ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন

একদিনেই ২০৮ কোটি ডলার বাজার মূলধন হারিয়েছে শীর্ষ ১০ কোম্পানি

মেহেদী হাসান রাহাত

তালিকাভুক্ত কোনো কোম্পানির সব শেয়ারের সম্মিলিত দরকে বাজার মূলধন হিসেবে অভিহিত করা হয়। এর মাধ্যমে কোম্পানির সার্বিক মূল্যমান সম্পর্কে জানা যায়। বৈশ্বিকভাবে কোম্পানির বাজার মূলধন হিসাব করা হয় ডলারে। বাজার মূলধন বিলিয়ন ডলারে পৌঁছলে তা কোম্পানির জন্য অনন্য মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয়। অস্থিতিশীল বাজার নিয়ন্ত্রণে দেশে ডলারের দর পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত আসে গত মাসে। একদিনেই সাড়ে ১১ শতাংশ অবমূল্যায়ন হয় টাকার। এর প্রভাবে দেশের পুঁজিবাজারের শীর্ষ ১০ কোম্পানি একদিনেই ২০৮ কোটি ডলার বা ২২ হাজার ৪৮ কোটি টাকার বাজার মূলধন হারায়।

দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে দীর্ঘদিন ধরেই রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে আসছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০২১-২২ অর্থবছরেও রিজার্ভ থেকে ৭৪০ কোটি ডলার বিক্রি করা হয়েছে। তবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৭ বিলিয়ন ডলারে নেমে এলে ১৩ সেপ্টেম্বর ডলারের বিনিময় হার আন্তঃব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রাবাজারের ওপর ছেড়ে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে একদিনেই ডলারের বিনিময় হার ৯৫ থেকে বেড়ে ১০৬ টাকায় দাঁড়ায়। টাকার অবমূল্যায়ন হয় ১১ দশমিক ৫৮ শতাংশ। এরপর থেকে বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) নির্ধারিত ডলারের দরকেই স্বীকৃতি দিয়ে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

টাকার অবমূল্যায়নের কারণে চলতি বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর পুঁজিবাজারের শীর্ষ ১০ কোম্পানির ডলারের হিসাবে বাজার মূলধনে বড় ধরনের পতন হয়। একদিনেই কোম্পানিগুলোর বাজার মূলধন কমে ২০৮ কোটি ডলার।

তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মধ্যে বাজার মূলধনের হিসাবে সবচেয়ে এগিয়ে টেলিযোগাযোগ খাতের কোম্পানি গ্রামীণফোন লিমিটেড। বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর কোম্পানিটির বাজার মূলধন ছিল ৩৮ হাজার ৬৯৯ কোটি ৬০ লাখ টাকা। প্রতি ডলার ৯৫ টাকা ধরে এটির বাজার মূলধন দাঁড়ায় ৪০৭ কোটি ৩৬ লাখ ডলারে। অন্যদিকে প্রতি ডলার ১০৬ টাকা বিবেচনায় নিয়ে বাজার মূলধন হয় ৩৬৫ কোটি লাখ ডলার। একদিনেই কোম্পানিটির বাজার মূলধন কমেছে ৪২ কোটি ২৭ লাখ ডলার।

বাজার মূলধনের দিক দিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ইলেকট্রনিকস হোম অ্যাপ্লায়েন্স উৎপাদক ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। গত ১৩ সেপ্টেম্বর কোম্পানিটির বাজার মূলধন ছিল ৩১ হাজার ৭৩৭ কোটি ৮০ লাখ টাকা। প্রতি ডলার ৯৫ টাকা হিসেবে কোম্পানিটির বাজার মূলধন ৩৩৪ কোটি লাখ ডলার। ডলারের বিনিময় মূল্য ১০৬ টাকা হিসাবে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ২৯৯ কোটি ৪১ লাখ ডলারে। একদিনের ব্যবধানেই ৩৪ কোটি ৬৭ লাখ ডলারের বাজার মূলধন হারায় কোম্পানিটি।

তামাক খাতের বহুজাতিক জায়ান্ট ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ কোম্পানি লিমিটেড (বিএটিবিসি) ২৮ হাজার কোটি ৮০ লাখ টাকা বাজার মূলধন নিয়ে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। প্রতি ডলার ৯৫ টাকা ধরে কোম্পানিটির বাজার মূলধন দাঁড়ায় ২৯৪ কোটি ৮৪ লাখ ডলারে। অন্যদিকে প্রতি ডলার ১০৬ টাকা বিবেচনায় নিয়ে এর বাজার মূলধন হয় ২৬৪ কোটি ২৪ লাখ ডলার। এতে একদিনেই কোম্পানিটির বাজার মূলধন কমেছে ৩০ কোটি ৬০ লাখ ডলার।

বিষয়ে জানতে চাইলে বিএটিবিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেহজাদ মুনিম বণিক বার্তাকে বলেন, বর্তমানে আমরা বৈশ্বিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। বিশ্বের অনেক দেশেই স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন হয়েছে। বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়েছে। তবে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে টাকায় লেনদেন হওয়ার কারণে স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের ক্ষেত্রে হয়তো ডলারে বাজার মূলধন কমার তেমন কোনো প্রভাব পড়বে না। কিন্তু বিদেশী বিনিয়োগকারীদের ক্ষেত্রে এর প্রভাব রয়েছে। আমরা সবসময় কোম্পানির ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধির দিকে জোর দিতে চাই। যাতে প্রতি প্রান্তিকেই ভালো আর্থিক পারফরম্যান্স করা সম্ভব হয়। অবশ্য টাকার অবমূল্যায়নের প্রভাবে আমাদের আমদানি ব্যয় বেশ বেড়ে গিয়েছে। এক্ষেত্রে ব্যয় সংকোচন নীতি কাজে লাগিয়ে আমাদের প্রভাবকে প্রশমিত করতে হবে।

বাজার মূলধনের শীর্ষ তালিকায় চতুর্থ স্থানে রয়েছে ওষুধ খাতের কোম্পানি স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড। গত ১৩ সেপ্টেম্বর কোম্পানিটির বাজার মূূলধন ছিল ১৮ হাজার ৬৫০ কোটি ৯০ লাখ টাকা। প্রতি ডলার ৯৫ টাকা হিসেবে কোম্পানিটির বাজার মূলধন ১৯৬ কোটি ৩২ লাখ ডলার। ডলারপ্রতি ১০৬ টাকা হিসাবে বাজার মূলধন দাঁড়ায় ১৭৫ কোটি ৯৫ লাখ ডলারে। একদিনের ব্যবধানেই ২০ কোটি ৩৭ লাখ ডলার বাজার মূলধন হারায় কোম্পানিটি।

টেলিযোগাযোগ খাতের কোম্পানি রবি আজিয়াটা লিমিটেডের বাজার মূলধন বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর ছিল ১৫ হাজার ৭১৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা। বাজার মূলধন তালিকায় কোম্পানিটির অবস্থান পঞ্চম। প্রতি ডলার ৯৫ টাকা ধরে কোম্পানিটির বাজার মূলধন দাঁড়ায় ১৬৫ কোটি ৪১ লাখ ডলারে। অন্যদিকে প্রতি ডলার ১০৬ টাকা বিবেচনায় নিয়ে এর বাজার মূলধন হয় ১৪৮ কোটি ২৪ লাখ ডলার। এতে একদিনেই কোম্পানিটির বাজার মূলধন কমেছে ১৭ কোটি ১৬ লাখ ডলার।

বাজার মূলধনের তালিকায় ষষ্ঠ অবস্থানে রয়েছে ওষুধ খাতের কোম্পানি রেনাটা লিমিটেড গত ১৩ সেপ্টেম্বর কোম্পানিটির বাজার মূলধন ছিল ১৩ হাজার ৯৬৯ কোটি ৪০ লাখ টাকা। প্রতি ডলার ৯৫ টাকা হিসেবে কোম্পানিটির বাজার মূলধন ১৪৭ কোটি লাখ ডলার। প্রতি ডলার ১০৬ টাকা হিসাবে বাজার মূলধন দাঁড়ায় ১৩১ কোটি ৭৯ লাখ ডলারে। একদিনের ব্যবধানেই ১৫ কোটি ২৬ লাখ ডলার বাজার মূলধন হারায় কোম্পানিটি।

বিদ্যুৎ খাতের কোম্পানি ইউনাইটেড পাওয়ার জেনারেশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের বাজার মূলধন বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর ছিল ১৩ হাজার ৭৮৫ কোটি ২০ লাখ টাকা। বাজার মূলধনের শীর্ষ তালিকায় কোম্পানিটির অবস্থান সপ্তম। প্রতি ডলার ৯৫ টাকা ধরে কোম্পানিটির বাজার মূলধন দাঁড়ায় ১৪৫ কোটি ১১ লাখ ডলারে। অন্যদিকে প্রতি ডলার ১০৬ টাকা বিবেচনায় নিয়ে এর বাজার মূলধন হয় ১৩০ কোটি লাখ ডলার। এতে একদিনেই কোম্পানিটির বাজার মূলধন কমেছে ১৫ কোটি লাখ ডলার।

বাজার মূলধনের তালিকায় অষ্টম অবস্থানে রয়েছে বিবিধ খাতের কোম্পানি বেক্সিমকো লিমিটেড। গত ১৩ সেপ্টেম্বর কোম্পানিটির বাজার মূলধন ছিল ১২ হাজার ২১৫ কোটি ৯০ লাখ টাকা। প্রতি ডলার ৯৫ টাকা হিসাবে কোম্পানিটির বাজার মূলধন ১২৮ কোটি ৫৯ লাখ ডলার। প্রতি ডলার ১০৬ টাকা হিসাবে বাজার মূলধন দাঁড়ায় ১১৫ কোটি ২৪ লাখ ডলারে। একদিনের ব্যবধানেই ১৩ কোটি ৩৪ লাখ ডলার বাজার মূলধন হারায় কোম্পানিটি।

সিমেন্ট খাতের কোম্পানি লাফার্জ হোলসিম বাংলাদেশ লিমিটেডের বাজার মূলধন বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর ছিল হাজার ৩৭২ কোটি ৩০ লাখ টাকা। বাজার মূলধনের শীর্ষ তালিকায় কোম্পানিটির অবস্থান নবম। প্রতি ডলার ৯৫ টাকা ধরে কোম্পানিটির বাজার মূলধন দাঁড়ায় ৯৮ কোটি ৬৫ লাখ ডলার। অন্যদিকে প্রতি ডলার ১০৬ টাকা বিবেচনায় নিয়ে এর বাজার মূলধন হয় ৮৮ কোটি ৪২ লাখ ডলার। এতে একদিনেই কোম্পানিটির বাজার মূলধন কমেছে ১০ কোটি ২৪ লাখ ডলার।

বাজার মূলধনের তালিকায় দশম অবস্থানে রয়েছে বহুজাতিক রঙ উৎপাদক বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ লিমিটেড। গত ১৩ সেপ্টেম্বর কোম্পানিটির বাজার মূলধন ছিল হাজার ২৪৮ কোটি ৩০ লাখ টাকা। প্রতি ডলার ৯৫ টাকা হিসাবে কোম্পানিটির বাজার মূলধন ৮৬ কোটি ৮২ লাখ ডলার। প্রতি ডলার ১০৬ টাকা হিসাবে বাজার মূলধন দাঁড়ায় ৭৭ কোটি ৮১ লাখ ডলারে। একদিনের ব্যবধানেই কোটি লাখ ডলার বাজার মূলধন হারায় কোম্পানিটি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন হলে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের মুনাফা কমে যায়। এতে করে বিদেশীদের মধ্যে বিনিয়োগ প্রত্যাহারের প্রবণতা বেড়ে যায়। সার্বিকভাবে দেশের পুঁজিবাজারে বিদেশী বিনিয়োগের পরিমাণ ক্রমেই কমছে। বাজার মূলধনের ভিত্তিতে শীর্ষ দশে থাকা অধিকাংশ কোম্পানির বিদেশী বিনিয়োগের পরিমাণও গত কয়েক মাস কমছে। বিলিয়ন ডলারের কোম্পানিগুলোর প্রতি বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ বেশি থাকে। টাকার অবমূল্যায়নের কারণে বিলিয়ন ডলারের কোম্পানির স্বীকৃতি পেতে টাকার অংকে দেশের পুঁজিবাজারের কোম্পানিগুলোকে আগের তুলনায় বেশি বাজার মূলধন অর্জন করতে হবে। অন্যদিকে যে হারে স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন হয়েছে বাজার মূলধন তার চেয়ে বেশি না বাড়লে প্রান্তসীমায় থাকা কোম্পানিগুলো বিলিয়ন ডলারের তালিকা থেকে ছিটকে পড়তে পারে।

বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) প্রেসিডেন্ট মো. ছায়েদুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, টাকার অবমূল্যায়নের প্রভাবে ডলারের হিসাবে শীর্ষ কোম্পানিগুলোর বাজার মূলধন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে গিয়েছে। এতে কোম্পানিগুলোর আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডিংয়ের ক্ষেত্রে প্রভাব থাকলেও ব্যবসায়িক কার্যক্রমের ওপর এর কোনো প্রভাব পড়েনি। বিশ্বের অন্যান্য দেশের কোম্পানিগুলোর বাজার মূলধনও একইভাবে কমেছে। বিদেশী বিনিয়োগকারীদের ক্ষেত্রে টাকার অবমূল্যায়নের দুই ধরনের প্রভাব রয়েছে। বিদ্যমান যেসব বিনিয়োগকারী রয়েছেন, তাদের ক্ষেত্রে হয়তো বিষয়টি সুখকর নয়। কিন্তু যেসব বিদেশী বিনিয়োগকারী এখনো বাংলাদেশে বিনিয়োগ করেননি কিংবা বিনিয়োগ নিয়ে দ্বিধার মধ্যে রয়েছেন তাদের জন্য বিষয়টি ইতিবাচক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুসারে বছরের এপ্রিলেও ডলারের বিনিময় হার ছিল ৮৬ টাকা। সর্বশেষ গতকাল বাফেদার হিসাব অনুসারে ডলারের গড় ক্রয় মূল্য ছিল ১০১ টাকা ৯০ পয়সা। হিসাবে গত ছয় মাসে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ১৮ দশমিক ৪৯ শতাংশ। আর গত এক যুগের হিসাব আমলে নিলে ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশী মুদ্রা টাকা প্রায় ৫০ শতাংশ দর হারিয়েছে। ২০১০ সালে প্রতি ডলারের বিনিময় হার ছিল ৬৮ টাকা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন