লাল-সবুজ গেট পেরিয়ে যাচ্ছি ওপরে ছাদঘরে। দুদিন আগেও একবার ঢাকার এ বাড়িতে আসা, তাই পথ চেনা। সেদিন সন্ধ্যায় শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ ব্যস্ত ছিলেন টেবিল টেনিসে। আজকের ব্যস্ততা রঙ-তুলি-ক্যানভাসে। ওইদিন এসেছিলাম অধ্যাপক, লেখক ও শিল্প সমালোচক মইনুদ্দীন খালেদের সঙ্গে। খেলার ফাঁকে একবার তাকালেন। মিনিট তিরিশ পর জল-ঘাম মুছে গল্পের মেজাজে এসে বসলেন। কথায় কথায় বললেন, ‘তোমরা কেউ দেখোনি আমার ছবি, দেখেছ চার ভাগের এক ভাগ। কুয়েত যুদ্ধের সময় আঁকা ছবিগুলো নেই। বেশির ভাগই এখন আমেরিকায়। অন্য কোথাও দেখাতে পারিনি।’
৩৬টি ছবি নিয়ে প্যারিসে কাজের প্রদর্শনী হয় ১৯৮৩ সালে। সে প্রসঙ্গ ধরে বলেন, ‘দুজন নারী, সম্ভবত আমেরিকান। গ্যালারিতে ঢুকে আমার ছবি দেখে “হরাবল”
বলে বের হয়ে যায়। আমি বিষয়টা বুঝতে গ্যালারির লোক পাঠাই। শুনলাম তারা আমাকে বলেছে “মাচো পেইন্টার”। পরের প্রদর্শনীতে নারীকে বিষয় করে পাঁচটি ছবি আঁকি। যত চেষ্টা করি নারীর ছবি আঁকতে গেলে হয় “প্যাথেটিক”,
না হয় “স্যাড”
ছবি আঁকি। এখন জানি, কেন। এক. আমাদের জন্ম ও বেড়ে ওঠা পুরুষ শাসিত পরিবেশে। দুই. মুক্তিযুদ্ধের সময় নারীদের ভয় পাওয়া চেহারা আমার মনে আছে এখনো। আমি বীরাঙ্গনাদের ছবি এঁকেছি—শোক আবার শক্তি। চিৎকার করার মধ্যেও তফাত আছে—যা পেইন্টিংয়ে তুলে আনাটা কঠিন।’
সেদিন এ পর্যন্ত কথা শুনে ফিরে আসার পর আজ কথার শুরু হলো তার প্যারিসজীবন নিয়ে—
সাক্ষাৎকার গ্রহণে রুহিনা ফেরদৌস
প্যারিসে আপনার দিনের শুরুটা কীভাবে হয়?
আমি সকালে কাজ করি, এখানেও তাই। দিনের আলো আমার খুব প্রিয়।
প্যারিসে শিল্পী ও গ্যালারির মধ্যে সম্পর্ক কেমন, যা আমাদের এখানে নেই?
ওদের গ্যালারিগুলোর এ প্লাস, এ, বি, সি, ডি ক্যাটাগরি আছে। এ প্লাস গ্যালারির সংখ্যা তিন-চারটি। প্যারিসের ম্যাজোঁ দে বোজার্ত গ্যালারিতে শিল্পী ফ্রান্সিস বেকনের কাজের প্রদর্শনী হয়েছিল। সেখানে নিজের কাজ প্রদর্শনের স্বপ্ন ছিল আমার। স্কলারশিপ নিয়ে পড়ছি। প্রতিদিন ওই গ্যালারিতে যাই। গ্যালারির লোকজন আমাকে মোটামুটি চিনে গেছে। ১৯৭৮ সাল। ইতালির এক শিল্পীর কাজ দেখানো হবে। গ্যালারির সেক্রেটারি জ্যঁ পাজে। ঠিক করেছি, আজই তার সঙ্গে কথা বলব। কাছে গিয়ে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমাকে কি একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?’ ও সায় দিলে বললাম, ‘তোমাদের গ্যালারিতে তরুণ শিল্পীদের কাজের প্রদর্শনী করো না? উত্তরে বলল, ‘তুমি তো দেখছই, প্রয়াত মাস্টার আর্টিস্ট আর জীবিতদের মধ্যে বিখ্যাত শিল্পীদের কাজগুলোই আমরা দেখাই।’
খানিক ঘোরাঘুরি করে আমি তাকে আবার জিজ্ঞেস করি, ‘কিন্তু যদি সে তরুণ শিল্পীর কাজ “এক্সট্রা অর্ডিনারি”
হয়?’ এ কথা শুনে ও উৎসাহ দেখায়। জানতে চায় কোত্থেকে এসেছি। এবার ফরাসিতে বলি, আমি এসেছি বাংলাদেশ থেকে, এখানে পড়ছি। সব শুনে ও আমার কাজ দেখতে চাইল।
গ্যালারির মালিক ছিল ক্লোদ বার্নার। প্রথমে আমার কাজের স্লাইড দেখে ওরা। তিনদিন পর তিনটা পেইন্টিংয়ের মূল কপি দেখাতে চায়। নিয়ে গেলাম। আবার তিনদিন পর যেতে বলে। পরে ওদের গ্যালারিতে না, অন্য একটি গ্যালারির নাম লিখে দিয়ে সেখানে প্রদর্শনীর কথা বলল। আমি রাজি হইনি। কাগজ ছিঁড়ে ফেললাম, কিন্তু পরে ছেঁড়া কাগজের টুকরো মিলিয়ে দেখি ওটাও এ ক্যাটাগরির গ্যালারি। কিন্তু না, আমার কাজের প্রদর্শনী এখানেই করব।
আবার গেলাম ছয় মাস পর। নতুন কাজ নিয়ে। এবার ওরা আমার স্টুডিওতে (স্কলারশিপের সময় এখানে থাকতাম) এসে ড্রয়িং দেখতে চায়। আমি বললাম, তিন সপ্তাহ পর আসতে। এর মধ্যে বড় বড় রোল পেপার কিনে চারকোল দিয়ে পুরো সময়টা ড্রয়িং করি। প্যারিসের রাস্তায় লম্বা একটা আয়না পেলাম। আয়নায় নিজেকে দেখি, আর ছবি আঁকি। কিন্তু আমি যা ভাবি আর আমার শরীরের যে আকৃতি তা এক নয়। ফরাসি টেনিস খেলোয়াড় ইয়ানিক নোয়া তখন নামকরা। খেলার সময় ওর শরীরের গতি, চুলের স্টাইল। মারভেলাস! তার ছবি দেখে দেখে আমি স্কেচ করা শুরু করি। গতি আঁকি আর বাকিটা আমি নিজেই। ওই সময় চারকোল দিয়ে আঁকা ‘বুল’ ও ‘হিউম্যান ফিগার’
ছবি দুটো এখন আমাদের জাতীয় জাদুঘরে রাখা আছে।
তিন সপ্তাহ পর কী হলো? ওই গ্যালারিতে প্রদর্শনী করলেন?
আমার গোটা স্টুডিও ভর্তি স্কেচ, ছবি। ওরা এসে তো থতমত। সঙ্গে সঙ্গে গ্যালারিতে টেলিফোন করে। আমার কাজ নিয়ে যেতে চায়। আমি বললাম, না। এখনো শেষ করিনি। পরের দিন কাজ নিয়ে গেলাম। দেখি, গ্যালারির সবকিছু বদলে গেছে। ক্লোদ বার্নার আমার কাজ পছন্দ করল। সে বলল, ‘আমরা তরুণ শিল্পীদের জন্য গ্যালারি করছি মূল গ্যালারির সঙ্গেই।’
সেখানে আরো পাঁচজন তরুণ শিল্পীর সঙ্গে আমার কাজও প্রদর্শিত হবে। এটা শুনে আমার তো ঘুম হয় না।
এদিকে স্কলারশিপের সময় শেষ। আমাকে বাংলাদেশে ফিরে আসার টিকিট দিয়ে দিয়েছে। যা করার এক মাসের মধ্যে করতে হবে। আমি শিল্পী হিসেবে সময় বৃদ্ধির জন্য আবেদন করি। এর মধ্যে আবার প্রদর্শনীর জন্য কাজ করছি। বার্নারের নিউইয়র্ক গ্যালারি থেকে এক বন্ধু (সম্ভবত ওর নাম ছিল মার্ক) এসেছে আমার কাজ দেখতে। ৩৬টা বড় ড্রয়িং। রোল করা কাগজে। গ্যালারির মেঝেতে চারপাশে ছোট ছোট পাথর চাপা দিয়ে আটকে রাখা। ওরা জানতে চাচ্ছে, একটা কাজের জন্য আমার কত চাই। আমার হাতে গ্যালারির চুক্তিপত্র। জ্যঁ আমাকে তা পড়ে স্বাক্ষর করতে বলছে। আমি দোনোমনা করছি। বুঝে উঠতে পারছি না। এমন সময় দেখি বার্নারের বন্ধু পা দিয়ে আমার ছবির ওপরের পাথর সরিয়ে দিচ্ছে, শাঁ করে সঙ্গে সঙ্গে কাগজটা রোল হয়ে যায়। ভীষণ মেজাজ খারাপ হয়। আমি পাথর ঠিক করতে গিয়ে কনুই মেরে বাংলা গালি ছুড়ে দিলাম ‘শালা’। বাকিরা আমাদের এ কাণ্ড দেখেনি। ও সঙ্গে সঙ্গে ওপরে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর টেলিফোন করে বার্নারকে নিয়ে যায়। এরপর জ্যঁরও ডাক পড়ে। মিনিট পনেরো পর জ্যঁ ফিরে এসে আমাকে নিয়ে যায় কফি শপে। ওর চোখ-মুখ বিবর্ণ। একসময় বলে, ‘শাহাবুদ্দিন সরি, বার্নারের বন্ধু তোমার কাজ পছন্দ করেনি!’
তাহলে প্রদর্শনীটা আর করা হলো না—
জ্যঁর সামনে চোখের পানি ধরে রাখলেও সেন নদীর পাড়ে বসে একা একা আমি খুব কেঁদেছিলাম। তবে যেহেতু দুটো কাজ ফ্রেম করা হয়েছে, ওই দুটো প্রদর্শনীতে একদিনের জন্য রেখেছিল ওরা। ওটাই কাজ দেয়। প্রদর্শনীতে সবাই আমার কাজ দুটোর সামনে ভিড় করে, পেশাদার শিল্প সমঝদারদের নজরে পড়ে। বিকালে স্কলারশিপের ওখান থেকে জানতে চাইলে আমি ওদের লিখে দিই, প্রদর্শনী করব। সঙ্গে সঙ্গে আমার আবেদন মঞ্জুর হয়ে যায়। আমার থাকার ব্যবস্থা হয়। কারণ গ্যালারিটি ছিল এ প্লাস। এখন প্যারিসে হাজার হাজার গ্যালারি আছে। কেউ চাইলে টাকা দিয়ে প্রদর্শনী করতে পারে। অনেকেই তো টাকা দিয়ে করে। কিন্তু সত্যিকারের এ, বি, সি ক্যাটাগরি পাওয়া কঠিন। শুধু প্যারিসেই ৪০ হাজার শিল্পী, আর ফ্রান্সে চার লাখ। কঠিন কিন্তু। প্যারিসের পর নিউইয়র্ক। কেউ যদি প্যারিসে প্রদর্শনী না করে, তাহলে ওরা নেয় না।
আপনার ছবির বিষয়বস্তু কিংবা রঙের ব্যবহার নিয়ে কি নতুন করে কিছু ভাবছেন?
আমি আমার রঙের প্যালেট বদলাতে চাই। আগে পেইন্টিংয়ে বেশ হলুদ ব্যবহার করতাম, ইয়েলো কার্ভ, বার্নসিনা, ব্ল্যাক—এখনো এগুলো সবই ব্যবহার করি, কিন্তু আরো নিখুঁত করতে চাই। আমার বেজ রঙ সাদা।
সাদা ব্যবহারের ভাবনাটা কীভাবে?
এ চিন্তাটা আসে প্রথমে সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালি’
দেখে। ১৯ বার ছবিটি দেখেছি। কাশফুল যে এত সুন্দর হয়, জীবনে ভাবিনি। সাদা-কালো তো, মিস্ট্রিয়াস। অন্য রঙগুলো সহজে মিলে যায়। সবচেয়ে বেশি কঠিন কাজ হলো সাদা মেলানো। আমি সব রঙ ব্যবহার করি, এরপর সাদা আনি, এটা অন্যদের মতো নয়। সাদা সেনসেটিভ, একে লালন-পালন করতে হয় সাবধানে। পথের পাঁচালি যদি না দেখতাম তাহলে অন্যভাবে চিন্তা করতাম।
বাংলাদেশে এসে বিভিন্ন গ্যালারিতে গেছেন, কাজ দেখেছেন। রুচি-শিল্পে আমরা কতটা অগ্রসর হলাম?
আরো হতো। একটু বাধাবিঘ্ন ঘটেছে। এগুলো রাজনৈতিক কারণে। আমরা অনেক পিছিয়ে গেছি। একটা স্রোত, আবার ভিন্ন স্রোত—এগুলো করতে করতে সময় নষ্ট হয়ে গেল। ভারতবর্ষের মধ্যে বাংলার এ অঞ্চলটাই সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে নামকরা ছিল। সাহিত্য, সিনেমায় আমরা এগিয়ে ছিলাম। আমাদের ভাগ্য যে জয়নুল আবেদিনকে আমরা গুরু হিসেবে পেয়েছিলাম।
আপনি কি জয়নুল আবেদিনকে সরাসরি শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন?
ঢাকা আর্ট কলেজে ভর্তির আগেই তার সম্পর্কে শুনেছি। শুরু থেকেই জয়নুল আবেদিনকে আমার পছন্দ, অ্যাকসিডেন্টলি না। আর্ট কলেজে ভর্তি হয়ে শুনি তিনি আর এখানে নেই। কিন্তু তিনিই আমার গুরু। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমাকে ডেকেছিলেন। আমি জানতাম তিনি আমাকে ডাকবেন। যেটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বেলায় ঘটেনি, মহাত্মা গান্ধীর ক্ষেত্রে ঘটেনি। বঙ্গবন্ধুর বেলায় ঘটেছে, জয়নুল আবেদিনের ক্ষেত্রে ঘটেছে!