ডলারের বাজারে অস্থিতিশীলতা

ছয় ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধানকে অপসারণের নির্দেশ

নিজস্ব প্রতিবেদক

দেশের বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে অস্থিরতা চলছে বছরখানেক ধরে। খুচরার পাশাপাশি ব্যাংকেও নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে উঠেছে ডলারের দাম। ব্যাংকগুলোয় ডলারের ঘোষিত দরের সঙ্গে বাস্তবতার কোনো সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না চাহিদা জোগানের মধ্যে বিস্তর ফারাক থাকায় অসহায় হয়ে পড়েছে অনেক ব্যাংকও। তবে শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কঠোর হওয়ার পথে হেঁটেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বাড়তি দামে ডলার বিক্রি করা এবং প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ডলার সংরক্ষণ করার প্রমাণ পাওয়ায় দেশের ছয়টি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধানকে পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগ থেকে গতকাল -সংক্রান্ত নির্দেশনা দেয়া হয়। ব্যবস্থা নেয়া ছয়টি ব্যাংকের মধ্যে একটি বিদেশী ব্যাংকও রয়েছে।

প্রায় এক সপ্তাহ কিছুটা স্থিতিশীল থাকার পর আবারো অস্থির হয়ে উঠেছে ডলারের খুচরা বাজার (কার্ব মার্কেট) গতকাল রাজধানীর মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানগুলোয় প্রতি ডলার ১১৬ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। রেকর্ড দাম দিয়েও চাহিদা অনুযায়ী ক্রেতারা ডলার পাননি। পরিমাণ বেশি হলে দু-তিনটি মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান ঘুরে ডলার কিনতে হয়েছে। দেশের অনেক ব্যাংকও বিদেশী মানি এক্সচেঞ্জগুলো থেকে ১১১ থেকে ১১৪ টাকায় রেমিট্যান্সের ডলার কিনেছে।

ছয় ব্যাংকের ট্রেজারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশের বিষয়টি নিশ্চিত করে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ডলারের বাজারে সংকট সৃষ্টির পেছনে কিছু ব্যাংক জড়িত থাকার প্রমাণ আমরা পেয়েছি। প্রাথমিকভাবে পাঁচটি দেশী একটি বিদেশী ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধানকে অপসারণ করা হয়েছে। ভবিষ্যতে তালিকা আরো বড় হতে পারে।

নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, দেশের শীর্ষস্থানীয় কিছু ব্যাংকের ট্রেজারি কর্মকর্তারা কম দামে ডলার কিনে বেশি দামে বিক্রি করছেন। এর মাধ্যমে ট্রেজারি খাতে ব্যাংকগুলোর আয় অনেক বেড়ে গিয়েছে। অথচ সংকটের সময় ট্রেজারি খাতের আয় কমে যাওয়ার কথা। ব্যাংকিং লেনদেনের বাইরে গিয়ে কিছু ব্যাংকের ট্রেজারি কর্মকর্তা ব্যক্তিগতভাবেও লাভবান হচ্ছেন। এক্ষেত্রে ট্রেজারি বিভাগের প্রধানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীর যোগসাজশ রয়েছে।

তবে শাস্তিমূলক চিঠি পাওয়া একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বণিক বার্তাকে বলেন, আমদানি দায় পরিশোধের জন্য বাধ্য হয়ে বেশি দামে রেমিট্যান্স কিনতে হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঘোষিত দরে ডলার পাওয়া একেবারেই অবাস্তব। যে দামে ডলার কেনা হয়েছে, তার চেয়ে তো কম দামে গ্রাহকের কাছে ডলার বেচা যায় না। এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে নির্দেশনা দিয়ে চিঠি দিয়েছে, সেটি বাস্তবায়ন করাও ব্যাংকের জন্য বিব্রতকর।

ছয় মাস ধরে দেশে ডলারের বিনিময় হার বাড়ছিল লাফিয়ে লাফিয়ে। ব্যাংক খাতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিনিময় হার বেড়েছে ডলারের কার্ব মার্কেটেও। এক বছরের ব্যবধানে প্রতি ডলারের বিনিময় হার ৮৫ থেকে ১০৫ টাকা পর্যন্ত উঠে গিয়েছিল। তবে একদিনের ব্যবধানে সর্বোচ্চ বৃদ্ধির হার দেখা যায় গত ২৬ জুলাই। ২৫ জুলাই কার্ব মার্কেটে প্রতি ডলার ১০৪-১০৫ টাকায় বিক্রি হলেও ২৬ জুলাই তা ১১২ টাকা পর্যন্ত উঠে যায়। একদিনেই ডলারের দাম প্রায় টাকা বেড়ে যাওয়ায় তত্পর হয়ে ওঠে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। দেশের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানগুলোয় অভিযান শুরু করা হয়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বলা হয়, ব্যাংক মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানগুলোর অনিয়ম চিহ্নিত করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ১০টি পরিদর্শক দল সার্বক্ষণিক কাজ করছে। অনিয়মে জড়িত থাকায় পাঁচটি মানি এক্সচেঞ্জের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। ৪৫টি মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানকে কারণ দর্শানোর নোটিস দেয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অব্যাহত তত্পরতায় গত সপ্তাহে দেশের খুচরা বাজারে ডলারের দাম কিছুটা নিয়ন্ত্রিত ছিল। তবে গতকাল আবারো ডলারের খুচরা বাজার অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। এদিন রাজধানীর মতিঝিল, গুলশান, কারওয়ান বাজারের মানি এক্সচেঞ্জগুলোয় প্রতি ডলার ১১৬ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে।

এদিকে চাহিদা তীব্র হওয়ায় গতকাল ডলারের বিনিময় হার বাড়িয়ে টাকার অবমূল্যায়ন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকও। প্রতি ডলারে ৩০ পয়সা বাড়িয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক গতকাল ডলার বিক্রি করেছে ৯৫ টাকায়। এদিন রিজার্ভ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিক্রি করেছে ১৩ কোটি ৯০ লাখ ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরের শুধু জুলাই মাসেই রিজার্ভ থেকে ১১৯ কোটি ডলার বিক্রি করা হয়েছে। আর গত অর্থবছরে আমদানি দায় পরিশোধের জন্য ব্যাংকগুলোর কাছে রেকর্ড ৭৪০ কোটি ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

ব্যাংকগুলো এখন বাড়তি দামে ডলার কিনতে বাধ্য হচ্ছে বলে মনে করেন মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, চলতি মাসের মধ্যে আমাদের ব্যাংকের কোটি ডলারের এলসি দায় পরিশোধ করতে হবে। রফতানি রেমিট্যান্স থেকে পরিমাণ ডলার সংগ্রহ করা সহজ ব্যাপার নয়। এজন্য বাধ্য হয়ে রেমিট্যান্স হাউজগুলো থেকে বেশি দামে ডলার কিনতে হচ্ছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন