃত্যু ২০১৫-তে। দীর্ঘজীবনে তিনি খুব সীমিত সময় কর্মময় থেকেছিলেন। তার সারা জীবনের ভাস্কর্যের সংখ্যা বেশি নয়; চিত্রকর্মের সংখ্যাও সীমিত।
তিনি যে ছবি এঁকেছেন—এ তথ্যটি সুপ্রচারিত নয়। তার চিত্রকর্মের সঙ্গে তেমন কারো পরিচয় নেই। ২০১৭ সাল পর্যন্ত তার আঁকা কোনো ছবি বাংলাদেশে কারো সংগ্রহে ছিল না। ১৯৭৩-এর ২৪ ডিসেম্বর সংঘটিত সড়ক দুর্ঘটনার পর তার সৃজনশীলতা অবসিত হয়ে পড়েছিল। এ স্থবিরতার মধ্যে তিনি ছবি আঁকতে শুরু করেছিলেন। মৃত্যুর সামান্য আগে, ২০১৪ সালে, প্যারিসে তার শিল্পকর্মের একটি রেট্রোস্পেকক্টিভ প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। এর ক্যাটালগে তার আঁকা ৪৪টি ছবির প্রতিচিত্র মুদ্রিত হলে নভেরা আহমেদের চিত্রকর পরিচয়টি আলোচনায় স্থান করে নেয়।
নভেরা আহমেদের আমৃত্যু সঙ্গী মসিউ গ্রেগোয়ার দ্য ব্রুনস তাকে প্যারিস থেকে অনতিদূরে একটি বাড়ি কিনে দিয়েছিলেন। ১৯৭৭ থেকে ২০১৫ সালে মৃত্যু অবধি নভেরা আহমেদ শঁতমেলের ওই বাড়িতেই ছিলেন। ও বাড়িতেই ছিল ফ্রেমে বাঁধানো চিত্রকর্মগুলো: দেয়ালে ঝোলানো কিংবা কোথাও ঢাঁই করে রাখা। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ২০১২-তে আঁকা ‘আত্মা’, ‘স্নান’, ‘কক্সবাজার’ ইত্যাদি। এ সময়ের পর আর কোনো চিত্রকর্ম নেই।
নভেরা আহমেদের চিত্রকর্মের সংখ্যা সব মিলিয়ে ৫০-এর বেশি নয়। নভেরার জন্য হৃদয়ে অপরিমেয় মমতা লালন করেন তার স্বামী গ্রেগোয়ার। স্ত্রীর স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য শঁতমেলের অদূরে শোন নদীর একটি উপশাখার পাশে একটি সংগ্রহশালা স্থাপন করেন তিনি। সেখানেই নেয়া হবে সব চিত্রকর্ম। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর কিনে নিয়েছে ১০টি। ব্যক্তিগত সংগ্রহে আছে তিন-চারটি।
মানুষ, বিশেষ করে নারী, তার চিত্রকর্মের অন্যতম অনুষঙ্গ। কিন্তু তার নারী কোনো ‘ফিগার স্টাডি’ নয়। তার নারী বাঙ্গময়, গল্পময়। শঁতমেলের লিভিং রুমের দেয়ালে ঝোলানো ছবিগুলোয় চোখ বোলাতে গিয়ে আটকে যায় কয়েকটি নারী মুখাবয়বের ওপর। একটি ছবিতে কয়েকটি নারী মূর্তি—দণ্ডায়মান—ঋজু—ওরা সবাই জন্মলগ্নের মতো নগ্ন: তিলমাত্র দেহাবরণ নেই কারো। মাথা থেকে নেমে এসেছে দীর্ঘ কুন্তলরাজি। ওদের স্তন স্পষ্ট টানে আঁকা। কারো সুঠাম নিতম্বে ফুটে উঠেছে যৌবনের অক্ষত দৃঢ়তা। কারো যোনিদেশ নিবিড় কেশাচ্ছাদনে অন্তরাল। প্রেক্ষাপট নিরেট শূন্য; যেন একটি ঘটনাময় প্রেক্ষাপট জুড়ে দেয়ার ইচ্ছা ও কল্পনাশক্তি নভেরা হারিয়ে ফেলেছিলেন।
‘নিঃসঙ্গ’ নামাঙ্কিত প্রথম নগ্ন নারী অবয়ব এঁকেছিলেন তিনি ১৯৮৯ সালে। একাকিনী সেই নারী দণ্ডায়মান, নগ্ন। ঊরুসন্ধি অবধি গাছ-গাছালির আড়ালে পড়ে গেছে। ঊর্ধ্বাঙ্গ নিরাবরণ। সে নারীর চোখে তীব্র দৃষ্টি। এ দৃষ্টি ইনট্রিগ করে। ভাবায়। একই বছর এঁকেছেন ‘স্নান’। নদীতীরবর্তী নগ্ন নারী, ঋজু শালপ্রাংশুদেহ, এক্ষুনি জলে ঝাঁপিয়ে পড়বে। দুই পাশে নিবিড় বৃক্ষ সারি। এ ছবিটিরও নাম ‘নিঃসঙ্গ’ হতে পারত।
এ বছরেই আঁকা আরো একটি ছবির নাম ‘কক্সবাজার’। সমুদ্রতীরে উপবিষ্ট নিরাবরণ পুরুষ, পেছন থেকে দৃশ্যমান, ঋজু ও সুঠাম পৃষ্ঠদেশ, যেন সমুদ্রের অতল জলরাশির দিকে মুখ ফিরিয়ে পদ্মাসনে নিশ্চিন্তে ধ্যানমগ্ন হয়েছেন বুদ্ধ।
১৯৯৫-এ এঁকেছিলেন ‘হিউমানিতে’: মানবতা। আনুমানিক সাড়ে ছয় গুণ সোয়া চার ফুট ক্যানভাসে অঙ্কিত ছবিটি পরিমাপে বৃহত্তম। এ ছবি সমুদ্র উপকূলে সমবেত একগুচ্ছ মানব-মানবীর গল্প। সবাই দিঘলকান্তি, নগ্ন। দূরস্থ দৃশ্যপটে প্রশস্ত লালচে আকাশের নিচে সমুদ্রের নীলাভ বিস্তৃতি; অগ্রভাগে তামাটে বালুকাবেলা। দীর্ঘ কুন্তলরাজি নারীকে পৃথক করেছে পুরুষ থেকে। অভিমানী এক নারী চলে গেছে দূরে, জলের ভেতরে তার পা, যেন নিঃশর্ত কোনো অভিমানে সে সমুদ্রের কাছে আত্মবিসর্জনে উদ্যত; পেছনেই তার নিয়তি-পুরুষ। আর বামে, দূরে, অন্যান্য সঙ্গী-সঙ্গিনীরা যারা ব্যাকুল হয়ে আহ্বান করছে ফিরে আসার জন্য। ওরা ভয়ার্ত ও শঙ্কিত। এক্সপ্রেশনিস্ট শিল্পী নভেরা আহমেদের কাছে কক্সবাজারের সমুদ্র ও সমুদ্রসৈকতের কিছু তাৎপর্য ছিল: সমুদ্র তার কাছে আস্থাযোগ্য সঙ্গী, যার কাছে নির্দ্বিধায় নিরাবরণ হওয়া যায়; সমুদ্র তাঁর কাছে প্রশান্তিকর, যার সান্নিধ্যে নির্ভাবনায় ধ্যানস্থ হওয়া যায়; আবার সমুদ্র তার কাছে ভীতিপ্রদ। কেননা কেউ সমুদ্রের ঢেউয়ে তলিয়ে চিরকালের জন্য হারিয়ে যেতে পারে।
শঁতমেলের লিভিং রুমের যেখানে দোতলায় ওঠার কাঠের সিঁড়ি, তার ডান পাশে ঝোলানো অন্য একটি ছবিতে প্রশস্ত নিরেট সাদা পটভূমিতে তিনটি নারীমূর্তি—দুজনের বাহু থেকে ঝুলছে শরবিদ্ধ বালিহাঁস। নারীত্রয়ীর মস্তক ঊর্ধ্বমুখী। যে সর্ববামে সে স্থির; স্থির মধ্যবর্তিনীও। ডানের নারী—যার চুলে আগুনের আভা এবং যার ডান হাতে এলিয়ে আছে একটি মৃত হাঁস—সে প্রস্থানোদ্যত। প্রস্থানোদ্যত কিন্তু তার গ্রীবা পশ্চাৎনিবদ্ধ—তার দৃষ্টিতে তীব্র ভর্ৎসনার ছাপ নাকি অসহায় প্রতিবাদের নীরব আর্তনাদ তা অনির্ণেয়। এ ছবির অঙ্কনশৈলীতে রয়েছে নিটোল মুনশিয়ানা। ফিগারেটিভ কাজ করতেই অভ্যস্ত যার অঙ্গুলি ও মনন, তারই হাত থেকে তুলির এমন ফটোগ্রাফি মুগ্ধ করে।
প্রকৃতপক্ষে দোতলার কক্ষে, দেয়ালে, সার বেঁধে উঁচুতে ঝুলিয়ে রাখা অন্য একটি ছবিতে নগ্ন নারীর বাম বাহু থেকে ঝুলে আছে দুটি শিকার। তিনজন নয়—এ ছবিতে একজন মাত্র নারী; নগ্ন। হাত থেকে ঝুলছে রক্তাক্ত শিকার, মৃত। নারীর চোখে অদ্ভুত দৃষ্টি। এ দৃষ্টি ইনট্রিগ করে। এ ছবি, ছবিমাত্র নয়—এ ছবি ধারণ করেছে কোনো একটি গল্প, যা দর্শককে কল্পনা করে নিতে হয়। মৃত বালিহাঁস কিসের প্রতীক তা চিন্তার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে।
স্পষ্ট রেখায় অঙ্কিত নারীমূর্তিগুলোর চোখ আয়তাকার, কিছুটা বিস্ফারিত। স্মরণীয়, নভেরার নিজের চোখও ছিল আয়তাকার—কিছু বলার আকাঙ্ক্ষায় টলটল। তবু তো তিনি আমৃত্যু দীর্ঘ সময় নিশ্চুপ থেকেছেন; কারো সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহ বোধ করেননি। কথা বলার জন্যও কাউকে আস্থায় নিতে পারেননি। যিনি ছিলেন আকৈশোর ‘লিবের্টিন’, কোনো এক অদৃশ্য জাঁতাকালের নিষ্পেষণে তিনি ‘মিযানথ্রোপি’র কাছে আত্মসমর্পণ করে মৃত্যুর অপেক্ষায় ছিলেন।
অঙ্কিত মুখাবয়বগুলোর ‘কনট্যুর’ও নজর কাড়ে। ভাবায়। এ তো নভেরার চিবুক! অবিকল পদ্মকলির মতো। শেষ পর্যন্ত এসব মুখাবয়ব তবে নভেরা আহমেদেরই আত্মপ্রতিকৃতি? এসব নারীমূর্তি তবে ধারণ করেছে তার মনস্তত্ত্বে গাঢ় নিবদ্ধ যন্ত্রণা ও ভীতি? এ ভ্রুকুটি তবে নভেরারই অব্যক্ত প্রতিক্রিয়া? চোখের আর্তি তবে নভেরারই অস্ফুট আর্তনাদ? এ ছবিগুলো তবে তারই নিজের অকথিত কাহিনী? তার অজানা গল্প আমাদের পশ্চাদ্ধাবন করে যাবে অনির্দিষ্টকাল যেমন কিনা জঁ-ফ্রাঁসোয়া মিলের ‘অঁজেলুস’ সালভাদর দালিকে তাড়িয়ে ফিরেছিল যতক্ষণ না পর্যন্ত ল্যুভর মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ ক্যানভাস এক্স-রে করে আবিষ্কার করেছিল কফিনের নির্ভুল নকশা। যে বাঙ্ময় মুখাবয়বগুলো তিনি স্পষ্ট রেখায় এঁকেছেন সেগুলোয় অভিলীন রয়েছে ক্ষোভ বা অভিমান—অভিমান না অসহায়ত্ব? অসহায়ত্ব না ভয় তা শিগগির স্পষ্ট হয়ে ওঠে না। ভাস্কর্য যেমন ‘পরিবার’ কিংবা ‘মা ও শিশু’র মধ্যে যে পেলব অনুভূতির অধিব্যাপ্তি—নভেরার ছবিগুলো তার বিপরীত—সেগুলোয় আছে আগুন ও সাপ, ভয় ও অনিশ্চয়তা, ক্ষোভ ও ভর্ৎসনা, অবদমন ও আর্তি। দীর্ঘ কুন্তলরাশি ও যোনিদেশ ব্যতিরেকে সেসব মুখাবয়বে নারীত্ব অনুপস্থিত। আছে নিরশ্রু ক্রন্দনের উত্তাপ, ভীতি ও অসহায়ত্বের অভিব্যক্তি, যেন নভেরার অবরুদ্ধ অস্তিত্ব ও বাকরুদ্ধ যন্ত্রণা হঠাৎ ক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছিল অকস্মাৎ ক্যানভাসের পটভূমে। নভেরা আহমেদের আলোচিত ছবিগুলোর পেছনে আত্মজৈবনিক অনুপ্রেরণা ক্রিয়াশীল ছিল বলে মনে হয়। ‘হিউমানিতে’ ও ‘শিকার’-এর মতো ছবিগুলো তাকে অমর করে রাখবে।
ফয়জুল লতিফ চৌধুরী: কথাসাহিত্যিক ও গবেষক