ডাকঘরে স্মার্ট সার্ভিস পয়েন্ট

সম্ভাব্যতা যাচাই,অর্থের উৎস ও সেবার ধরন নির্ধারণ ছাড়াই কার্যক্রম শুরু

আরফিন শরিয়ত

ছবি : বণিক বার্তা

গ্রাহকদের প্রায় ৩২৫ ধরনের সেবা দেয়ার লক্ষ্য নিয়ে দেশের সাড়ে আট হাজার ডাকঘরকে স্মার্ট সার্ভিস পয়েন্টে রূপান্তরের প্রকল্প হাতে নিয়েছে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ। ‘স্মার্ট সার্ভিস পয়েন্ট অব পোস্ট অফিস’ নামের এ প্রকল্প মাস দেড়েক আগে উদ্বোধনও হয়েছে। তবে উদ্বোধনের আগে প্রকল্পের সম্ভাব্যতাই যাচাই করা হয়নি। ঠিক হয়নি বেশির ভাগ সেবার ধরনও। অর্থের উৎসও এখনো নিশ্চিত নয়। অবকাঠামোগত কোনো উন্নয়নও হয়নি। খাতসংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, যথাযথ প্রস্তুতি ছাড়া এ ধরনের প্রকল্প ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

ডাক অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, দেশের ৮ হাজার ৫০০ ডাকঘরকে পোস্ট ই-সেন্টার থেকে স্মার্ট সার্ভিস পয়েন্টে রূপান্তর করা হবে। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে কারিগরি সহায়তায় আছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) অধিদপ্তর। ২০২৫ সালের জুনে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা। গত ১৯ মার্চ খুলনার কয়রা উপজেলায় প্রথম স্মার্ট সার্ভিস পয়েন্ট উদ্বোধন হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডাক অধিদপ্তরের উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘স্মার্ট সার্ভিস পয়েন্ট করতে আমরা মাত্র উদ্যোগ নিয়েছি। খুলনার কয়রায় একটি করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এটুআইয়ের অর্থায়নে কয়রার ডাকঘরটি করা হয়েছে। এ প্রকল্পের কোনো পরিকল্পনা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। অর্থায়নের বিষয়টিও নিশ্চিত নয়। মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা চলছে, সেখান থেকে যে সিদ্ধান্ত আসে তা-ই হবে।’

এ কর্মকর্তা বলেন, ‘এসব সেবা দিতে হলে আমাদের আনুষঙ্গিক সব বিষয়ে স্মার্ট হতে হবে। অবকাঠামো স্মার্ট হতে হবে, পর্যাপ্ত ইন্টারনেট সংযোগ থাকতে হবে, যারা সেবা দেবে, তাদের ব্যবহার মার্জিত হতে হবে। বিষয়গুলো নিশ্চিত না হলে মানুষ আগ্রহ পাবে না।’ স্মার্ট সার্ভিস পয়েন্টে (এসএসপি) অন্তত ৩২৫ ধরনের সেবা দেয়ার কথা রয়েছে। তবে এসব সেবার ধরন এখনো চূড়ান্ত করতে পারেননি প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা। 

এসএসপিতে রূপান্তর হওয়া কয়রা উপজেলা পোস্ট অফিসের পোস্ট মাস্টার মো. অলিউর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আমরা ১০-১২টি সেবা দিচ্ছি। এর মধ্যে পাসপোর্ট, জন্মনিবন্ধন, এনআইডি, নামজারি, খতিয়ানের আবেদন ইত্যাদি সেবা রয়েছে। কিছু মানুষ আসছে। প্রচার-প্রচারণা হলে আরো বেশি মানুষ আসবে।’

প্রকল্পের ব্যাপারে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. মোস্তফা কামাল বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ডাক অধিদপ্তর এ সেবা বাস্তবায়ন করছে। তাদের সঙ্গে আমাদের একটি সমাঝোতা চুক্তি হয়েছে, সেভাবেই আমরা কাজ করছি। এর মাধ্যমে আমরা তিনশর বেশি সেবা দেব। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে মানুষের দোরগোড়ায় সরকারের সেবা পৌঁছে দেয়া যাবে।’ 

২০১২ সালে এসএসপির মতো পোস্ট ই-সেন্টার করার একটি উদ্যোগ নেয় ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ। তবে নানা কারণে সেটি জনপ্রিয়তা পায়নি। পোস্ট ই-সেন্টার প্রকল্পে বরাদ্দ ছিল ৫৪০ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। এর আওতায় জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন ও গ্রাম পর্যায়ে ৮ হাজার ৫০০ পোস্ট অফিসকে পোস্ট ই-সেন্টারে রূপান্তর করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে ইন্টারনেট সেবা পৌঁছে দেয়া, রেমিট্যান্স প্রাপ্তিতে সহায়তা করা, ডিজিটালাইজড ডাকঘর, কৃষি স্বাস্থ্য ও সেবা বিষয়ে তথ্য সরবরাহ, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক কমার্শিয়াল পোস্টাল সার্ভিসের সূচনা, আইটি-ভিত্তিক পল্লী উদ্যোক্তা তৈরি, ইলেকট্রনিক মানি ট্রান্সফার ও পোস্টাল ক্যাশ কার্ড সার্ভিসের মতো নানা সেবা নিশ্চিত করা। 

ডাক অধিদপ্তরের দুজন কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, পোস্ট ই-সেন্টার কার্যক্রমে উদ্যোক্তাদের অনেকেই শেষ পর্যন্ত প্রকল্পের সঙ্গে ছিলেন না। ফলে প্রকল্পটি প্রত্যাশিত সাফল্য পায়নি। এবার যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে উদ্যোক্তা মনোনয়ন দেয়া হবে। এরই মধ্যে ‘একসেবা’ নামে একটি পোর্টাল চালু করা হয়েছে। এর মাধ্যমে উদ্যোক্তাদের আবেদন নেয়া হচ্ছে। এসব আবেদন থেকে সর্বোচ্চ যোগ্যদের বাছাই করা হবে। 

সারা দেশে ৯০০ পোস্ট ই-সেন্টারে নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় (সিজিএ)। নিরীক্ষায় দেখা যায়, এসব সেন্টারের ২০ শতাংশ যন্ত্রপাতি অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। সেন্টারগুলোর ৭০ শতাংশ আসবাবের কোনো অস্তিত্ব নেই।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেকোনো প্রকল্প বাস্তবায়নে দক্ষ জনবল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষ জনবল না থাকলে নতুন প্রকল্পটি সাফল্য পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। 

সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, ‘ডাক অধিদপ্তরের সমস্যা খুবই গভীর। এখানে প্রচুর জনশক্তি আছে, মানুষ আছে, কিন্তু তাদের দক্ষতা নেই। ডাক অধিদপ্তরকে কাজে লাগাতে হলে জনশক্তিকে দক্ষ করে তুলতে হবে। দক্ষ না করে যত উদ্যোগই নেয়া হোক তা ফলপ্রসূ হবে না।’ 

তিনি বলেন, ‘পোস্ট ই-সেন্টার প্রকল্প যখন নেয়া হয়, তখন ডাক বিভাগের জনবল, তাদের সক্ষমতা, কর্মদক্ষতার বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া হয়নি। যে কারণে প্রকল্প শেষ হওয়ার পর লোকবলের অভাবে অনেক যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে যায়, অনেক সেন্টার চালু করা যায়নি। স্মার্ট সার্ভিস পয়েন্টেও বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখতে হবে।’

ডাক অধিদপ্তরের পরিচালক (ডাক) ও এসএসপির আহ্বায়ক মো. জাকির হাসান নূর বলেন, ‘আমাদের পোস্ট ই-সেন্টারগুলো প্রত্যন্ত এলাকা পর্যন্ত পৌঁছে দেয়া হয়েছিল। সেখানে এ সেবা চালানো কিছুটা দুরূহ ছিল। এবার জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ ডাকঘরগুলোয় স্মার্ট সার্ভিস পয়েন্ট বানানো হবে।’

পোস্ট ই-সেন্টার সফল না হওয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘আগে আমরা উদ্যোক্তাদের ফ্যাসিলিটেট করতে পারিনি। এবার আমরা তাদের মেশিনারিজ দেব না, কিন্তু ফ্যাসিলিটেট করব। ডাকঘরে জায়গা প্রদান, সরকারি সাপোর্ট, আইসিটির প্রশিক্ষণ ও নেটওয়ার্কিং ফ্যাসিলিটিজ দেয়া হবে। আশা করি এর মাধ্যমে এসএসপি সেবাকে টেকসই করতে পারব।’

তিনি বলেন, ‘পোস্ট ই-সেন্টারের সঙ্গে এ প্রকল্পের মিল নেই। উদ্যোক্তাদের অনাগ্রহের কারণে ওই প্রকল্পে কিছু সমস্যা তৈরি হয়েছিল। এবার আমরা উদ্যোক্তা খুঁজছি। উদ্যোক্তা হওয়ার মনোভাব, দক্ষতা, সক্ষমতা আছে, এমন মানুষজনকে আমরা খুঁজছি। এখানে কোনো সুপারিশ কাজ করছে না। প্রতিমন্ত্রী মহোদয়ের নির্দেশ, একেবারে নিরপেক্ষ থেকে আমাদের কাজ করতে হবে।’

প্রকল্পের অর্থায়ন সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমরা প্রাথমিকভাবে উপজেলার ডাকঘরগুলোয় এ সেবা চালু করব। এক্ষেত্রে অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য আমাদের কোনো বাজেট প্রয়োজন নেই। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তর ও এটুআইয়ের পাশাপাশি সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আমাদের সহযোগিতা করছে। আমরা আশাবাদী, এ সেবা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে পারব।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন