কভিড-১৯

মহামারী কীভাবে অর্থনীতিকে পুনর্বিন্যাস করতে পারে

কৌশিক বসু

কভিড-১৯ মহামারীর কারণে বিশ্ববাণিজ্য, বাজার সরবরাহ শৃঙ্খল ব্যবস্থায় সৃষ্টি হয়েছে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা, যা আমাদের প্রচলিত নীতিগুলোকে নিয়ে ভাবতে বাধ্য করছে। তবে কোন বিষয়টি অর্থনৈতিক কার্যক্রমকে দক্ষভাবে পরিচালনা করে, সে-সম্পর্কিত বুনিয়াদি ধারণাসহ অর্থনীতিবিদরা দীর্ঘদিন ধরে যে নীতিগুলোর কথা বলে আসছিলেন, তা নিয়ে পুনর্চিন্তার সুযোগ হিসেবেই এটিকে দেখা উচিত।

ধারণাটি আমাদের ১৭৭৬ সালে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। এটি ছিল একটি যুগান্তকারী বছর। অ্যাডাম স্মিথ তারদ্য ওয়েলথ অব নেশনসপ্রকাশ করেছেন। আমেরিকান ১৩টি প্রদেশ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে এবং একই দিনে, ১৪ জুলাই দার্শনিক ডেভিড হিউম তার মৃত্যুর কয়েক দিন আগে বন্ধুদের উদ্দেশে নৈশভোজের আয়োজন করেছিলেন। ওইদিনের পার্টিতে উপস্থিত ছিলেন অ্যাডাম স্মিথও।

স্মিথের যুগান্তকারী কাজ এবং পরবর্তী সময়ে লিওন ওয়ালরাস, স্ট্যানলি জেভনস আলফ্রেড মার্শলের অবদান অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন যোগ করেছে। আমরা জানতে পারি কেন্দ্রীয় কোনো কর্তৃপক্ষ ছাড়াই বাজারগুলো সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হতে সক্ষম, কারণ সাধারণ মানুষ তাদের অধিক আয় পণ্য ক্রয় প্রবণতার কারণে চাহিদা জোগানের মধ্যে এক ধরনের অদৃশ্য রশি টানাটানি করতে থাকে। আর কারণে দামের ওঠানামা ঘটে।

ধারণাটি আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাজারগুলো যে সামাজিক রীতিনীতির ওপর নির্ভর করত, তা মূলত অকার্যকর হয়ে ওঠে। স্বতঃসিদ্ধ অনুমানগুলোকে আমরা উপেক্ষা করি, কারণ স্বাভাবিক সময়ে এগুলো অপরিবর্তনীয় থাকে। আর পরবর্তী সময়ে আমরা সবকিছু ভুলে যাই।

তবে কভিড-১৯-এর মতো অনাহূত ঘটনা আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে কোনো প্রশ্ন করা ছাড়া বিনা বাক্য ব্যয়ে চুপচাপ বিষয়গুলো আসলে আর কতদিন মেনে নেব আমরা। লকডাউনের সময় মুম্বাইয়ে তিন মাস কাটানোর দিনগুলোয় বিষয়টি আমি উপলব্ধি করি। বিশেষ করে যখন আমার পরিবারের সদস্য বন্ধুরা আমাকে শহরের মধ্যে সৃষ্টি হওয়া কোন্দল, বিভিন্ন রকম শোডাউন এবং উত্তেজনার কথাগুলো বলছিল। মাস্ক না পরার জন্য কিংবা সামাজিক দূরত্ব রক্ষার নিয়মগুলো না মানার জন্য কিছু বাসিন্দাকে শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়েছিল, আবার অন্যরা সমালোচিত হয়েছিল লকডাউন ঘিরে এক ধরনের বাড়াবাড়ি করা নিয়ে। বাসা থেকে কেউ বের হলেই কিছু ফ্ল্যাট মালিক সমিতি তার ছবি তুলতে শুরু করেছিল, এমনকি কেউ একা বের হলেও কিংবা অন্য একজন থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চললেও তার ছবি তোলা হয়েছে এবং যুক্তি-পাল্টা যুক্তি দিয়ে বলা হয়েছে যে ধরনের আচরণ কাণ্ডজ্ঞানহীন। কেননা মহামারীর কারণে আনা আচরণগত পরিবর্তন অপ্রচলিত। তাছাড়া এখনো সবাই তাতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি, তবে দীর্ঘদিনের সামাজিক নিয়মের চেয়েও আমরা পরিবর্তিত আচরণগুলো ঘিরে অনেক বেশি সতর্ক।

বাজারও তেমন কিছু নিয়মের ওপর নির্ভর করে, যার বেশির ভাগই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিকশিত হয়েছে এবং রীতিমতো নিয়মে পরিণত হয়েছে, এমনকি কিছু বিষয় অর্থনীতিবিদদের সুস্পষ্ট অনুমানের বাইরে রয়ে গেছে। কার্ল পোল্যানি, মার্ক গ্রানোভেট্টর এবং অন্যরা যেমন যুক্তি দেখিয়েছেন যে সমাজ থেকে পৃথক অর্থনীতি অনুধাবনযোগ্য নয়। অর্থনীতিকে কার্যকরভাবে পরিচালনার জন্য সামাজিক প্রাতিষ্ঠানিক কিছু পূর্বশর্তের উপস্থিতি জরুরি। কিন্তু অর্থনীতি পেশা গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞানগুলোকে ব্যাপকভাবে উপেক্ষা করেছে কিংবা কোনো রকম সম্মতি দিয়ে পাশে সরিয়ে রেখেছে।


আমি আমারবিয়ন্ড দি ইনভিজিবল হ্যান্ডগ্রন্থে যুক্তি দেখিয়েছি যে বাণিজ্য   বিনিময় শুধু অর্থনীতিবিদরা যেসব প্রযুক্তিগত অনুমানগুলো ঘিরে সচেতন, যেমন প্রান্তিক উপযোগ হ্রাসের আইন ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে না; বরং অন্যান্য শর্তের ওপরও নির্ভরশীল। যদিও কোনো প্রশ্ন ছাড়া আমরা তা মেনে নিইনি। তাছাড়া এসবের মধ্যে রয়েছে একে অন্যকে বিশ্বাস করা এবং যোগাযোগের ক্ষমতা, যা আমাদের দর কষাকষির মাধ্যমে একটি জায়গায় পৌঁছতে সক্ষম করে। তবে কোনো অর্থনীতিবিদ কিন্তু অনুমান হিসেবেকথা বলতে পারেনবিষয়টি লিখছেন না। এটি প্রদত্ত হিসেবে বিবেচিত হয়।

দুর্ভাগ্যক্রমে, অদৃশ্য হাত কীভাবে কাজ করে, তা বোঝার ক্ষেত্রে পদ্ধতিটি আমাদের বড় ধরনের অস্পষ্টতার দিকে নিয়ে যায়। সংরক্ষণবাদী অনেক অর্থনীতিবিদ জোর দিয়েছেন সরকার যতক্ষণ পর্যন্ত স্বতন্ত্র স্বাধীনতার বিষয়গুলো হস্তক্ষেপ নিয়ন্ত্রণ না করবে ততক্ষণ পর্যন্ত অর্থনীতি দক্ষতার সঙ্গে কাজ করবে। অদৃশ্য হাতের মাধ্যমেই বিষয়গুলো সম্পাদিত হবে। কিন্তু তারা ভুলে যায় যে ওই দক্ষতা অর্জনের জন্য আমাদের আচরণগত কিছু নিয়ন্ত্রণ দরকার, যেমন অন্য ব্যবসায়ীদের মুখে ঘুষি না দেয়া এবং তাদের পণ্য  নিয়ে না পালানো।

ধরনের ত্রুটিগুলো আমাদের নীতিনির্ধারণে বড় ধরনের ভুলের দিকে নিয়ে যায়, যেমনওয়াশিংটন কনসেন্সেস’; যা অর্থনীতিতে সরকারের হস্তক্ষেপ রোধ এবং আর্থিক ঘাটতি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের পক্ষে ছিল। অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিত্জ যেমন দেখিয়েছেন, তথাকথিত ওই ওয়াশিংটন কনসেন্সেস বা ওয়াশিংটন ঐক্য মূলত ওয়াশিংটন নগরীর ১৫ ১৯তম রাস্তার মধ্যে আটকে ছিল; যেখানে মার্কিন ট্রেজারি বিভাগ, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বিশ্বব্যাংক অবস্থিত। এমনকি নীতিগুলো প্রয়োজনীয় সামাজিক প্রাতিষ্ঠানিক শর্তগুলো পূরণ করেছে কিনা, তা বিবেচনা না করেই নতুন ওই সনাতন পন্থায় উন্নয়ন অর্থনীতির ওপর জোর দেয়া হয়েছিল। অবাক হওয়ার কিছু নেই, ব্যবস্থাগুলো প্রায়ই ব্যর্থ হয়।

সৌভাগ্যক্রমে, বর্তমানে ক্রমবর্ধমানভাবে স্বীকৃত বিষয়টি হচ্ছে, মূল্য সমন্বয় একমাত্র এমনকি প্রয়োজনীয় উপাদান নয়; যা বাজারকে সহজবোধ্য করতে সাহায্য করতে পারে। মাইকেল রিখটার অ্যারিয়েল রুবিনস্টাইন তাদের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখিয়েছেন যে বাজারকে বিভিন্নভাবে বোঝা যেতে পারে, যার মধ্যে কিছু বিষয় রয়েছে, যা সম্পূর্ণ সাময়িক নিয়মের ওপর নির্ভর করে। বেশির ভাগ পরিবারে, এমনকি বড় পরিবারগুলোয়ও রেফ্রিজারেটার ক্রয়ের পর তা ব্যবহারের জন্য খোলামেলা কোনো  পরিসরে রেখে দেয়া হয় এবং দামের বিষয়টি তেমনি চিহ্নিত করে রাখা হয় না। তবে মজুদ করার পর মুহূর্তেই কিন্তু এটি ফুরিয়ে যাচ্ছে না। সামাজিকভাবে অনেক ধরনের আচরণই নিষিদ্ধ এবং কিছু সমাজে নিষেধাজ্ঞাগুলো মনস্তাত্ত্বিকভাবে এতটাই গভীরতার সঙ্গে গৃহীত হয়েছে যে এগুলোকে কার্যকর করার জন্য বাইরে কোনো কর্তৃপক্ষের কর্তৃত্বের প্রয়োজন হয় না।

অর্থনীতিগুলোকে আরো বেশি ন্যায়সংগত উৎপাদনশীল করার জন্য আমাদের যে আদর্শগুলোকে উৎসাহিত করা উচিত, চলমান পরিস্থিতি সম্ভবত সে সম্পর্কিত আরো বেশি বিস্তৃত গবেষণার পথ খুলে দেয়। কভিড-১৯ মহামারী স্বতঃস্ফূর্তভাবে চ্যালেঞ্জগুলো সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করেছে। পাশাপাশি আকর্ষণীয় কিছু গবেষণাও প্রকাশ হতে শুরু করেছে। উদাহরণস্বরূপ, সম্প্রতি উইয়ং লিম পেঙ্গফেই ঝাং পরীক্ষাগারে গবেষণা করে দেখিয়েছেন যে টিকা দেয়ার পক্ষে কীভাবে আচরণগত নিয়মগুলো স্বেচ্ছায় উত্থিত হতে পারে এবং তা কীভাবে সম্ভাব্য হার্ড ইমিউনিটি অর্জনে জনগণকে সহায়তা করে। তবে সব শোভন নিয়ম যেমন স্বেচ্ছায় উত্থিত হয় না, তেমনি রূপান্তর করার আগে সমাজগুলোকে ধীরে ধীরে বিবর্তন প্রক্রিয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। এর পরিবর্তে বরং সমসাময়িক গবেষণা আমাদের পছন্দসই নিয়মগুলোকে আলাদা করতে সক্ষম করে যেন আমরা তখন সচেতনভাবেই নিয়মগুলো পরিপালনের চেষ্টা করতে পারি।

উদাহরণস্বরূপ, মহামারী চলাকালীন আমরা শিখেছি যে আমাদের পরস্পরের থেকে ছয় ফুট দূরত্ব ( মিটার) মেনে চলতে হবে এবং মুখে মাস্ক পরতে হবে। নিয়মগুলো কিন্তু আমরা স্বেচ্ছায় পালন করছি না কিংবা যারা মারা গেছেন, তারা কেবল নিয়মগুলো অগ্রাহ্য করার জন্য মৃত্যুবরণ করেছেনব্যাপারটি এমনও নয়। কিন্তু এপিডেমিওলজিস্টদের গবেষণা আমাদের নিয়মগুলো মেনে চলার বিষয়টি শিখিয়েছে এবং সরকারগুলো তা মেনে চলতে উৎসাহিত বাধ্য করেছে। তাই আশা করা যায় যে কভিড-১৯ মহামারীর ফলে সৃষ্ট ব্যাঘাত একইভাবে অর্থনীতিবিদদেরও এমন কিছু মানদণ্ড শনাক্ত করতে উৎসাহিত করবে, যা আমাদের অনেক বেশি ন্যায়সংগত, সমৃদ্ধ এবং টেকসই বিশ্ব গড়ে তুলতে সহায়তা করবে।

[স্বত্ব:
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
]

 

কৌশিক বসু: বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ আমেরিকার কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক

ভাষান্তর: রুহিনা ফেরদৌস

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন