বাংলা রোমান্টিক কমেডির অন্য দিগন্ত

মাহমুদুর রহমান

সিনেমার পোস্টার থেকে ছবি: এনজেল ডিজিটাল

একালে এসে রোমান্টিক কমেডি বা ‘‌রম-কম’ বিশ্বজুড়ে দারুণ জনপ্রিয়। প্রেম ও হাস্যরসের যুগলবন্দির গল্পগুলো দর্শক গ্রহণ করে সহজেই। তবে রোমান্টিক কমেডি মানেই নিছক লঘু কোনো সিনেমা নয়। অনেক সময়ই হাস্যরসের মাধ্যমে সমাজের গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয় তুলে আনা হয়। সেখানে রাজনীতি বা সমাজের জটিলতর বিষয়গুলোই আনা হবে এমন নয়, তবে মূল গল্পের পরতের তলায় থাকে আরো কিছু বিষয়। ঠিক সে ধারায়ই বাংলা সাহিত্যে এক সময় রচিত হতো গল্প ও উপন্যাস। বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের জুড়ি নেই এ জনরায়। বহু ‘‌স্যাটায়ার’ রচনা করেছেন তিনি। আর বাংলা সিনেমায় রোমান্টিক কমেডির অন্য দিগন্ত তৈরি করেছিলেন তরুণ মজুমদার। বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় ও তরুণ মজুমদারের যুগলবন্দিতে তৈরি হয়েছিল ‘‌শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’।

পশ্চিমবঙ্গে তখন সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেনরা ‘‌সিরিয়াস’ সিনেমা করছেন। তরুণ মজুমদার সে পথে হাঁটলেন না। কশাঘাত না করে তিনি মানুষের ‘‌ব্রিদিং স্পেস’ তৈরি করলেন, কিন্তু সেখানেই থাকল অনেক সিরিয়াস বিষয়। শ্রীমান পৃথ্বীরাজ এ ধারায় একটি অনবদ্য সংযোজন। গল্পটা খুব সরল। এক দস্যি কিশোরের দুর্দান্ত কাজের কারণে বাবা তার বিয়ের বন্দোবস্ত করে। কিশোরের সঙ্গে কিশোরীর প্রথম প্রেম, দাম্পত্য গড়ে ওঠার মুহূর্ত, নতুন জীবনে প্রবেশের পথে পুরনো জীবনের হাতছানি। কিন্তু এর পাশেও থাকে আরো নানা বিষয়। সেগুলো মূল গল্পের পাশে হাস্যরসের মাধ্যমে এমনভাবে উপস্থাপিত হয়েছে যে প্রথম দেখায় তা চোখে পড়ে না। কিন্তু মনোযোগী দর্শকের চোখে তা ঠিকই পড়বে।

প্রথম বিষয়টি মূলত কৈশোরের দস্যিপনা এবং সেই সঙ্গে কৈশোরের নায়কের কথা। রসিকলালের (অয়ন ব্যানার্জী) প্রিয় ঐতিহাসিক চরিত্র পৃথ্বীরাজ চৌহান এবং রসিকও তেমন হতে চায়। কিন্তু যথেষ্ট ভূসম্পত্তির মালিক হলেও তার বাবা চায় ছেলেকে শিক্ষিত করতে। সেখান থেকেই পুরনো বাঙালি রীতিতে ছেলেকে থিতু করতে বিয়ের বন্দোবস্ত করে। অমলাবালার (মহুয়া রায়) সঙ্গে বিয়ে হয় রসিকের কিন্তু রসিকের দস্যিপনা কমে না। আবার এর মধ্যেই দানা বাঁধতে শুরু করে প্রেম। বদলে যেতে শুরু করে জীবনযাপন। মূল গল্পের পাশেই উপস্থাপিত হয় উপনিবেশকালের ভারতীয় বাঙালির মানসিকতা। উৎপল দত্তের পান্নালাল রায় চৌধুরী চরিত্রটি এর প্রতিভূ। তিনি রায় বাহাদুর খেতাব চান এবং তার জন্য যা করা প্রয়োজন তা করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

তরুণ মজুমদারের এ সিনেমার মধ্য দিয়েই অভিষেক হয় অয়ন ব্যানার্জী ও মহুয়া রায়ের। চমৎকার অভিনয় করেছেন দুজনেই। সরস্বতী নামে অমলার বান্ধবী (বা শুভাকাঙ্ক্ষী বড় বোন) চরিত্রে অভিনয় করেছেন সন্ধ্যা রায়। তার মধ্য দিয়ে এসেছে বিরহী নারীর যাতনা ও স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতা। এটি বাঙালি সমাজের একটি সাধারণ ও প্রচলিত বিষয় ছিল। অতিথি চরিত্রে অভিনয় করেছেন বিশ্বজিৎ চ্যাটার্জি। অখিল চরিত্রে তিনি একজন স্বদেশীর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। অখিল স্বরস্বতীর স্বামী। পালিয়ে বেড়ানোই তার জীবন। একবার বাড়ি ফিরে এলে তাকে ধরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে অমলার বাবা কিন্তু রসিক তাকে বাঁচিয়ে দেয়।

পান্নালালের সঙ্গে ম্যাজিস্ট্রেটের যোগাযোগ, অখিলকে ধরিয়ে দেয়ার চেষ্টা প্রভৃতি ভারতের সে সময়ের সুবিধাভোগী উচ্চবিত্ত শ্রেণীর পরিচয়। আবার অখিলের মধ্যে পৃথ্বীরাজের প্রতি আগ্রহ, অখিলকে বাঁচিয়ে দেয়ার ব্যাপারগুলো জাতীয়তাবাদী চেতনার ছায়া। তবে তরুণ সেখানে তীব্রতায় যাননি, যেমন যাননি মূল লেখক বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়। তিনি কেবল মানুষের মনোভাবের বিষয়টি তুলে ধরেছেন। অখিল যেমন স্বাধীনতা চায়, পান্নালাল চায় তার নিজের স্বীকৃতি। কিন্তু পান্নালাল তথাকথিত ‘‌ভিলেন’ নয়। রায়বাহাদুর হওয়া তার একটি শখের মতো, কেননা এতে তার আভিজাত্য বাড়বে।

উৎপল দত্ত বরাবরের মতোই তার অভিনয়ের কমিক রিলিফের জায়গায় দুর্দান্ত। দস্যি ছেলের বাবার চরিত্রে দারুণ অভিনয় সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের। সিনেমার শুরুতে সন্তোষ দত্তকে পাই স্কুল শিক্ষকের চরিত্রে। তার কমিক সেন্স ও টাইমিংয়ের তুলনা হয় না। ১৯৭২ সালে মুক্তি পাওয়া সিনেমাটিকে কৈশোরের দুরন্ত জীবন ও প্রেম এত সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, যা বিরল না হলেও মনে ছাপ ফেলে। রসিক ও অমলার ‘‌ইনোসেন্স’ দর্শকের মনে থাকবে বহুদিন। তবে সবচেয়ে সুন্দর সম্ভবত এ সিনেমার শেষ দৃশ্যটি। সত্তরের দশকে বাংলা সিনেমায় চুমুর দৃশ্য রাখা সম্ভব ছিল না। তরুণ মজুমদার রসিক ও অমলার পা দেখানোর মাধ্যমে প্রতীকী চুম্বন দৃশ্য রেখে সিনেমাটি শেষ করেন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন