‘জয়নুল লোকশিল্পের প্রভাবটা রেখে গিয়েছেন’

শিল্পী সুমন ওয়াহিদ, ব্রাইড উইথ আ মিরর, জয়নুল আবেদিন

গ্যালারি চিত্রকে চলছে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের কাজ চিত্রকর্ম নিয়ে প্রদর্শনী সংগ্রাম প্রদর্শনীটি কিউরেট করেছেন শিল্পী সুমন ওয়াহিদ শিক্ষকতা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের কাজ, চিত্রকর্ম আধুনিকতাকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যালোচনা করেছেন জয়নুল গবেষক। সাক্ষাত্কার রুহিনা ফেরদৌস

গবেষণার জন্য শিল্পী জয়নুল আবেদিনকে কেন বেছে নিলেন?

২০১৪ সালে যখন চারুকলা অনুষদে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করি, তখন জয়নুল শতবর্ষ উদযাপিত হয়। সেমিনারে জয়নুুল আবেদিনের বিষয়ে প্রবন্ধ পাঠের দায়িত্ব পড়ে আমার ওপর। তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। তাদের কাছে প্রচুর ম্যাটেরিয়াল আছে। আমার কাজের প্রথম ধাপটা ছিল একজন শিল্পীর দৃষ্টিকোণ থেকে তার অবদান তুলে ধরা। ২০১৪-১৮ সাল পর্যন্ত কাজ করি। জয়নুলের উপনিবেশবিরোধী অবস্থান কাজ নিয়ে একক প্রদর্শনী করি টু জেড জয়নুল নামে। মূলত একজন শিল্পী হিসেবে আমি তাকে অন্বেষণ করছি। কাগজে-কলমে কাজের সূচনা এভাবেই।

নতুন করে তার সম্পর্কে কী আবিষ্কার করলেন?

করোনার সময় আমরা সবাই যখন অনেকটা গৃহবন্দি অবস্থায়, তখন ময়নুল আবেদিন (জয়নুল আবেদিনের পুত্র) যাকে আমরা মিতু ভাই বলি, তিনি তখন জয়নুলের নতুন অনেক শিল্পকর্ম, চিঠি, লেখা ইত্যাদি খুুঁজে পান। জানুয়ারিতে কলাকেন্দ্রে তা নিয়ে প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। বিষয়বস্তু ছিল লোকশিল্প ঐতিহ্যের সঙ্গে জয়নুল আবেদিনের সম্পর্ক এবং কীভাবে তিনি আমাদের স্থানিক আধুনিকতার সূচনা করতে চেয়েছেন। ১৯৫১ সালে তিনি লন্ডনের স্লেড স্কুল অব ফাইন আর্টে পড়তে যান।

শোনা যায় ইউরোপ থেকে ফিরে এসে তিনি ফোক মোটিফ নিয়ে কাজ শুরু করেন

সাধারণ মানুষের প্রতি একাত্মতার প্রেরণা তিনি আগেই ধারণ করতেন। অতুল বসু, হেমেন মজুমদারও ময়মনসিংহের। তারা কলকাতায় গিয়ে সেখানের পরিবেশ আবহের সঙ্গে মিলিয়ে শিল্পচর্চা করেছেন। অবিভক্ত বাংলায় দুটো সংস্কৃতি ছিল। এক. পূর্ব বাংলার কৃষকের সংস্কৃতি। দুই. কলকাতার বাবু সংস্কৃতি। তারা বাবু সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে গিয়েছেন, কিন্তু জয়নুল আবেদিন কলকাতায় থেকে কখনই বাবু সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠতে চাননি। তার প্রিয় ছিল বাংলার কৃষকের সংস্কৃতি। ছবি আঁকার ধরনে তিনি ব্রিটিশ একাডেমিক স্টাইল পুরোপুরি অনুসরণ করেননি। কলকাতা গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলে সরাসরি প্রকৃতি থেকে দেখে আঁকার চর্চাগত সীমাবদ্ধতা ছিল, শান্তিনিকেতন যে ঘাটতি পূরণ করে। জয়নুল বলতেন, নৌকায় বসে নদীকে অনুভব না করলে নদীর পানিটা আঁকা যায় না। অঞ্চলের সংস্কৃতি, মাটির সংস্কৃতির প্রতি তার টান ছিল গভীর। সে কারণে ১৯৪৭ সালে  ঢাকায় ফিরে আসেন। ততদিনে দুর্ভিক্ষের ছবি এঁকে বিখ্যাত তিনি, শিক্ষকতা করছেন। চাইলে কলকাতায় থেকে যেতে পারতেন। এরপর ইউরোপে গিয়ে তিনি আঁচ করতে পারেন আধুনিকতা তখন কোন ভাষাকে গ্রহণ করছে। কিউবিজমের বিকাশ ঘটছে, যার বড় উৎস ছিল আফ্রিকার আদিবাসী শিল্পচর্চা এবং এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের শিল্পকলা। থেকে নানাকিছু নিয়ে পশ্চিমারা তাদের ভাষায় তাদের আধুনিকতার বিকাশ ঘটিয়েছে। জয়নুল উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন নিজ সংস্কৃতি মূল ভিত্তিকে ধারণ করে আধুনিকতার দিকে অগ্রসর হতে হবে। তিনি স্লেডে যখন পড়তে যান, তখন সেখানে শিক্ষকতা করছেন খ্যাতনামা আর্ট হিস্টোরিয়ান আর্নস্ট গমব্রিচ। আমার ধারণা, জয়নুল তার ক্লাসও পেয়েছেন। কেননা তার স্কেচ খাতার মধ্যে কিউবিজম কিংবা পিকটোরিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজের বিকাশবিষয়ক সাজেশনগুলো রয়েছে। আমাদের মাটির পুতুলের ফর্মের যে সরলীকরণ, আর পশ্চিমের জ্যামিতিক আদল, যার সূত্র ধরে কিউবিজমের বিকাশ ঘটেছে; কিংবা আমাদের ট্যাপা পুুতুলের যে গড়ন, সবকিছুকে মিলিয়ে জয়নুল আবেদিন নানা ধরনের খসড়া করেছেন। পাইন্যার মাসহ পঞ্চাশের দশকে তার সিরিজ কাজগুলোয় আমরা তা দেখতে পাই। লন্ডনে বসে তিনি লোক মোটিফ নিয়ে কাজ করছিলেন। এরপর দেশে ফিরে এর ওপর বেশকিছু কাজ করেন।

পটুয়া কামরুল হাসানও তো ফোক মোটিফ নিয়ে কাজ করেছেন।

হ্যাঁ, কামরুল হাসান লোকশিল্পকে অনুপ্রেরণা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। লন্ডন থেকে ফিরে জয়নুল আবেদিন বিপুল উৎসাহে ধরনের কাজ শুরু করেন। নতুন ধরনের দিশা খুঁজে পাচ্ছেন নিয়ে কামরুল হাসানের লেখাও রয়েছে।

কিন্তু জয়নুল তো খুব বেশিদিন এটা নিয়ে কাজ করেননি।

পঞ্চাশের দশকে জয়নুল লোকশিল্পের অনুপ্রেরণায় তার আঙ্গিককে বিকশিত করেন, তবে তা বেশিদিন অব্যাহত রাখেননি। তিনি মূলত পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি অবধি ফোক মোটিফের ওপর কাজ করেছেন। তার পরবর্তী কিছু কাজের মধ্যেও এর ছাপ ছিল। ফোক মোটিফ নিয়ে তিনি যে বড় কোনো কাজে গিয়েছেন তা নয়, বেশির ভাগ কাজই ছোট আকারের। পর্যায়ে আমার মনে হয়, তখন তিনি তার ফোক স্টাইল ঘিরে অনেকের উৎসাহ পাননি। তার শিক্ষার্থীরা যারা বিদেশ থেকে পড়াশোনা করে ফিরেছেন, তাদের কাছ থেকেও ভালো সাড়া পাননি। এতে হয়তো তার নিজের মধ্যেও দ্বিধা কাজ করেছে বলে আমার ধারণা। আবার তার স্কেচ খাতায় আমরা দেখি যে বাঁকানো রেখা দিয়ে লম্বাটে মুখ আঁকার টানটা ঘিরে তিনি অজস্র স্টাডি করেছেন; লোকশিল্পীরা যেমন একটানে কাজটি করে। থেকে আমরা তার ওই জার্নিটাকে অনুভব করতে পারি।

নতুন প্রজন্মের জন্য জয়নুলচর্চা কতটা গুরুত্বপূর্ণ?

শিল্পী সফিউদ্দীন আহমেদও ফোক ফর্ম নিয়ে কাজ করেছেন। আর্ট ইন পাকিস্তান ম্যাগাজিনে তার ধরনের কাজ রয়েছে। তার মানে জয়নুলের চর্চা কামরুল হাসানকে তো অবশ্যই, অন্যদেরও অনুপ্রাণিত করেছে। কামরুল হাসান সারা জীবন এটা নিয়ে কাজ করেছেন এবং ধরনটাকে পরিণত জায়গায় নিয়ে যেতে পেরেছেন। পাশাপাশি কাইয়ুম চৌধুরী রশিদ চৌধুরীকেও আমরা দেখি জয়নুলের অনুপ্রেরণা নিয়ে কাজ করতে। জয়নুল লোকশিল্পের ধরনটা নিয়ে বেশিদিন কাজ করেননি, কিন্তু প্রভাবটা রেখে গিয়েছেন। তাছাড়া তার পরবর্তী কাজে মুখের ওই গড়ন কিংবা তিনি যখন নারী অবয়ব আঁকছেন সে ধরন রয়ে গিয়েছে। এখন আমরা তার ধরনের কাজগুলোকে অনেক বেশি স্বীকৃতি দিচ্ছি, আধুনিক বলছি। কিন্তু সে সময়ে তার সমসাময়িক যারা, তারা যে খুব বেশি গ্রহণ করেছেন তা নয়। তার যেসব শিক্ষার্থী ইউরোপে পড়াশোনা শেষ করে ফিরে আসেন, তারা কয়েকটা কারণে জয়নুলকে আধুনিক বলতে চাননি। কারণ তার কাজগুলো ছিল অনেক বেশি রেখাপ্রধান। এখন আমরা সমকালীন চর্চায় আর ধরনের বিচার-বিশ্লেষণ করি না যে এটা পেইন্টিং না ড্রইং হচ্ছে। কিন্তু একটা সময় মাধ্যম প্রচণ্ডভাবে আধিপত্য বিস্তার করেযেমন তেলরঙ খুব প্রসিদ্ধ আবার পেনসিলে আঁকা ছবি বা জলরঙের গুরুত্ব কম। জয়নুল যেহেতু তেলরঙে বেশি কাজ করেননি, ড্রইং বেশি করেছেন, সেখান থেকে তার শিক্ষার্থীরাই তার সমালোচনা করতে শুরু করেন যে জয়নুল আধুনিক নন বা শিল্পের আধুনিকতার সঙ্গে তিনি আত্মস্থ হতে পারছেন না ইত্যাদি।

ভবিষ্যতে শিল্পাচার্যের কাজগুলোকে কোথায় নিয়ে যেতে চান?

জয়নুলের কাজগুলো আন্তর্জাতিক পরিসরে পৌঁছানো দরকার। তার অনেক লেখা, ভাষণ, চিঠিপত্র আমরা পেয়েছি, যেগুলো অনুবাদের মাধ্যমে আন্তর্জাতিকভাবে তুলে ধরা প্রয়োজন। তার পুরো কাজের বাংলা ইংরেজি সংস্করণ নিয়ে আমরা ভাবছি। পাশাপাশি এর ইতিহাস, প্রক্রিয়া গবেষণাসবকিছুকে যদি একটা যাত্রা বা গতিপথের মধ্যে নিয়ে আসতে পারি, তাহলে আমরা জয়নুলকে আরো বেশি অনুধাবন করতে পারব। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন