দুধপুকুরিয়া-ধোপাছড়ি অভয়ারণ্য

সংরক্ষিত বনের মধ্য দিয়ে সড়ক নির্মাণের তোড়জোড়

দেবব্রত রায়, চট্টগ্রাম ব্যুরো

চট্টগ্রামের সংরক্ষিত বনাঞ্চলগুলোর মধ্যে দুধপুকুরিয়া-ধোপাছড়ি অভয়ারণ্য অন্যতম। সেখানে দুর্লভ প্রজাতির বিভিন্ন বৃক্ষ যেমন আছে, তেমনি রয়েছে বন্যপ্রাণীর অবাধ বিচরণ। সংরক্ষিত ওই বনের মধ্য দিয়েই পটিয়া-হাইদগাঁও দিয়ে রাঙ্গুনিয়া পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করতে চায় চট্টগ্রাম সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর।

সম্প্রতি চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের মাসিক সমন্বয় সভায় সড়কটি নির্মাণের বিষয়ে প্রস্তাব করেছে সওজ। যদিও এ সংরক্ষিত বনাঞ্চলে সড়ক নির্মাণের এ প্রস্তাবে সায় দেয়নি জেলা প্রশাসন। সেজন্য বিকল্প উপায়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের অনুমতি নিয়ে সড়কটি নির্মাণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সওজ।

২০ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সড়ক নির্মাণের প্রস্তাব দেয় মূলত সড়ক বিভাগ। সড়কটির উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবও (ডিপিপি) মন্ত্রণালয়ে পাঠায় সওজ। এ প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয় ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। সড়কটি পটিয়া-অন্নদাদত্ত-হাইদগাঁও-রাঙ্গুনিয়ার পশ্চিম খুরুশিয়া-কালিন্দিরানী সড়ক-দুধপুকুরিয়া-চন্দনাইশের ধোপাছড়ি-শঙ্খতীরের ডলুপাড়া-বালাঘাটা হয়ে বান্দরবানের সঙ্গে সংযুক্ত করার প্রস্তাব ছিল প্রকল্পে। বর্তমানে প্রকল্পের প্রস্তাব সড়ক ও সেতু পরিবহন মন্ত্রণালয়ে দেয়া হয়েছে।

চলতি বছরের ১৫ জুলাই বন বিভাগকে এক চিঠির মাধ্যমে দোহাজারী সড়ক বিভাগ জানায়, চট্টগ্রামের খানহাট-ধোপাছড়ি-বান্দরবান সড়কটি নির্মাণ এবং প্রশস্ততার জন্য স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং সড়ক পরিবহনমন্ত্রী বরাবর ডিও লেটার পাঠানো হয়েছে। সড়কটি নির্মাণের কিছু অংশ বনের মধ্য দিয়ে হওয়ায় বন বিভাগের ছাড়পত্র প্রয়োজন। 

এদিকে এ চিঠির বিপরীতে সওজকে বন বিভাগ জানায়, ১৯২৭ সালের (সংশোধিত) বন আইনে বন অধিদপ্তরের অনুমতি ছাড়া সংরক্ষিত বনাঞ্চলের মধ্যে রাস্তা নির্মাণ বা উন্নয়নমূলক কার্যক্রম নিষিদ্ধ। দুধপুকুরিয়া-ধোপাছড়ির মধ্যে সড়ক নির্মাণের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে, সেটা ২০১০ সালে বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য হিসেবে সংরক্ষিত ঘোষণা করে সরকার। সেজন্য সড়ক নির্মাণ প্রকল্পের পিসিপি/পিপি তৈরির আগে বন অধিদপ্তরের ছাড়পত্র না নিয়ে কোনো কার্যক্রম শুরু না করার অনুরোধ জানানো হচ্ছে সওজকে।

চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. শফিকুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, দোহাজারী এলজিইডি থেকে পটিয়া, রাঙ্গুনিয়া হয়ে বান্দরবান পর্যন্ত সড়ক নির্মাণের একটি প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগকে। সড়কটির রাঙ্গুনিয়া অংশ সংরক্ষিত দুধপুকুরিয়া-ধোপাছড়ি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের মধ্যে পড়বে, যা পরিবেশ, বন ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হবে। সেজন্য বন বিভাগ প্রস্তাবটিতে আপত্তি জানিয়েছে। 

বন বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, সড়কটি নির্মাণ হলে এই সংরক্ষিত বনের প্রাণীর জন্য দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতির আশঙ্কা হবে। সংরক্ষিত বনের মধ্যে সড়ক নির্মাণ করা হলে সড়কের দুই পাশে অবৈধ দোকানপাটসহ নানা ধরনের স্থাপনা গড়ে উঠবে। অবৈধ অনুপ্রবেশকারীরা বনের মধ্যে প্রবেশ করে জবরদখলের প্রবণতাও বেড়ে যাবে। তখন সীমিত লোকবল দিয়ে অনুপ্রবেশকারীদের প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে না। এ বনের অভ্যন্তরে অনেক দুর্লভ প্রজাতির গাছ আছে, সেগুলোও তখন রক্ষা করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে।

তবে সওজের কর্মকর্তারা বলছেন, সড়কের কারণে কোনো ক্ষতি হবে না বনের। সড়কটি নির্মাণ করা গেলে রাঙ্গুনিয়া ও পটিয়া এলাকার সঙ্গে বান্দরবানের যোগাযোগ বাড়বে। বান্দরবানে সরাসরি যেতে হলে চট্টগ্রাম শহর, হাটহাজারী উপজেলা ঘুরে যাওয়ার প্রয়োজন হবে না। সর্বোপরি পর্যটন খাতের বিকাশ হবে। 

এদিকে সংরক্ষিত বনাঞ্চলে সড়ক নির্মাণকে বিরল প্রজাতির উদ্ভিদ ও পাখির জন্য বড় ধরনের হুমকি মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করেন, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে এ দুধপুকুরিয়া-ধোপাছড়ির বন্যপ্রাণীরা। এসব বন্যপ্রাণী এবং দুর্লভ প্রজাতির বৃক্ষ বনের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করছে। সেজন্য এ অভয়ারণ্যে ও আশপাশেও কোনো সড়ক নির্মাণ না করার দাবি জানান পরিবেশবিদরা। তাছাড়া প্রাণীদের অভয়ারণ্য নষ্ট হওয়া, দুর্লভ গাছ সংরক্ষণ করা কঠিন হয়ে পড়বে বলে মনে করছেন তারা। 

চট্টগ্রামের দোহাজারী সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সুমন সিংহ বণিক বার্তাকে বলেন, সড়কটি চট্টগ্রামের পটিয়া-হাইদগাঁও হয়ে রাঙ্গুনিয়া উপজেলা দিয়ে বান্দরবানের সংযোগ হবে। ২০ কিলোমিটার সড়কটির মধ্যে সাত বা আট কিলোমিটার বনের মধ্য দিয়ে যাবে। তবে চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের আপত্তি থাকা এবং সড়ক নির্মাণের ছাড়পত্র না দেয়ায় কাজটি সম্পন্ন নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। সংযোগ সড়কটি নির্মাণ হলে এ দুই অঞ্চল এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবানের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি এবং কৃষিজ পণ্য পরিবহনে নতুন দুয়ার খুলবে।

চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের তথ্যমতে, ২০১০ সালের ৬ এপ্রিল পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় ‘দুধপুকুরিয়া-ধোপাছড়ি’ এলাকাকে বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করে। পরবর্তী সময়ে তত্কালীন পরিবেশ ও বন প্রতিমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ ও বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি একই সালের ৯ মে এ বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য উদ্বোধন করেন। ‘ইন্টিগ্রেটেড প্রটেক্টেড এরিয়া কো-ম্যানেজমেন্ট’ প্রজেক্টের অধীনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক সহযোগিতায় এ বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য প্রতিষ্ঠা করা হয়। দুধপুকুরিয়া, পূর্ব ও পশ্চিম খুরুশিয়া, পশ্চিম ধোপাছড়ি ও জঙ্গল ধোপাছড়ি মৌজার ৪ হাজার ৭১৬ একর এলাকাজুড়ে রাঙ্গুনিয়া-চন্দনাইশ উপজেলার মাঝামাঝিতে এ অভয়ারণ্যটির অবস্থান। এ অভয়ারণ্যে প্রাকৃতিক ছড়া, বিভিন্ন প্রজাতির পশু-পাখি, আদিবাসী পল্লী, বুনো অর্কিড, শতবর্ষী বিভিন্ন প্রজাতির গাছ, নিবিড় বাঁশ বন, পাহাড়ি বন এবং ঘন বেত বাগান আছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন