কভিড ডিভিডেন্ড পেতে যাচ্ছে থাইল্যান্ড-ভিয়েতনাম

বণিক বার্তা ডেস্ক

এশিয়ার অন্য দেশগুলোর মধ্যে অধিকাংশ যখন কভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাবে পর্যুদস্ত, ঠিক সে মুহূর্তে করোনা সংক্রমণের দুঃস্বপ্নকে পরাজিত করে আবারো সচল হয়ে উঠছে থাইল্যান্ড ভিয়েতনাম। লকডাউন শেষে আবারো পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠেছে ব্যাংকক, হ্যানয়, হো-চি-মিন সিটিসহ দেশ দুটির অর্থনৈতিক কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত শহরগুলো। সংক্রমণের মুহূর্তে জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষায় সরকার, ব্যক্তি খাত জনসাধারণের সুশৃঙ্খল এবং সমন্বিত পদক্ষেপ কার্যক্রমের কারণেই এটি সম্ভব হয়েছে। ফলে আবারো আগের মতোই স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে শহরগুলোর চিত্র। রাস্তায় আগের মতোই ফিরে এসেছে ট্রাফিক জ্যাম। কোলাহলও ফিরে এসেছে সংক্রমণের ভয়ভীতি ছাড়াই।

ব্যাংককের নিকটবর্তী সমুদ্রসৈকতগুলোয় এখন দর্শনার্থীদের ভিড় দেখা যাচ্ছে। স্কুল-রেস্তোরাঁ-সিনেমা-পাবএর সবই খুলে দিয়েছে ভিয়েতনাম। অনুমতি মিলেছে দর্শকপূর্ণ স্টেডিয়ামে ফুটবল ম্যাচ আয়োজনের। অধিকাংশ ভিয়েতনামিই এখন আর মাস্ক পরে ঘোরার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে করছেন না।

সংক্রমণের দ্বিতীয় স্রোত বয়ে যাওয়ার আশঙ্কা এখন সব দেশেই। তার পরও কয়েক সপ্তাহ ধরে সংক্রমণ শূন্যে থাকায় সব খুলে দেয়ার সাহস পেয়েছে থাই ভিয়েতনামি কর্তৃপক্ষ। অন্য দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশ, এমনকি যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপও এখনো সংক্রমণে লাগাম টানতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে, সেখানে দেশ দুটিতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসা নিঃসন্দেহে অনেক বড় অর্জন।

তার পরও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে বড় দুই অর্থনীতির দেশ দুটির পক্ষে নিজেদের হারানো অবস্থান ফিরে পাওয়া নিয়ে সংশয় থেকেই যায়। যেখানে অন্যান্য দেশের অবস্থান বিপর্যস্ত, ঠিক সে মুহূর্তে স্বাভাবিক অবস্থায় প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে তুলনামূলক বাড়তি বিনিয়োগ রফতানি আদেশের মাধ্যমে কভিড ডিভিডেন্ড আদায় করে নেয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে দেশ দুটির সামনে। চীনের পর শুরুর দিকে যেসব দেশে নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছিল, থাইল্যান্ড ভিয়েতনাম সেসব দেশের অন্যতম এবং সংকটের দুঃসহ যন্ত্রণা কাটিয়ে দ্রুত প্রত্যাবর্তনের দিক থেকেও দেশ দুটি অগ্রগামী।

অথচ সংক্রমণ পরিস্থিতির শুরুর দিকে থাইল্যান্ডের অবস্থা ছিল বেশ নড়বড়ে। এক পর্যায়ে রেস্তোরাঁ, বার, পার্ক অন্যান্য জনসমাগমস্থল বন্ধ করার মাধ্যমে সংক্রমণ ঠেকাতে বেশ কড়া পদক্ষেপ নেয় দেশটির সরকার। নিষিদ্ধ করা হয় অ্যালকোহল বিক্রি। জারি করা হয় রাত্রিকালীন জরুরি সান্ধ্য আইন। তবে সামাজিক নিরাপত্তার গাইডলাইন অনুসরণের নন-রিটেইল কোম্পানিগুলোকে কাজ চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেয়া হয়। সহায়তা চাওয়া হয় সবচেয়ে ধনী থাই পরিবারগুলোর কাছে। এসব পরিবারের অনেকেই এগিয়ে আসেন চিকিৎসা খাতে সহায়তা কর্মসংস্থান ধরে রাখার অঙ্গীকার নিয়ে।

কনগ্লোমারেট বি গ্রিমের থাই-জার্মান বংশোদ্ভূত বিলিয়নেয়ার চেয়ারম্যান হ্যারাল্ড লিংক বলেন, থাইল্যান্ডের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা অনেক চমত্কার এবং লকডাউনে কার্যক্রম ব্যাহত হওয়াটা যাতে সর্বনিম্ন মাত্রায় থাকে, সেজন্য সরকারও চিকিৎসক, ব্যবসায়ী চেম্বার, ব্যাংকার সংগঠন ব্যক্তি খাতের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়েছে। জনগণ যাতে খেয়ে-পরে কাজ করে যেতে পারে, সেজন্য কারখানা সুপারমার্কেটগুলোও খোলা রাখা হয়।

ভিয়েতনামের সবচেয়ে বড় দুটি শহর হলো হ্যানয় হো-চি-মিন সিটি। শহর দুটিতে দেশটির সরকার এপ্রিলে তিন সপ্তাহের জন্য বেশ কঠোর সামাজিক দূরত্বের নীতির প্রয়োগ শুরু করে। দেশটিকে বিশ্বের সবচেয়ে আগ্রাসীভাবে সংক্রমণ শনাক্তকারী অঞ্চলে পরিণত করে ভিয়েতনামি সরকার। সব ধরনের সংক্রমণ শনাক্তের পাশাপাশি সংক্রমণের ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিদেরও রাষ্ট্রীয় ফ্যাসিলিটি বা বাড়িতে কোয়ারেন্টিন করে রাখা হয়।

শক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ তা বাস্তবায়নের ফলও হাতে হাতে পেয়েছে দেশ দুটি। থাইল্যান্ডে সব মিলিয়ে নভেল করোনাভাইরাসে সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে হাজার ১০০ জনের। ভিয়েতনামের ক্ষেত্রে তা অনেক কম, মাত্র ৩৩২ জন।

অন্যান্য দেশে সংক্রমণ শনাক্তের সংখ্যা কম হওয়ার পেছনে প্রধানত পর্যাপ্তসংখ্যক নমুনা পরীক্ষা না হওয়াকেই দায়ী করা হয়ে থাকে। কিন্তু ভিয়েতনামের ক্ষেত্রে অভিযোগটি অমূলক। আবার থাইল্যান্ডেও সংক্রমিতের সংখ্যা ইচ্ছাকৃতভাবে গোপন করে যাওয়া হয়েছে, এমন কোনো প্রমাণ মেলেনি। উভয় দেশই এখন সামাজিক দূরত্ব অন্যান্য স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তা নীতির প্রয়োগ সাপেক্ষে কিছুসংখ্যক বাণিজ্যিক ফ্লাইট চালু করতে দেয়ার কথা ভাবছে।

দেশ দুটির মধ্যে ভিয়েতনামের সম্ভাবনা এখন সবচেয়ে বেশি। দেশটির কমিউনিস্ট নীতিনির্ধারকদের প্রক্ষেপণ বলছে, চলতি বছর দেশটিতে প্রবৃদ্ধি হতে পারে শতাংশ হারে। অন্যদিকে পর্যটননির্ভর থাই অর্থনীতিতে সংকোচন হতে পারে - শতাংশ। এদিক থেকে ১৯৯৮ সালের এশীয় আর্থিক সংকটের পর সবচেয়ে বাজে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে দেশটিকে।

মহামারী শুরুর আগে দুটি দেশের উৎপাদন খাতে প্রচুর বিদেশী বিনিয়োগ আসছিল। যুক্তরাষ্ট্র চীনের মধ্যকার বাণিজ্যসংক্রান্ত অস্থিরতার মধ্যে ঝুঁকি প্রশমনকারী বিনিয়োগ হিসেবে চীনাসহ অনেক বহুজাতিক কোম্পানিই দেশ দুটিতে বিনিয়োগের পথে এগোচ্ছিল। বর্তমান পরিস্থিতিতে নভেল করোনাভাইরাস সম্ভাবনাকে আরো অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে, বিশেষ করে যখন সবাই শুধু চীনা ভোক্তা সরবরাহকারীদের ওপর নির্ভর করে ব্যবসা চালানোর বিপদটুকু হাড়ে হাড়ে অনুধাবন করতে পেরেছে।

হো-চি-মিন সিটিভিত্তিক বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান ড্রাগন ক্যাপিটালের ডেপুটি চিফ ইনভেস্টমেন্ট অফিসার তুয়ান লি আন প্রসঙ্গে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র চীনের মধ্যকার বাণিজ্যযুদ্ধ আরো জটিল রূপ নেবে, কথা সবাই বুঝতে পারছে। আমার মনে হচ্ছে, এখান থেকে ভিয়েতনাম লাভবান হবে।

অ্যাপল, নিনটেন্ডো গুগল মহামারীর আগেই নিজ উৎপাদন কার্যক্রমের একাংশ ভিয়েতনামে স্থানান্তর করেছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে অন্যরাও প্রতিষ্ঠানগুলোকে অনুসরণ করতে পারে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন