গল্পটা শুধু চায়ের নয়...

টেট মডার্নে পারফর্ম করার মুহূর্তে শিল্পী ইয়াসমিন জাহান নূপুর ছবি: জিহান করিম

গল্পটা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ইতিহাস রাজনীতির মিশ্রণের। শিল্পী এখানে নতুন করে ভাবতে শেখায়, ফিরে তাকাতে বলে শেকড়ের অভিমুখে। লন্ডনের টেট মডার্ন (Tate Modern) গ্যালারিতে প্রদর্শিত হচ্ছে ভিজুয়াল পারফরম্যান্স আর্টিস্ট ইয়াসমিন জাহান নূপুরের লেট মি গেট ইউ নাইস কাপ অব টি কাজটি এখানে ২০২৩ সালের নভেম্বর পর্যন্ত প্রদর্শিত হবে

লেট মি গেট ইউ নাইস কাপ অব টি’— ধরনের কনসেপ্ট কেন বেছে নিলেন?

দীর্ঘদিন ধরে আমি জামদানি মসলিন নিয়ে কাজ করছি। মসলিনের সঙ্গে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সময়ের সংযোগ বিদ্যমান। ২০১৯ সালের দিকে ঢাকা আর্ট সামিটের প্রধান কিউরেটর ডায়ানা ক্যাম্পবেল কলোনিয়ালিজম নিয়ে কাজ করার সময় আমাকে সম্পর্কে বলেন। পরবর্তী সময়ে পিবডি এসেক্স মিউজিয়ামে রেসিডেন্সিতে যাই। পিবডির ওদের দক্ষিণ এশীয় আর্কাইভে প্রবেশের অনুমতি দিলে সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিক শাসনকালসহ এশিয়া ভারতের ওপর অনেক তথ্য খুঁজে পাই আমি। চা নিয়ে কাজের ধারণাটি মূলত তৈরি হয় তখন। এরপর গোটা বিষয়টিকে তুলে ধরার জন্য কী ধরনের উপকরণ অনুষঙ্গ প্রয়োজন তা নিয়ে ভাবতে থাকি। সামদানি আর্ট ফাউন্ডেশন সহযোগিতা করে। প্রথম পারফরম্যান্সটি ২০১৯ সালে ফ্রিজ লন্ডনে অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ২০২০ সালে ঢাকা আর্ট সামিটে। কাজটি এখন টেট সংগ্রহ করেছে, যার মাধ্যমে পারফরম্যান্সটি টেট মডার্নের স্থায়ী কালেকশনে চলে গেছে। গত ২১-৩০ অক্টোবর পর্যন্ত টানা ১০ দিন আমি টেট মডার্নে পারফর্ম করি।

টেট মডার্ন আপনার কাজটি কীভাবে সংগ্রহ করেছে?

প্রক্রিয়াটি দারুণ। সংগ্রহের প্রক্রিয়া হিসেবে টানা দুই বছর ধরে প্রতিটি ডিটেইলস নিয়ে কাজ করা হয়। ওদের কাছে আমাকে পারফরম্যান্স স্ক্রিপ্ট থেকে শুরু করে প্রতিটি খুঁটিনাটি জমা দিতে হয়েছে। পারফরম্যান্সের সময় ব্যবহূত কাপড়, পোশাক, জুয়েলারি, আসবাব থেকে শুরু করে সবকিছু। আমার সঙ্গে কথোপকথনে যারা অংশ নিয়েছে তাদের নামও রয়েছে। ভিডিও ডকুমেন্ট, পারফরম্যান্স স্ক্রিপ্ট, তথ্য সব মিলিয়ে গ্যালারিতে কাজের সবকিছুই রয়েছে।

পারফর্ম করার সময় গ্যালারির ওয়ালপেপার থেকে শুরু করে চায়ের টেবিলের কাপড় নির্বাচনের মধ্য দিয়েও আপনি ঔপনিবেশিক সময় ইতিহাস বলে গেছেন। কাজটি কতটা চ্যালেঞ্জিং ছিল?

ওয়ালপেপারটা সম্পূর্ণ হাতে আঁকা; যেখানে চিনি চা দিয়ে তৈরি রঙ ব্যবহার করেছি। টেবিল ক্লথে সেলাই করা হয়েছে ভিক্টোরিয়ান-যুগের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মানচিত্র, সেখানে হাইলাইট করা হয়েছে ব্রিটিশদের দখলকৃত উপনিবেশগুলো। ন্যাপকিনের নকশা করা হয়েছে পপি ফুল দিয়ে, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এখানের কৃষকদের আফিম চাষ করতে বাধ্য করত। পারফরম্যান্সের সময় আমি সাদা মসলিন জামদানির পোশাক এবং মুক্তার অলংকার ব্যবহার করেছি। মুক্তা ব্রিটিশ যুগের অভিজাত্যের প্রতীক। চায়ের সরঞ্জাম হিসেবে বেছে নিয়েছি চীনা পোড়ামাটির পাত্র। কারণ ব্রিটিশরা শুধু চায়ের সংস্কৃতিটাই নিয়ে আসেনি, এর সঙ্গে অনেক বিষয় সম্পর্কিত। চা শ্রমিকরা স্থানীয় নয়, অভিবাসী। চায়ের সঙ্গে চিনির প্রবেশ বা দুধ ব্যবহারের নেপথ্যেও অন্য ধরনের রাজনীতি রয়েছে। ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি থেকে শুরু করে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যখন চীনের সঙ্গে বাণিজ্য করে, তখন ব্যবসার নিয়মগুলো ছিল ভীষণ বৈচিত্র্যময়। ব্রিটিশরা স্বর্ণ রুপার বিনিময়ে চা রেশম ক্রয় করত। একটা সময় ওরা স্বর্ণ রুপার বিকল্প খুঁজতে শুরু করে। ইউরোপে তখন চা খুব উচ্চ মূল্যে বিক্রি হতো, অনেক ক্ষেত্রে স্বর্ণের তুলনায় বেশি দাম ছিল। এরপর ব্রিটিশরা স্বর্ণ রুপা বন্ধ করে আফিম চোরাচালান করতে শুরু করে। আফিমের পুরোটাই চাষাবাদ হতো ভারতে। এখান থেকে চীনে চোরাইভাবে পাচার হতো। আমি গোটা বিষয়টাকে বলব হিস্ট্রিক্যাল ট্রমা। ব্রিটিশরা আমাদের সম্পদ, শ্রমশক্তি, জলবায়ু ব্যবহার করেছে (আমি মনে করি এখনো করছেতৈরি পোশাক শিল্পের কথাই যদি ধরি) আমি চা নিয়ে কাজ শুরু করে দেখলাম এর মধ্যে নীল, আফিম, টেক্সটাইল, মসলিন সিল্কও চলে আসে। সবকিছুকে শিল্পের মাধ্যমে কীভাবে সহজে দেখানো যায়তা ছিল আমার জন্য মূল চ্যালেঞ্জ। প্রস্তুতি পর্বে আমাকে বেশ যন্ত্রণাদায়ক সময় পার করতে হয়েছে।

দর্শকের সঙ্গে কী ধরনের গল্প করেন?

কথাটা আমাকে সবাই জিজ্ঞেস করে। আমার থিমটাআফটারনুন টিথেকে নেয়া। উনিশ শতকে ব্রিটেনের পাশাপাশি ভারত উপমহাদেশে চা পানের সংস্কৃতি ভীষণ জনপ্রিয় ছিল। কারণ তখন ভারতবর্ষ পুরোপুরি ব্রিটিশ কলোনির অধীনে। আমি আড্ডার মধ্য দিয়ে আগ্রহীদের ২০ মিনিটের আলাপচারিতায় অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ জানাই। দর্শকের সঙ্গে গ্যালারিতে বসে কথা বলার জন্য ঘরোয়া পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা করেছি। শুরুতে আমরা পরস্পরের সঙ্গে পরিচিত হয়ে নিই। প্রথম দু-এক মিনিট জড়তা থাকে, এরপর ধীরে ধীরে আলাপ জমে ওঠে। তবে আমি সবসময় ঔপনিবেশিক অতীত ইতিহাস নিয়ে কথা বলবএমন নয়। প্রথমত, আমার সামনে উপস্থিত ব্যক্তির মনের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করি, তিনি চা-বিষয়ক গল্পের মুডে আছেন নাকি অন্য কোনো বিষয় নিয়ে আলাপ করতে চাচ্ছেন। তবে চা নিয়ে আলাপের ক্ষেত্রে ১৬৬২ সালে ব্রিটেনের রাজা দ্বিতীয় চার্লসের সঙ্গে ক্যাথরিন ব্রিগঞ্জার বিয়ে, পর্তুগাল থেকে ক্যাথরিনের চায়ের পাতা নিয়ে আসার ঘটনা থেকে গল্পটা শুরু করি। অনেক ব্রিটিশ জানেন না তাদের সংস্কৃতিতে চা কখন প্রবেশ করে কিংবা এর মধ্যে কতটা যন্ত্রণাদায়ক অতীত আছে। সবসময় যে আমরা অতীত ইতিহাস নিয়ে কথা বলি তা নয়। অনেক সময় রাজনীতি, সমাজ, ব্যক্তিগত গল্প নিয়েও কথা হয়। আমি আর্জেন্টিনা, ইতালি, ইউক্রেন, ফিলিস্তিনি মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি। অনেকে আমার সঙ্গে কথা বলে ভীষণ আবেগাক্রান্ত হয়েছেন। অনেকে আমাকে বলেছেন, ‘আমি জানি না কেন আসছি, কিন্তু আমি তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাই।

শিল্পের অন্যান্য মাধ্যম থেকে পারফরম্যান্স আর্টের মাধ্যমে কী সাধারণ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগটা দ্রুত স্থাপন করা যায়?

শিল্প মূলত বোঝাপড়ার বিষয়। এর মধ্যে অনেক অবচ্ছেদ, খণ্ড বা বিভাগ রয়েছে। শিল্পের মাধ্যমে অনেক মানুষকে দ্রুত একটি বার্তা দেয়া যায়। আবার শিল্পকে গ্রহণের শিক্ষাটাও জরুরি। আমাদের সমাজে শিল্প-শিক্ষার অভাব রয়েছে। পারফরম্যান্স আর্ট অন্য স্তরের শিল্প; একে ধারণ করতে হলে অবশ্যই নিজেকে একটা পর্যায়ের মধ্য দিয়ে নিতে হয়।

পারফরম্যান্স আর্টের ক্ষেত্রে কোন বিষয়টা সবচেয়ে বেশি কঠিন মনে হয়?

আমি যেহেতু একজন ভিজ্যুয়াল আর্টিস্ট, তাই বলব অনেক মিডিয়ামেই কাজ করা হয়। যেমন ড্রইং, টেক্সটাইল, স্কাল্পচার, সাউন্ড, ভিডিওতবে আমার কাজের একটি বড় অংশই পারফরম্যান্স। পারফরম্যান্স আর্ট মূলত একজন শিল্পীর প্রতিদিনের জার্নি। এটা এমন নয় যে আমি গ্যালারিতে গেলাম, আর পারফর্ম করলাম। এটি প্রাত্যহিক রীতি-রেওয়াজের মধ্যে পড়ে। নিজের শরীরকে ওই জায়গা-পরিসর সময়ের সঙ্গে সংযুক্ত করতে হয়। আমরা যারা পারফরম করি তারা বিশ্বাস করি এটি বাস্তব জীবনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। এখানে বাস্তবতার প্রাধান্য অনেক বেশি।

 

সাক্ষাত্কার: রুহিনা ফেরদৌস

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন