চিত্রশিল্পী কামরুল হাসানের জন্মশতবার্ষিকী

যার প্রাসঙ্গিকতা জাতিসত্তার সঙ্গে সম্পৃক্ত

মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ

২৩ মার্চ ১৯৭১। শহীদ মিনারে ইয়াহিয়া খানের বিকৃত ১০টি ছবি ঝুলছে। ছবিগুলোর নিচে লেখা: এই জানোয়ারটা আবার আক্রমণ করতে পারে। তারপর দেশের ইতিহাসের কালরাত ২৫ মার্চ এল। পরদিন ছবিটা আবারো ফিরে এসেছে, তবে নিচের লেখাটা বদলে গেছে। এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে। ছবিগুলো শিল্পী কামরুল হাসানের আঁকা, যিনি নিজেকে পটুয়া পরিচয় দিয়ে আনন্দ পেতেন, যিনি দেশের গুরুত্বপূর্ণ সব ঘটনায় রেখেছেন নিজের মতো করে অবদান। আমাদের জাতীয় পতাকার ডিজাইনার কামরুল হাসান। আজ তার শততম জন্মবার্ষিকী।

১৯২১ সালের ডিসেম্বর ব্রিটিশ ভারতের কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন কামরুল হাসান। পিতা মোহাম্মদ হাসিম ছিলেন গোরস্তানের সুপারিনটেনডেন্ট। কলকাতা সাধারণত ছিল হিন্দুবেষ্টিত এলাকা, এর মধ্যে তিনি জন্ম নিয়েছেন রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে। একদিকে নিজেকে মেলে ধরার হাতছানি, অন্যদিকে সংস্কার ধরে রাখার চেষ্টায় লিপ্ত মুসলমান পরিবার। দুইয়ে মিলে কামরুল হাসানকে বেগ পেতে হয়েছিল ছোটবেলা থেকেই।

শিল্পচর্চায় কামরুল হাসানের হাতেখড়ি হয় ব্রতচারী আন্দোলনের মাধ্যমে। সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯৩২ সালে শুরু হওয়া আন্দোলনে কামরুল হাসান যোগ দেন খুব অল্প বয়সে। মূলত দেশপ্রেম সৃষ্টিই ছিল আন্দোলনের লক্ষ্য। তাই ব্রিটিশ শাসনের অধীনে থেকেও আন্দোলনে ব্রিটিশ সরকার কোনো বাধা দেয়নি, বরং সমর্থন জানিয়েছে ব্রতচারীদের। এই ব্রতচারী আন্দোলনের সঙ্গে থেকে লোকনৃত্য লোকসংগীতচর্চার পাশাপাশি দেশের প্রতি এক ধরনের টান অনুভব করতে শুরু করেন কামরুল হাসান। ধীরে ধীরে প্রকৃতিকে কাছ থেকে দেখাও শুরু হয় সেখান থেকেই। একসময় ব্রতচারী আন্দোলন থেমে গেলেও থামেননি কামরুল হাসান।

ছোটবেলা থেকেই বিদ্রোহী স্বভাব ছবি আঁকার প্রতিকূল পরিবেশ নিয়ে বড় হতে হয়েছে কামরুল হাসানকে। তাই পরিবারের সঙ্গে বিদ্রোহ করেই ভর্তি হন কলকাতা আর্ট স্কুলে। ছবি আঁকার পাশাপাশি তিনি হয়ে উঠছিলেন সংগঠকও। সে সময়েই হাতে লেখা দেয়ালিকা বের করতেন তিনি। সেখানে গল্প, কবিতা, ছবি সবই থাকত। হাতে লিখে লিখে বের করেছেন ঈদ সংখ্যাও। কাজ করেছেন বয় স্কাউটসে, ছিলেন শরীরচর্চা বিশারদও। ১৯৪৫ সালে শরীরচর্চা প্রতিযোগিতায় বেঙ্গল চ্যাম্পিয়ন হয়ে মিস্টার বেঙ্গল উপাধি লাভ করেন।

দেশভাগের সময় পিতাকে হারিয়ে চলে আসেন ঢাকায়। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের সঙ্গে ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ঢাকা আর্ট স্কুল, যা বর্তমানে চারুকলা অনুষদ হিসেবে পরিচিত। সেখানেই শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন তিনি।

ব্যক্তিগতভাবে কামরুল হাসান ছিলেন প্রচণ্ডভাবে রাজনীতিসচেতন এক ব্যক্তিত্ব। যেকোনো আন্দোলন সংগ্রামে তার সরব উপস্থিতির কথা শুনতে পাওয়া যায়। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি তার একটি চিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধন হওয়ার কথা ছিল। দেশের পরিস্থিতি বিবেচনা করে তিনি তা স্থগিত করেছিলেন। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে তিনি ছিলেন সক্রিয়। মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য বেতার দপ্তরের শিল্প বিভাগের পরিচালকের দায়িত্ব সামলেছেন দ্রোহী শিল্পী।

দেশ স্বাধীন হলো। মিলল না জনমানুষের মুক্তি। বন্ধ হলো না কামরুল হাসানের সংগ্রাম। ১৯৮৮ সালের ফেব্রুয়ারি জাতীয় কবিতা উৎসবে সভাপতিত্ব করছিলেন তিনি। সে সভায় আবারো রাখেন তিনি তার বিদ্রোহের ছাপ। দেশ আজ বিশ্ব বেহায়ার খপ্পরে শীর্ষক ব্যঙ্গচিত্রটি আঁকেন সেখানে। তত্কালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে ব্যঙ্গ করেই জনসম্মুখে স্কেচটি আঁকেন তিনি। প্রতিবাদী ছিল কামরুল হাসানের মননে, মগজে। তাই প্রতিবাদী অবস্থায়ই সেদিন সেখানে মৃত্যুবরণ করেন। তবে মরে গিয়েও বিদ্রোহ ছাড়েননি তিনি। তার সৃষ্টি আজও মানুষকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। আজও মানুষ চেষ্টা করে সেই কিশোরীকে মুক্ত করতে, যে উঁকি দিয়ে দেখছে, দেশ শত্রুমুক্ত হয়েছে কিনা।

বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার বর্তমান যে ডিজাইন, তা কামরুল হাসানের হাতেই করা। এছাড়া বাংলাদেশের জাতীয় প্রতীক, বিমান বাংলাদেশের লোগোসহ চার হাজারের মতো কাজ করেছেন তিনি। বাংলাদেশের ইতিহাস যতদিন থাকবে ততদিনই দেশের মানুষের স্মরণ করতে হবে কামরুল হাসানের মতো সময়ের আগে হাঁটা অসাধারণ ব্যক্তিত্বকে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন