ঢাকা মেট্রোরেলের অবিচ্ছেদ্য নাম ইতো নাওকি

শামীম রাহমান

দিয়াবাড়ীতে মেট্রোরেলের ডিপোয় বাংলাদেশে নিযুক্ত সাবেক জাপানি রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি। গত বছরের মে মাসে তোলা ছবি: অ্যালামি

দেশের মেগা প্রজেক্টগুলোর বাস্তবায়নে বড় ধরনের ব্যাঘাত ঘটিয়েছিল কভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাব। দীর্ঘ লকডাউন বিধিনিষেধের বেড়াজালে স্থবির হয়ে পড়েছিল দেশ। থমকে গিয়েছিল বিদেশী সহযোগিতায় বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পগুলোর কাজও। কঠোর লকডাউন বিধিনিষেধের মধ্যেও একদিনের জন্য বন্ধ হয়নি ঢাকার প্রথম মেট্রোরেলের কাজ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এক্ষেত্রে সরকারের সদিচ্ছা এবং জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) ঢাকায় নিযুক্ত জাপান দূতাবাসের সহযোগিতা মহামারীর ভয়ভীতি উপেক্ষা করে মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ চালু রাখার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছিল। বিশেষ করে ঢাকায় নিযুক্ত জাপানের তত্কালীন রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকির ব্যক্তিগত আগ্রহ এখানে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় অবদান রেখেছে। অবদান ইতো নাওকির নামটিকে করে তুলেছে ঢাকার মেট্রো ব্যবস্থা সূত্রপাতের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

ইতো নাওকি ২০১৯ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশে জাপানের রাষ্ট্রদূত হয়ে আসেন। সে সময়ে বেশ উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যে যাচ্ছিল দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক পরিবেশ। এর মধ্যে আবার ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর চীনের উহানে শনাক্ত হয় প্রাণঘাতী নভেল করোনাভাইরাস, যা খুব দ্রুতগতিতে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশেও কভিড-১৯-এর প্রথম সংক্রমণ শনাক্ত হয় ২০২০ সালের মার্চ। সংক্রমণ ঠেকাতে ২৬ মার্চ থেকে অনির্দিষ্টকালের সাধারণ ছুটিতে চলে যায় বাংলাদেশ। সময় দেশে চলমান দেশের প্রায় সব উন্নয়ন প্রকল্পই বন্ধ হয়ে যায়। ব্যতিক্রম ছিল কেবল পদ্মা সেতু মেট্রোরেল প্রকল্প।

ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএএন ছিদ্দিকের দাবি, ওই সময় চলমান প্রকল্পগুলোর মধ্যে শুধু মেট্রোরেলেই কর্মী-প্রকৌশলীদের জন্য চালু করা হয় বিশেষ হাসপাতাল। মহামারীর ভয়ভীতি উপেক্ষা করে মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ চালিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে সে সময় সার্বক্ষণিক সহযোগিতা করে গেছেন ইতো নাওকি।

মেট্রোরেল-সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন অনেকেই ইতো নাওকির সে সময়ের ভূমিকাকে এখনো স্মরণ করেন। বাংলাদেশে জাপানের সাবেক রাষ্ট্রদূতের অফিশিয়াল ফেসবুক ওয়ালেও গতকাল অনেকেই মেট্রোরেলের উদ্বোধন উপলক্ষে তাকে অভিনন্দন শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।

২০২১ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের বেশ কয়েকজন ক্রিকেটারকে নিয়ে মেট্রোরেল প্রকল্প পরিদর্শনে যান ইতো নাওকি। সে সময় তিনি মেট্রোরেল সম্পর্কে বলেছিলেন, ঢাকা যে বদলে যাচ্ছে, তার প্রতিচ্ছবি হচ্ছে মেট্রোরেল। মেট্রোরেল জাপানের বিগ-বি উদ্যোগের অংশ এবং এটি বাংলাদেশের ফাস্ট-ট্র্যাক প্রকল্পের অন্যতম। নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণসহ নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পটি বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। ধীরে ধীরে এসব চ্যালেঞ্জ আমরা মোকাবেলা করেছি। প্রকল্পের কাজও এগিয়ে চলছে।

বিগ-বির আওতায় গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করেছে জাপান। মেট্রোরেল ছাড়াও কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে বিদ্যুৎকেন্দ্র গভীর সমুদ্রবন্দর, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণের মতো মেগা প্রকল্পগুলো কর্মসূচির আওতায়ই বাস্তবায়ন হচ্ছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দায়িত্ব গ্রহণের পর গত তিন বছর প্রকল্পগুলোর সঙ্গে অনেকটাই আত্মিকভাবে জড়িয়ে পড়েছিলেন ইতো নাওকি।

মহামারীর ধাক্কা সামলে উঠতে না উঠতেই চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির পর থেকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ফের বিপর্যস্ত হতে শুরু করে বিশ্ব অর্থনীতি। এর প্রভাব পড়ে বাংলাদেশেও। তবে যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে সৃষ্ট সংকটের মধ্যেও ঢাকার প্রথম মেট্রোরেল পরিকল্পনাধীন আরো দুটি মেট্রো প্রকল্পে কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি বাংলাদেশে জাপান দূতাবাস জাইকার সহযোগিতায়। ঢাকার প্রথম পাতাল মেট্রো (এমআরটি লাইন-) নির্মাণের জন্য এরই মধ্যে একটি প্যাকেজের ঠিকাদার পুরো প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়নের জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে প্রকল্পের কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধনের পরিকল্পনা করছে ডিএমটিসিএল। আরেকটি পাতাল মেট্রোর (এমআরটি লাইন-নর্দার্ন রুট) কাজ আগামী বছরের জুনে শুরুর কথা জানিয়েছেন তারা।

বারবার প্রতিকূলতার মধ্যে পড়েও সমানে এগিয়ে চলছে দেশের প্রথম মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ। একই সঙ্গে গুছিয়ে আনা হচ্ছে আরো দুটি মেট্রোর কাজ। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে মেট্রোর কাজকে বেগবান করতে সবসময় জোরালো ভূমিকা রেখে গেছেন নাওকি। যদিও মেট্রোরেলের উত্তরা-আগারগাঁও অংশ উদ্বোধনের আগেই শেষ হয় বাংলাদেশে রাষ্ট্রদূত হিসেবে তার দায়িত্ব। নতুন রাষ্ট্রদূত ইওয়ামা কিমিনোরি স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন তার। গতকাল মেট্রোরেলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জাপানের নতুন রাষ্ট্রদূত বলেছেন, বাংলাদেশে জাপানের সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন