ক্লাস-পরীক্ষা নেই, ‘হোম ডেলিভারি’-তেই মিলছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ

সাইফ সুজন

ঢাকার রমনা বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী অটিস্টিক বিদ্যালয়ের দুজন সিনিয়র শিক্ষক সম্প্রতি উচ্চতর গ্রেড পেতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে ব্যাচেলর অব স্পেশাল এডুকেশন (বিএসএড) ডিগ্রির সনদ জমা দিয়েছেন। সনদে দেয়া তথ্যমতে, বগুড়ার প্রফেশনালস ইউনিভার্সিটি নামে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন চারুকলা ডিপ্লোমা ট্রেনিং ইনস্টিটিউট থেকে ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে তারা দুজনেই ডিগ্রি অর্জন করেছেন।

শুধু তারা দুজন নন, নিউ ইস্কাটন রোডের সুইড ল্যাবরেটরি মডেল স্কুল, দিনাজপুর বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী অটিস্টিক বিদ্যালয় এবং সিলেট বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী অটিস্টিক বিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষকের তথ্য পাওয়া যায়, যারা চাকরিতে উচ্চতর গ্রেড পেতে বিশ্ববিদ্যালয়টি থেকে একই শিক্ষাবর্ষে বিএসএড ডিগ্রি অর্জনের সনদ জমা দিয়েছেন।

যদিও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) সূত্রে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত প্রফেশনালস ইউনিভার্সিটি নামের কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেয়া হয়নি। কোনো ধরনের আইনগত ভিত্তি বা অনুমোদন ছাড়াই সম্পূর্ণরূপে অবৈধভাবে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে বিশ্ববিদ্যালয়টি।

চাকরিতে উচ্চতর গ্রেড পেতে বিশ্ববিদ্যালয়টির সনদ জমা দেয়া এক শিক্ষকের সঙ্গে কথা হয় বণিক বার্তার। তিনি জানান, এক সহকর্মীর মাধ্যমে সেলফোনে চক্রটির সঙ্গে যোগাযোগ হয় তার। একটি মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে টাকা পরিশোধ করে হোম ডেলিভারি-তে সনদটি পেয়েছেন তিনি। এজন্য কোনো ক্লাসে অংশ নেয়া বা কোনো পরীক্ষা দিতে হয়নি তাকে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সোহেল মন্ডল ভোলানাথ পাল নামে দুজন ব্যক্তি বগুড়া শহরের কাটনারপাড়ায় প্রফেশনালস ইউনিভার্সিটি নামের প্রতিষ্ঠান খুলে এর আড়ালে এভাবে সনদ বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন। এর মধ্যে সোহেল মন্ডল নিজেকে পরিচয় দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার এর অধীন চারুকলা ডিপ্লোমা ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক হিসেবে। সোহেল মন্ডলের বসবাস কাটনারপাড়ায়ই।

আরেক ব্যক্তি ভোলানাথ পাল নিজের পরিচয় দেন ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য হিসেবে। জানা গেছে, তার বাড়ি চট্টগ্রামের লোহাগাড়ায়। একটি ওষুধ কোম্পানিতে এরিয়া ম্যানেজার হিসেবে চাকরির সুবাদে বগুড়ায় এসেছিলেন। এরপর সোহেল মন্ডলের সঙ্গে পরিচয়ের সূত্র ধরে সনদ ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হন তিনি।

প্রতিষ্ঠানটির প্রচার করা লিফলেট অনুযায়ী, ব্যাচেলর অব স্পেশাল এডুকেশন (বিএসএড) মাস্টার্স অব স্পেশাল এডুকেশন (এমএসএড), বিএসসি সমমান বিভিন্ন ডিপ্লোমা ডিগ্রিসহ মোট ১৩টি প্রোগ্রাম পরিচালনা করছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। সরজমিনে বগুড়ার কাটনারপাড়ায় বিশ্ববিদ্যালয় তথা ইনস্টিটিউটের ঠিকানায় গিয়ে দেখা যায়, ভাঙাচোরা দশার একটি ভবনের সামনে দেয়ালে কোনো সাইনবোর্ডও নেই। শুধু একটি পোস্টার সেঁটে রাখা হয়েছে। ভবনের সামনে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা হয়েছে ইটের টুকরো। ইটের স্তূপের কারণে ভবনে প্রবেশের একটি দরজা বন্ধ হয়ে পড়েছে। বাইরে থেকে প্রথম দেখায় মনে হবে পরিত্যক্ত কোনো ভবন। পকেট গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশের পর দেখা যায় ভুতুড়ে এক পরিবেশ। ভুতুড়ে ওই ভবনের ঠিকানায় গড়ে তোলা অনুমোদনহীন বিশ্ববিদ্যালয়টিই এখন অর্থের বিনিময়ে সনদ বিতরণ করছে ক্রেতাদের। বগুড়াকে কেন্দ্র করে পরিচালিত নামসর্বস্ব বিশ্ববিদ্যালয়টি এখন চট্টগ্রাম সিলেটেও কার্যক্রম চালাচ্ছে। এখান থেকে টাকায় কেনা সনদ নিয়ে অনেকেই সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত অনেক প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতাও করছেন।

বিষয়ে জানতে চাইলে ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক . বিশ্বজিৎ চন্দ বণিক বার্তাকে বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে পর্যন্ত প্রফেশনালস ইউনিভার্সিটি নামে কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেয়া হয়নি। আইন অনুযায়ী দেশের সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে কমিশনের অনুমতি নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়। নামের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়কে কমিশন থেকে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার অনুমতি দেয়া হয়নি। সুতরাং প্রতিষ্ঠানটির আইনগত কোনো ভিত্তি বা অনুমোদন নেই। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানটি সম্পূর্ণ অবৈধভাবে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

তিনি আরো বলেন, ধরনের প্রতিষ্ঠান পরিচালনার মাধ্যমে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করা হচ্ছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচিত ধরনের প্রতারক চক্রের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া।

সনদ বিক্রির কাজ সহজ করতে প্রফেশনালস ইউনিভার্সিটির নামে এখন একটি ওয়েবসাইটও পরিচালিত হচ্ছে। http://puebd.com/ ঠিকানার ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্য মতে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রফেশনালস ইউনিভার্সিটি ২০০১ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার বিশ্ব মেধা সম্পদ সংস্থা সুইজারল্যান্ডের স্বীকৃতি অনুমোদন পায়। যদিও ইউজিসির ওয়েবসাইটে দেয়া অনুমোদিত ১০৯টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় প্রফেশনালস ইউনিভার্সিটির নাম খুঁজে পাওয়া যায়নি।

অবৈধভাবে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা বিষয়ে জানতে চাইলে সোহেল মন্ডল বণিক বার্তাকে বলেন, আমরা শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন পেয়েছি। আমি রেজিস্ট্রার হিসেবে রয়েছি। অধ্যাপক ভোলানাথ পাল উপ-উপাচার্য হিসেবে রয়েছেন। তিনি এর আগেও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছিলেন। আমরা সাধারণত এক বছরের ডিগ্রিগুলো দিয়ে থাকি। তাই ইউজিসির অনুমোদন নেয়া হয়নি। এজন্যই ইউজিসির ওয়েবসাইটে আমাদের ইউনিভার্সিটির নাম নেই। বগুড়ার পাশাপাশি সিলেট চট্টগ্রামেও আমাদের কার্যক্রম রয়েছে। আমাদের এখানে অনলাইনেও ভর্তি হওয়ার সুযোগ রয়েছে।

চলতি সপ্তাহেই প্রফেশনালস ইউনিভার্সিটি বগুড়া, সিলেট চট্টগ্রামের ঠিকানাগুলো সরজমিনে পরিদর্শন করা হয়। বগুড়ার ঠিকানায় গিয়ে দেখা যায়, ভবনের সামনের পোস্টারে ইনস্টিটিউটকে সরকার স্বীকৃত প্রফেশনালস ইউনিভার্সিটি অধিভুক্ত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, নিচতলার তিনটি কক্ষ নিয়ে কার্যক্রম চলছে প্রতিষ্ঠানটির। তবে কোনো শিক্ষার্থীর উপস্থিতি ছিল না সেখানে। ভবনের ভেতরে কথা হয় ভোলানাথ পালের সঙ্গে। তিনি নিজেকে ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ হিসেবে পরিচয় দিলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য হিসেবে পরিচয় দেননি। তিনি জানান, প্রতিষ্ঠানটিতে বর্তমানে ৫০ জনের মতো শিক্ষার্থী রয়েছেন। এখন নতুন শিক্ষাবর্ষের ভর্তি কার্যক্রম চলছে।

প্রফেশনালস ইউনিভার্সিটির অধীন চারুকলা ডিপ্লোমা ইনস্টিটিউটের সিলেটের কার্যক্রম পরিচালিত হয় সিলেট নগরীর শাহজালাল মডেল স্কুলের একটি অফিস কক্ষে। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, স্কুলটিতে চারুকলা ডিপ্লোমা ইনস্টিটিউটের একটি অফিস খোলা হয়েছে। শাহজালাল মডেল স্কুলের পরিচালক জাবেদ আহমদ চারুকলা ডিপ্লোমা ইনস্টিটিউটের সিলেট প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছেন। তিনি দাবি করেন, সিলেট অফিসের অধীনে ৩০০-৪০০ শিক্ষার্থী রয়েছেন।

তারা কোথায় ক্লাস করেন এমন প্রশ্নের জবাবে জাবেদ আহমদ দাবি করেন, শাহজালাল মডেল স্কুল ক্লাসরুমে তাদের ক্লাস চলে। সময় বণিক বার্তার সিলেট প্রতিনিধি নিজ পরিচয় গোপন রেখে তার এক আত্মীয়ের বিএড কোর্সে ভর্তির ব্যাপারে কথা বললে জাবেদ আহমদ জানান, ২৫ হাজার টাকা দিতে হবে।

ওই শিক্ষার্থীর ক্লাস করতে অসুবিধা আছে জানালে জাবেদ আহমদ জানান, ক্লাস না করলেও চলবে। শুধু টাকা দিলেই এক বছরের মধ্যে সার্টিফিকেট দেয়া যাবে।

এত সময় নেই, আরো আগে দেয়া যায় কিনা জানালে তিনি বলেন, আগামী জুনের মধ্যে বিএড কোর্সের সার্টিফিকেট দেয়া সম্ভব। এজন্য ১৫ জানুয়ারির মধ্যে ১০ হাজার সার্টিফিকেট হাতে পাওয়ার পর বাকি টাকা পরিশোধ করতে হবে।

তিনি দাবি করেন, চাকরিপ্রত্যাশীদের সহযোগিতার জন্যই সিলেটে চারুকলা ডিপ্লোমা ইনস্টিটিউটের অফিস খুলেছেন তিনি।

চট্টগ্রামের বিশ্ববিদ্যালয়টির কার্যক্রম পরিচালিত হয় পাঁচলাইশের অভিজাত সুগন্ধা আবাসিক এলাকায়। নম্বর সড়কের ডি-ব্লকে ১৭০ নং বাড়ির নিচতলার একটি ফ্ল্যাটে অন্য অনেক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুগ্মভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করছে প্রফেশনালস ইউনিভার্সিটি। সম্প্রতি তাদের কার্যালয়ে গেলে সেখানে কোনো ধরনের শিক্ষক-শিক্ষার্থীর উপস্থিতি দেখা যায়নি।

 

প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন চট্টগ্রাম ব্যুরোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সুজিত সাহা, বগুড়া প্রতিনিধি এইচ আলিম সিলেট প্রতিনিধি নূর আহমদ

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন