লাল দলের শিল্পীরা ১২ বছর ধরে পারফর্ম করছেন

সঞ্জয় চক্রবর্ত্তী। ছবি: লাল দল

লাল নামের একটি শিল্পী দলের হাত ধরে ২০১১ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি শুরু হয় পারফরম্যান্স আর্ট আমাদের ভাষা, আমাদের শহীদ শিল্পী দলটির প্রতিষ্ঠাতা সঞ্জয় চক্রবর্ত্তী বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্পকলার ইতিহাস বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কর্মরত। লাল দলের ১২ বছরে পদার্পণসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলেছেন দীপক রায়

লাল দলের শুরু নাম হিসেবে লাল শব্দটিকে কেন বেছে নিয়েছেন?

রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন আমি কৃত্কলার (পারফরম্যান্স আর্ট) আয়োজন করি। এতে অনেক মানুষের সহযোগিতার প্রয়োজন পড়ে। সে সময় কয়েকজন বন্ধু মিলে আমরা পারফরম্যান্সগুলো করতাম। লালদলের শুরুটা এভাবে। নামকরণ নিয়ে বলব, পৃথিবীজুড়ে মানুষের ভাষা, চেহারা, পোশাকের পরিবর্তন হলেও তার রক্তের রঙ লাল। পৃথিবীর সব জাতি-ধর্ম-বর্ণের মানুষ লালকে বহন করে। আমার কাজগুলো যেহেতু জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িত, তাই আমি সবসময় বিশ্বের মানুষের শেকড়ের সম্পর্ককে তুলে আনতে চেয়েছি। জায়গা থেকেই লাল নামকরণ।

বাংলাদেশে আসার পর লালের কার্যক্রম নিয়ে কীভাবে অগ্রসর হন?

কলকাতা থেকে ফেরার পর ২০০৯ সালে আমি নারায়ণগঞ্জে আর্ট কলেজে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে যোগ দিই। আমার এখানকার কয়েকজন শিক্ষার্থীকে নিয়ে বাংলা একাডেমিতে প্রথম আমাদের ভাষা, আমাদের শহীদ নামে কৃত্কলার আয়োজন করি ২০১১ সালে। অংশগ্রহণকারী শিল্পীরা ১২ বছর ধরে একই জায়গায় একই রকমভাবে অংশগ্রহণ করে আসছেন। এসব শিল্পীর মধ্যে সুমনা আক্তার, আবু নাসের রবি, মাহাবুবুর রহমান সুজন, বিমান কর্মকার, সজীব ঘোষ, রূপক রাসেল, বশিরউল্লাহ মজুমদার আলো, মিঠুন মন্ডল, সুবর্ণা বড়ুয়া, আসিফ, জিয়াউর রহমান জয়, শারমিন, সবুজ, সিয়ামসহ আরো অনেকে রয়েছেন।

১২ বছর ধরেই কি একই ধরনের কার্যক্রম নিয়ে অগ্রসর হচ্ছেন? পারফরম্যান্সের মধ্যে কী থাকে?

শুরুর পর থেকে এই পারফরম্যান্স আর্টে সামান্য কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। যেমন বর্ণমালার যাত্রাকে আরো তাত্পর্যপূর্ণ করে তুলতে ২০১৪ সাল থেকে শিশু শিল্পীদের সংযুক্ত করা হয়। তাছাড়া ওই বছর থেকে লাল শিল্পীদলের সঙ্গে সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে আলো স্কুল অব আর্ট সংযুক্ত হয় এবং এখন পর্যন্ত তারা কাজ করে চলছে। মূলত ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে লালদলের শিল্পী-সদস্যরা বাংলা একাডেমির লেখক মঞ্চে একত্র হন। আমাদের ভাষা, আমাদের শহীদ এই কৃত্কলায় নির্দিষ্ট পাঁচজন শিল্পী থাকেন এর কেন্দ্রে। তারা সাদা পোশাক মুখে মুখোশ পরিহিত থাকেন। এই পাঁচজন শিল্পী মূলত পাঁচজন ভাষাশহীদকে উপস্থাপন করেন। তাদের শরীরে থাকে লাল বর্ণমালার বিভিন্ন লকেট স্টিকার। পারফরম্যান্সের প্রথমে তারা লেখক মঞ্চ থেকে বেরিয়ে বাংলা একাডেমির পাঁচ ভাষাশহীদের ভাস্কর্যটি পাঁচবার প্রদক্ষিণ করেন। এর মাধ্যমে তারা ভাষাশহীদের আত্মাকে নিজের মধ্যে ধারণ করেন। এরপর রওনা হন বইমেলার উদ্দেশ্যে। তারপর বর্ণমালার লকেট, স্টিকারগুলো পথের সাধারণ মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দিতে দিতে শহীদ মিনারের দিকে যেতে থাকেন। শহীদ মিনার থেকে আবারো লেখক মঞ্চে ফিরে আসেন সবশেষে।

লাল দলের শিল্পীদের পারফরম্যান্স আর্টের একটি দৃশ্য। ছবি: লাল দল

অংশগ্রহণকারী পাঁচ শিল্পী কি প্রতি বছর পরিবর্তিত হন?

হ্যাঁ। প্রথমবার আমিও ছিলাম পাঁচ ভাষাশহীদের মধ্যে একজন। পরে দেখলাম আমার ছাত্রছাত্রীরা তাদের বন্ধু-সহযোদ্ধা কিংবা ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে আসছেন। তাই প্রতি বছর অংশগ্রহণকারী পাঁচজন শিল্পী পরিবর্তিত হন। তাছাড়া ২০১৪ সাল থেকে আমরা শিশু শিল্পীদের যুক্ত করেছি। তখন থেকে পাঁচজন ভাষাশহীদকে উপস্থাপন করেছে পাঁচজন শিশুশিল্পী।

শিশুদের কেন যুক্ত করলেন?

আমি কিছুদিন ঢাকার একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ড্রয়িং শিক্ষক হিসেবে কাজ করি। সেখানের শিশুদের বাংলা ভাষার ওপর দখলদারত্ব দেখে আমি রীতিমতো চমকে যাই। যে মাতৃভাষার জন্য এত রক্ত ঝরল, এত মিছিল, সমাবেশ, সালাম, রফিক, বরকতের মতো ছেলে হারাল অনেক মাসেই ভাষার এই অবনতি, এতটা দৈন্যদশা! বিষয়টা আমি তখন পৃথিবীর অন্য কোনো ভাষার সঙ্গে তুলনা করতে পারছিলাম না। আবার বাংলা ভাষার প্রাচীন সাহিত্যের অপূর্ব প্রাচুর্যকেও কিছুতেই অস্বীকার করতে পারছিলাম না। কৃত্কলার ভাবনার মানচিত্রটা এখান থেকেই আঁকা।

ভবিষ্যতে আয়োজনটিকে কোন পর্যায়ে দেখতে চান?

শিল্প আসলে কোনো পরিকল্পনা দিয়ে হয় না। মনের আবেগ যখন পূর্ণ হয়ে উপচে ওঠে তখন তা শিল্পীর সৃষ্টির মাধ্যমে প্রকাশ পায়। ২০১১ সালে শুরু হয়ে এটা এখনো চলছে। একজন শিল্পী সবসময় চান তার শিল্প বেঁচে থাকুক। আমিও চাই আমার সৃষ্টিও অনেকদিন বেঁচে থাকবে। আমার কাছে পারফরম্যান্সটি হলো নতুন প্রজন্মের হাত ধরে নতুন সময়ে নতুন করে বাংলা ভাষাকে উদযাপন করা। ১২তম বছরে এসে সাধারণ মানুষের আগ্রহ দেখে এটা বুঝতে পারছি যে আমরা মানুষের হৃদয়ের কাছে কিছুটা হলেও পৌঁছতে পেরেছি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন