‘টেম্পারা নিয়ে চূড়ান্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা এখনো চলছে’

শিল্পী সুশান্ত কুমার অধিকারী চিত্ররচনায় ঐতিহ্যবাহী নানা বিষয় পদ্ধতি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আসছেন প্রায় তিন দশক ধরে। তার এই অনুসন্ধিত্সু সৃজন চিন্তার প্রতিফলন চিত্রপটে বহুমাত্রিকতায় প্রকাশ ঘটেছে। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীর এবারের আসরে গ্র্যান্ড পুরস্কারপ্রাপ্ত তিনজন শিল্পীর একজন তিনি

সাক্ষাত্কার রুহিনা ফেরদৌস

আত্ম-উপলব্ধির ভেতর বাহির নামের কাজটি দিয়ে কী বুঝিয়েছেন?

ছবির বিষয়বস্তু তেমন কিছু নয়, অনেকগুলো মুখাবয়ব। আমার মনের গভীরে যে অনুভব-অনুভূতি স্পর্শ করেছে তারই প্রকাশমাত্র। মুখের গড়নে আমার নিজের প্রতিকৃতির প্রভাব হয়তো খুঁজে পাবেন, কিন্তু আমি যে শুধু ব্যক্তি আমি ঠিক তা বলা যাবে তা নয়। এখানে ২১টি চিত্রকর্ম আর দুটি আয়না রয়েছে, যারা এখানে আমার প্রতিকৃতি দেখবেন সঙ্গে আয়নায় তার নিজের অভিব্যক্তিও একবার দেখার সুযোগ পাবেন। অর্থাৎ প্রদর্শন কক্ষে আমার এই ছবির সামনে আমি আপনি উভয়েই উপস্থিত। দর্শক-রসিক সমাজের সবাই যুক্ত হচ্ছেন। এর মধ্যে কয়েকটিতে আমি নিজেই নিজের সঙ্গে কথা বলছি, এটা তো আমরা করি। সৃষ্টি চিন্তার সঙ্গে যুক্ত এমন সবাই বোধ করি করে থাকেন। নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করি আবার নিজেই তার উত্তর খোঁজার চেষ্টা করি। অর্থাৎ আত্ম-কথোপকথন, আবার অন্য একটিতে আছে যেআমার প্রতিকৃতি, চোখে সুদূর দৃষ্টি এবং কাঁধে দুটি হাত আর পেছনে বুদ্ধ রবীন্দ্রনাথের ছবি, অর্থাৎ প্রতিকূল বিপরীত পরিস্থিতিতে তাদের জীবনী লেখা থেকে আশ্রয় নেয়া। একটি ছবিতে দেখবেন আমি ল্যাম্পের আগুনে আঙুল পোড়াচ্ছি, ছোটবেলায় আমরা বোধ হয় কম-বেশি সবাই করেছি, কিন্তু এই বড় বেলায় কেন? অর্থাৎ ধৈর্য সহ্য ক্ষমতা বৃদ্ধি করছি। দেখুন এই ছবিতে আমার হাতে একটি চারাগাছ, এটি রোপণ করা হবে। কেন? আমরা প্রকৃতিকে প্রতিনিয়ত ধ্বংস করছি, ভারসাম্য হারাচ্ছি, তাই তো করোনা আমাদের আক্রমণ করছে। এমন গাছ লাগাতে চাই, যা দিয়ে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করা যাবে। এই ছবিগুলো করোনাকালে আঁকা, তাই সবকটা ছবির মধ্যে অনেক ভাবনার পরোক্ষ প্রত্যক্ষ উপাদান রয়েছে।

কাজগুলোর মাধ্যম সম্পর্কে একটু বলবেন?

এখানে আমি উপকরণ হিসেবে নিয়েছি মাটি, গুঁড়ো রঙ, প্রাকৃতিক আঠা, সহজে পাওয়া যায় কাগজ ইত্যাদি। তেলরঙ, জলরঙ অ্যাক্রেলিক ইত্যাদি রঙে ছবি আঁকা সাধারণত প্রচলিত। প্রাচ্যে পাশ্চাত্যে এক সময়ে এগ-টেম্পারায় ছবি আঁকা হতো, আমি এই ঐতিহ্যকে গুরুত্ব দিয়ে টেম্পারা মাধ্যম নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করি। ডিমের কুসুম দিয়ে আঁকা টেম্পারা চিত্রে ফাঙ্গাস ধরে তাই এর বিকল্প অনুসন্ধান করি। তখন বেলের আঠা, গঁদের আঠা, হরীতকী ভেজানো পানি, নিমপাতা ভেজানো পানি ইত্যাদি ব্যবহার করি এবং এর সঙ্গে বিভিন্ন জায়গার মাটি, পিউরি, অ্যালামাটি, সিঁদুর পাথরগুঁড়ো ব্যবহার করেছি। চিত্রতল হিসেবে ব্যবহার করেছি কাগজের বোর্ড পেপার। আমি চেষ্টা করেছি আমার স্বদেশ, পরিবেশ, আমার অঞ্চলের সহজপ্রাপ্য উপাদান সমকালের সঙ্গে যুক্ত করতে।

বর্তমানে কী ধরনের মাধ্যম নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন?

বলতে পারেন টেম্পারা নিয়ে চূড়ান্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা এখনো চলছে। এর আগে জলরঙ ধৌত বা ওয়াশ পদ্ধতির সঙ্গে ওপেক রঙ মিশ্রণ করে ছবি এঁকেছিলাম। নাম দিয়েছিলাম জলরঙ ওয়াশ-টেম্পারা পদ্ধতি। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে বনলতা সিরিজের প্রদর্শনী হয়। এর আগে কাজ করেছিলাম ক্যানভাসে অ্যাক্রেলিক রঙ দিয়ে কীভাবে ওয়াশ পদ্ধতির আবহ আনা যায়, সম্পূর্ণ সফল হওয়া সম্ভব হয়নি। সম্প্রতি কলাকেন্দ্রে আমার ৮২টি টেম্পারায় আঁকা সাতটি ছাপচিত্র নিয়ে একক প্রদর্শনী হয়। দর্শকের কাছে সেগুলো আকর্ষণীয় লেগেছে। ছাপচিত্রের কিছু পদ্ধতি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার আগ্রহ হচ্ছে। দেখা যাক...

আপনার শিল্পী হয়ে ওঠার গল্পটা কেমন?

আমার তো নড়াইলের চিত্রাপাড়ে জন্মগ্রহণ করেছি, বাবা গান-বাজনার লোক ছিলেন, তাই গানের সূত্র ধরে শিল্পী এসএম সুলতান আমাদের বাড়িতে আসা-যাওয়া করতেন। তার কাছে আমার বড়-দা বলদেব অধিকারী ছবি আঁকা শিখেছেন। সেই ছেলেবেলায় আমারও ছবি আঁকার হাতেখড়ি এসএম সুলতানের কাছে। এরপর খুলনা আর্ট কলেজে প্রি-বিএফএ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা থেকে প্রাচ্যকলায় বিএফএ ডিগ্রি নিই। এরপর ভারত সরকারের আইসিসিআর বৃত্তি নিয়ে বিশ্বভারতী শান্তিনিকেতনে এমএফএ করি। ১৯৯৮ সালে বর্তমান চারুকলা অনুষদের প্রাচ্যকলা বিভাগে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে যুক্ত হয়ে কর্মজীবন শুরু করি। দুই বছর পর ২০০১ সালে রাজশাহী চারুকলা বিভাগে প্রভাষক পদে যোগ দিই। শিক্ষাছুটি নিয়ে আইসিসিআর বৃত্তি নিয়ে (২০০৫-২০১০) পুনরায় বিশ্বভারতীতে পিএইচডি পর্যায়ে গবেষণা করি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক পদে উন্নীত এবং প্রায় ২১ বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা নিয়ে বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাচ্যকলা বিভাগে অধ্যাপক পদে কর্মরত আছি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে শান্তিনিকেতনের সাদৃশ্য আছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও চর্চার সঙ্গে সাদৃশ্য থাকলেও শিল্প-সংস্কৃতির চিন্তায় বৈসাদৃশ্য অনুভব করেছি। অনেক বৈরী পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছি, মোকাবেলা করেছি কখনো ব্যর্থ হয়েছি। শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত গতবারের জাতীয় প্রদর্শনীতে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার, চীন দেশে আয়োজিত আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে পুরস্কার এবং এ বছরের দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে গ্রান্ড পুরস্কার প্রাপ্তির ছবিগুলোই শিল্পী হয়ে ওঠার স্বীকৃতি ধরে নিতে পারি। রাজশাহীতে অবস্থানকালে এবং জীবন চলার কঠিন বাস্তবতার ভাবনায় ওই ছবিগুলো এঁকেছিলাম।

নিরীক্ষাধর্মী কাজ ঘিরে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?

আমাদের এখানে অধিকাংশজনে মূর্ত, বিমূর্ত, আধা-বিমূর্ত ইত্যাদি আঙ্গিকে ছবি আঁকেন, আমি কোনটার মধ্যে পড়ি বলতে পারব না। আমার ঐতিহ্য পরম্পরা এই ভাবনাই ছবির মাধ্যমে তুলে ধরতে চাই। শিল্পভাষায় অতীত বর্তমান যুক্ত করে সমকালের সঙ্গে নিজেকে একত্রিত করে আগামী পথ পরিভ্রমণ করতে চাই, যেখানে আমাকে-আমাদের খুঁজে পাওয়া যাবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন