স্বীয়
পরিচয়েই তিনি
ছিলেন ভাস্বর
একজন মানুষ
গড়ার কারিগর।
ছিলেন ইংরেজি
মাধ্যমে দেশের
প্রথম সারির
বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে
অন্যতম সানবীমসের
প্রতিষ্ঠাতা এবং
বিদ্যালয়প্রধান, একজন
প্রতিষ্ঠিত বিরল
শিক্ষাবিদ। তিনি
ছিলেন দেশের
অন্যতম শিল্পপতি
ও কেয়ারটেকার
সরকারের সাবেক
উপদেষ্টা সৈয়দ
মঞ্জুর এলাহীর
সহধর্মিণী।
আপনজন হতে
হলে যে
আত্মীয় হতে
হয় না,
তার একটা
জ্বলন্ত প্রমাণ
রেখে গেলেন
তিনি। পুরো
পৃথিবীতেই তিনি
ছড়িয়েছেন তাঁর
অনুসারী, তাঁর
শুভাকাঙ্ক্ষী। তাই
তো তাঁর
চিরপ্রস্থানে সামাজিক
যোগাযোগমাধ্যমে উঠেছে
শোকের ঝড়।
পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে
থাকা প্রতিষ্ঠিত
ও উচ্চশিক্ষায়
অধ্যয়নরত তাঁর
অগণিত ছাত্রছাত্রী
ব্যক্ত করেছেন
তাদের আবেগ
জড়ানো প্রতিক্রিয়া।
তাঁর সংস্পর্শে
আসা অগণিত
শুভানুধ্যায়ী ও
গুণগ্রাহীরা জানিয়েছেন
তাঁদের হূদয়ের
গভীর থেকে
উৎসারিত শ্রদ্ধা
এবং ভালোবাসা।
তাঁর পরিবারের
প্রতি জানিয়েছেন
গভীর সমবেদনা।
কিন্তু করোনা
প্রাদুর্ভাবের কারণে
সৃষ্ট চলমান
অচলাবস্থায় তাঁর
শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে
যোগ দিয়ে
তাঁকে শেষ
সম্মান ও
শেষ বিদায়
জানাতে না
পারার কষ্টটা
বুকের গভীরে
থেকে পীড়িত
করতে থাকবে
সবাইকে বহুদিন।
তাঁর প্রতি
যথাযথ শ্রদ্ধাঞ্জলি
জ্ঞাপন করার
জন্য উপযুক্ত
ব্যক্তি নই
আমি, একথা
বলার অপেক্ষা
রাখে না।
কেননা তাঁকে
খুব কাছ
থেকে দেখার
তেমন সুযোগ
হয়নি আমার।
যেটুকু দেখেছি
তাঁকে বা
জেনেছি তাঁর
সম্পর্কে, সেটুকু
তাঁরই বিদ্যালয়ের
তিন শিক্ষার্থীর
অভিভাবক হিসেবে
অথবা অন্যান্য
শিক্ষার্থীর অভিভাবকদের
প্রতিক্রিয়া থেকে।
শিক্ষাই যে
জাতির মেরুদণ্ড,
একটি জাতির
উন্নতির সোপান,
সেই মূলমন্ত্র
হূদয়ে ধারণ
করে নিরলস
পরিশ্রম করে
গেছেন তিনি
সুদীর্ঘ ৪৬
বছর। নিজগৃহের
বসার ঘরের
অস্থায়ী ব্যবস্থা
থেকে শুরু
করে সেটাকে
প্রতিষ্ঠিত করেছেন
উত্তরায় অবস্থিত
বিদ্যালয়টির সুবিশাল
নিজস্ব ভবনে।
প্রাথমিক শিক্ষা
ব্যবস্থা থেকে
শুরু করে
দীর্ঘ পথ
পাড়ি দিয়ে
উন্নীত করেছেন
উচ্চ মাধ্যমিক
বা এ-লেভেল
পর্যন্ত। পরিচিত
কয়েক বন্ধু
থেকে শিক্ষকের
সংখ্যা বৃদ্ধি
পেয়েছে ১৬০-এ।
হাতেগোনা কয়েকজন
ছাত্র থেকে
তা ১
হাজার ১০০
ছাড়িয়ে গেছে।
এগুলো নিঃসন্দেহে
বিশাল অর্জন,
কিন্তু এসব
ভৌত বিষয়ের
উল্লেখে তাঁর
অর্জনের যৎসামান্যই
প্রকাশ পায়।
কেননা চাইলেই
এই ভৌত
পরিমাপকে তিনি
বাড়াতে পারতেন
বহুগুণ। কিন্তু
পরিমাণের চেয়ে
গুণগত মান
তাঁর কাছে
প্রাধান্য পেয়েছে
সবসময়। প্রতি
সেকশনে শিক্ষার্থীর
সংখ্যা সীমিত
রেখে তিনি
প্রতিটি শিক্ষার্থীর
প্রতি শিক্ষকের
মনোযোগ এবং
যত্নের নিশ্চয়তা
দিয়েছেন। শিক্ষাকে
বাণিজ্যে পরিণত
করার যে
অসুস্থ বল্গাহীন
প্রয়াস চলছে
চারদিকে, তার
মধ্যে থেকেও
সেই প্রলোভনের
রাশ তিনি
টেনে রেখেছিলেন
অত্যন্ত দৃঢ়
হাতে। তাই
তো প্রচণ্ড
চাহিদা থাকা
সত্ত্বেও শিক্ষার
গুণগত মানে
আপস করা
হবে সন্দেহে
বিদ্যালয় ভবনের
সংখ্যা বাড়াননি,
কোনো তদবিরকে
প্রশ্রয় দেননি
এতটুকু।
শিক্ষার্থীদের নিজের
সন্তানের মতোই
ভালোবাসতেন। শুধু
তাদের প্রত্যেককে
আলাদা করে
চিনতেন এমন
নয়, শিক্ষার্থীদের
মা-বাবা
বা অভিভাবকদেরও
চিনতেন আলাদা
করে। বিস্ময়ে
অবাক হতাম
যখন শিক্ষক-অভিভাবক
বৈঠকের দিনে
অথবা বিদ্যালয়ের
কোনো অনুষ্ঠানের
দিনে দেখা
হলে সুনির্দিষ্টভাবে
শিক্ষার্থীদের নিয়ে
অভিভাবকদের সঙ্গে
কথা বলতে
দেখতাম। শিক্ষার্থীরাই
ছিল তাঁর
ধ্যান-জ্ঞান,
তাঁর সবকিছু।
তাই তো
বিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে
তাঁর বাণীতে
তিনি লিখেছেন—শিক্ষার্থীদের
জানা এবং
তাদের সঙ্গে
বেড়ে ওঠাই
ছিল তাঁর
অহংকার, তাঁর
অধিকার (To know
and to grow with my students has been my pride and privilege)।
প্রতিটি শিক্ষার্থীর
অপরিসীম সম্ভাবনায়
ছিল তার
অগাধ বিশ্বাস।
পূর্ণ সম্ভাবনায়
যেন বেড়ে
ওঠে তাঁর
প্রতিটি সন্তান
(শিক্ষার্থী) সেদিকে
ছিল সজাগ
দৃষ্টি, কঠোর
সাধনা। আর
সেজন্যই বিদ্যালয়
পরিচালনায় তাঁর
কঠোর প্রশাসনের
পরিচয় মেলে।
প্রশাসনে কঠোরতা
থাকলেও তাঁর
বন্ধুসুলভ ব্যক্তিত্বে
আকৃষ্ট হতে
হতো সবাইকে।
মিষ্টি হাসিতে
তিনি বরণ
করতেন সবাইকে
বিদ্যালয়ের সব
অনুষ্ঠানে, শিক্ষক-অভিভাবক
বৈঠকের দিনে।
মৃদু হাসিটা
যেন ছিল
তাঁর সার্বক্ষণিক
অলংকার। শিক্ষার্থীদের
সম্ভাষণ করতেন
সস্নেহে। যেকোনো
অনুষ্ঠানে স্মিত
হাসি মিশ্রিত
উৎসাহব্যঞ্জক বাণীতে
ঝরে পড়ত
শিক্ষার্থীদের প্রতি
তাঁর ভালোবাসা,
তাঁর আবেগ,
তাঁর একাগ্রতা,
তাঁর একনিষ্ঠতা।
তাঁর এক
সাবেক শিক্ষার্থী
লিখেছেন, বিদ্যালয়ের
বারান্দায় হাঁটার
সময় কারো
সঙ্গে দেখা
হলে—তা
সে শিক্ষার্থী,
শিক্ষক বা
কর্মচারী যেই
হোক না
কেন—তিনি
এমনভাবে সম্ভাষণ
করতেন, যাতে
মিশে থাকত
নম্রতা, যত্ন
এবং কর্তৃত্বের
এক অপূর্ব
মিশ্রণ; সুদক্ষ
নেতৃত্বের এক
অপরূপ প্রদর্শন।
তাঁর বলিষ্ঠ
ব্যক্তিত্ব ও
নেতৃত্বের মোহ
ছাড়তে না
পারায় পাস
করে যাওয়া
শিক্ষার্থীরা সবাই
তাদের সন্তানদের
তাঁর বিদ্যালয়ে
পাঠানোর জন্য
অধীর থাকে
সবসময়।
আরেক
শিক্ষার্থী লিখেছে,
স্কুলের লোগোতে
সূর্যের সাতটি
কিরণ যে
গুণাবলি বোঝায়—জ্ঞান,
নেতৃত্ব, দেশপ্রেম,
সততা, নম্রতা,
আত্মবিশ্বাস ও
প্রতিশ্রুতি—নীলুফার
মঞ্জুর নিজে
সেই সবগুলো
গুণ একসঙ্গে
ধারণ করতেন
এবং সেজন্যই
তাঁর পক্ষে
সম্ভব হয়েছিল
তাঁর সন্তানসম
শিক্ষার্থীদের মাঝে
এই গুণাবলির
প্রতিফলন ঘটানো।
নিলুফার মঞ্জুর
আর নেই—এই
সত্য মানতে
কষ্ট হয়।
কষ্ট হচ্ছে
আমার, আপনার,
আমাদের সবার।
সেই অনুভূতি
থেকেই এক
অভিভাবক তার
প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত
করেছেন এভাবে—তিনি
নেই, আমি
মানতে পারি
না। এমন
মহান শিক্ষক
কীভাবে চলে
যেতে পারেন?
এমন একজন
প্রতিষ্ঠান স্থাপনকারী
কীভাবে চলে
যেতে পারেন?
পৃথিবীব্যাপী ছড়ানো
তাঁর এমন
শিক্ষিত, সুপ্রতিষ্ঠিত
অথচ বিনম্র
শিক্ষার্থীরা তাদের
পথিকৃৎ শিক্ষককে
কীভাবে যেতে
দেবেন? এ
হবার নয়!
তিনি শুধু
তাঁর বাসস্থান
পরিবর্তন করেছেন।
তিনি সৃষ্টিকর্তার
সন্নিকটে গেছেন
তাঁর কর্মের
পুরস্কার নিতে।
সত্যিই তিনি
গেছেন সৃষ্টিকর্তার
কাছে তাঁর
কর্মের পুরস্কার
নিতে। ফিরবেন
না আর।
তবে যে
ক্ষণজন্মা শ্রদ্ধেয়জনরা
সময়কে জয়
করতে পেরেছেন,
নিলুফার মঞ্জুর
তাঁদের মধ্যে
শুধু একজন
মাত্র নন,
অন্যতম। আর
তাই সবার
হূদয়ে লালিত
বিচ্ছিন্ন স্মৃতিগুলোর
সমষ্টি তাঁর
অনুপস্থিতিতেই তাঁকে
প্রকাশ করতে
থাকবে, আজীবন...।
মোহাম্মদ মামদুদুর রশীদ:
ব্যাংকার ও
প্রাবন্ধিক