গোল্ডেন মনিরের বাসা থেকে ১ কোটি টাকা ও ৬০০ ভরি স্বর্ণ উদ্ধার

১ হাজার ৫০ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের তথ্য মিলেছে

নিজস্ব প্রতিবেদক

নব্বইয়ের দশকে ঢাকার গাউছিয়া মার্কেটে কাপড়ের দোকানের বিক্রয়কর্মী হিসেবে কাজ করতেন মো. মনির হোসেন। সেখানে দুই বছর কাজ করার পর চাকরি নেন মৌচাক মার্কেটে ক্রোকারিজের দোকানে। সেখানেই তার সখ্য গড়ে ওঠে লাগেজ পার্টির সঙ্গে। এরপর যুক্ত হন স্বর্ণ চোরাচালানে। অবৈধ পথে স্বর্ণের চালান এনে তা পৌঁছে দিতেন ঢাকার বিভিন্ন স্বর্ণ ব্যবসায়ীর কাছে। আর এ ব্যবসার ওপর ভর করেই কয়েক বছরে পরিচিত হয়ে ওঠেন গোল্ডেন মনির নামে। শুক্রবার রাজধানীর বাড্ডায় তার ছয়তলা বাড়িতে রাতভর অভিযান চালায় র্যাব। অভিযান শেষে শনিবার সকালে বাসা থেকে অবৈধ অস্ত্র, মদের পাশাপাশি নগদ ১ কোটি টাকা ও ৬০০ ভরি স্বর্ণালংকার উদ্ধারের তথ্য জানানো হয়। এছাড়া মনিরের ১ হাজার ৫০ কোটি টাকার সম্পদের দালিলিক প্রমাণও উদ্ধার করা হয় বাসা থেকে।

দীর্ঘ অনুসন্ধান শেষে শুক্রবার রাত ১১টার দিকে মেরুল বাড্ডা এলাকায় মনিরের বাসায় অভিযান পরিচালনা করেন র্যাব-৩-এর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পলাশ কুমার বসু। অভিযান শেষে তিনি জানান, মনিরের বাসা থেকে একটি বিদেশী পিস্তল, চার রাউন্ড গুলি, চার লিটার বিদেশী মদ ও ৩২টি নকল সিল উদ্ধার করা হয়। এছাড়া ১০ দেশের বিদেশী মুদ্রাও উদ্ধার করা হয়েছে। অভিযানে মনিরের বাসা থেকে ৬০০ ভরি স্বর্ণ ও নগদ ১ কোটি ৯ লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। অবৈধ অস্ত্র ও মদ উদ্ধারের ঘটনায় তার নামের পৃথক দুটি মামলা দায়ের করা হচ্ছে। পাশাপাশি ঘোষণা ব্যতীত বিদেশী মুদ্রা সংরক্ষণ করায় তদন্ত শেষে তার বিরুদ্ধে ফরেন কারেন্সি আইনে আরেকটি মামলা করা হবে। 

১২ ঘণ্টার রুদ্ধশ্বাস অভিযান শেষে র?্যাবের মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিক বিল্লাহ জানান, একটি গোয়েন্দা সংস্থার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে এ অভিযান চালানো হয়। একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে মনিরের সখ্য রয়েছে। 

দলটির নিয়মিত অর্থের জোগানদাতাও মনির। তবে ওই রাজনৈতিক দলের পরিচয় প্রকাশ করেননি র্যাব কর্মকর্তা। 

জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে র্যাব জানায়, মৌচাক মার্কেটের ক্রোকারিজ দোকানে চাকরির সুবাদে লাগেজ পার্টির সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে মনিরের। এক পর্যায়ে ঢাকা-সিঙ্গাপুর-ভারত রুটে প্রথমে সে কাপড়, প্রসাধনী, ইলেক্ট্রনিক্স, কম্পিউটারের যন্ত্রাংশ, সেলফোন, ঘড়িসহ বিভিন্ন সামগ্রী ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে লাগেজের মাধ্যমে আনার কাজ শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে লাগেজে তিনি স্বর্ণ চোরাচালান শুরু করেন। বায়তুল মোকাররমে উমা জুয়েলার্স নামে একটি জুয়েলারি দোকান দেন। ওই দোকান থেকে লাগেজে আনা অবৈধ স্বর্ণ অন্য ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করা হতো। চোরাচালানের দায়ে ২০০৭ সালে বিশেষ ক্ষমতা আইনে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় মনিরের বিরুদ্ধে মামলা হয়। 

শুধু স্বর্ণ চোরাচালানই নয়, ভূমি জালিয়াতিও ছিল মনিরের অবৈধ সম্পদ অর্জনের অন্যতম উৎস। জিজ্ঞাসাবাদে মনির র্যাবকে জানিয়েছে, ২০০১ সালে তত্কালীন প্রভাবশালী মন্ত্রী, গণপূর্ত ও রাজউকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক স্থাপন করে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ভূমি জালিয়াতি শুরু করেন তিনি। রাজধানীর বাড্ডা এলাকায় রাজউকের ডিআইটি প্রজেক্টে অনেক প্লট প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নেন মনির। এছাড়া পূর্বাচল, বাড্ডা, নিকুঞ্জ, উত্তরা ও কেরানীগঞ্জে দুই শতাধিক প্লটের মালিক হয়েছেন মনির। 

অভিযানে অংশ নেয়া র্যাব কর্মকর্তারা জানান, মনিরের বাসা থেকে দুই শতাধিক প্লটের দলির উদ্ধার করা হয়েছে, যদিও তিনি ৩০ প্লট কেনার তথ্য দিয়েছেন। পাশাপাশি রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় তার অন্তত ২০টি ফ্ল্যাটের দলিলও উদ্ধার করা হয়েছে। ভূমি জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত থাকায় ২০১৯ সালে রাজউক তার বিরুদ্ধে মামলা করে। রাজউকের ৭০টি প্লটের নথি নিজ কার্যালয়ে আইনবহির্ভূতভাবে হেফাজতে রাখায় এ মামলা করা হয়, যা চলমান রয়েছে। এছাড়া মনিরের বাড়িতে পাঁচটি গাড়ি পাওয়া যায়, যার মধ্যে তিনটি গাড়ির কোনো বৈধ কাগজ ছিল না। পরে ওই গাড়িগুলোও জব্দ করা হয়েছে। 

মনিরের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও মাদক আইনে মামলার পাশাপাশি ফরেন কারেন্সি আইনেও মামলার প্রস্তুতি চলছে বলে জানিয়েছে র্যাব। সংশ্লিষ্টরা জানান, মনিরের বাসা থেকে ১০টি দেশের মুদ্রা উদ্ধার করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতি ছাড়াই তিনি এসব মুদ্রা নিজ হেফাজতে রেখেছিলেন। 

মনির গ্রেফতারের সংবাদ প্রকাশের পর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি জানিয়েছে, মনিরকে স্বর্ণ ব্যবসায়ী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এতে সাধারণ স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের সম্মানহানি ঘটেছে। গ্রেফতার হওয়া মনির স্বর্ণ ব্যবসায়ী নয়।

এদিকে গতকাল বিকালে রাজধানীর মগবাজারে বিটিসিএল সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন (এসটিএস) উদ্বোধনকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, যেখানে দুর্নীতি হবে সেখানেই অভিযান চলবে। মেরুল বাড্ডায় র্যাবের অভিযান তারই একটি অংশ। এর আগে শুক্রবার সিরাজগঞ্জে একটি জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালানো হয়। নিরাপত্তা বাহিনীর তত্পরতায় ওই আস্তানা থেকে চার জঙ্গি আত্মসমর্পণ করে। গোপন সংবাদের ভিত্তিতেই সিরাজগঞ্জের ওই জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালায় র্যাব। দেশে আইন-শৃঙ্খলার উন্নতি হয়েছে, নিরাপত্তা বাহিনী তত্পর রয়েছে বুঝতে পেরেই জঙ্গিরা বাধ্য হয়ে আত্মসমর্পণ করেছে। তারা বুঝেছে, দেশকে আর অন্ধকারে নিয়ে যাওয়া যাবে না। আর এ নির্ভরতার জায়গাটি এসেছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সার্বক্ষণিক নজরদারির কারণে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন