অর্থনীতির পতন ঠেকাতে প্রণোদনা

ধনীদের পদাঙ্ক অনুসরণে বিপদে পড়তে পারে দরিদ্ররা

বণিক বার্তা ডেস্ক

নভেল করোনাভাইরাস বৈশ্বিক অর্থনীতিতে বড় ধরনের ক্ষত তৈরি করবে বলে আশঙ্কা করছেন সবাই। মহামারীটির কারণে যে কেবল উৎপাদননির্ভর ধনী দেশগুলোই মন্দার আশঙ্কায় রয়েছে, তা নয়। উন্নয়নশীল দেশগুলোকেও অর্থনীতির পতন ঠেকাতে রীতিমতো যুঝতে হচ্ছে। বড় অর্থনীতিগুলোর তো তাও শক্তিশালী রিজার্ভ রয়েছে, যার সহায়তায় প্রাথমিক ধাক্কা সামাল দেয়ার ক্ষমতা তাদের রয়েছে। কিন্তু অগ্রসরমান দরিদ্র দেশগুলো অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে অনেকটাই ধনী দেশগুলোর ওপর নির্ভরশীল।

কারণে অর্থনীতিকে প্রণোদনা দিতে ধনী দেশগুলো যে ধরনের প্যাকেজ ঘোষণা করছে, উন্নয়নশীল দেশগুলো সহজে সে ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারছে না। এমনকি উন্নত অর্থনীতির পদাঙ্ক অনুসরণ করলে তা দরিদ্র দেশগুলোর জন্য হিতে বিপরীত হয়ে দাঁড়াতে পারে। কারণ ধনী দরিদ্র দেশগুলোর সামষ্টিক অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট একেবারেই ভিন্ন।

করোনা মহামারী প্রতিরোধে লকডাউন পরিস্থিতিতে বিশ্বজুড়ে ঘরবন্দি ৩০০ কোটির বেশি মানুষ বিপাকে পড়েছে। চাহিদা সরবরাহ সংকটের কারণে উৎপাদনমুখী কোম্পানিগুলোও সংকটে রয়েছে। অবস্থায় প্রকৃত সুদহার কমানো হলে গৃহস্থালি করপোরেট খাত হয়তো উপকৃত হবে, তবে জাতীয় অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। প্রকৃত সুদহার নিয়ে কাজ করার অর্থ হলো, এখানে মুদ্রাস্ফীতিকে আমলে নেয়া হচ্ছে না। আর মুদ্রাস্ফীতির বিষয়টি এড়িয়ে গেলে বৈদেশিক তহবিলের প্রবাহ থমকে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়।

বিভিন্ন দেশের সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য সংকলন করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে ব্লুমবার্গ। এতে দেখা গেছে, চলমান সংকটে অগ্রসরমান দেশগুলো একের পর এক প্রকৃত সুদহার কমানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছে। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া বার্কেলের অর্থনীতিবিদ ব্যারি ইচেনগ্রিন বলেছেন, উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্ষেত্রে বিষয়টি নিয়ে আমাদের সতর্ক হতে হবে। এমনিতেই পণ্যবাজারে দরপতন, সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়া, বাণিজ্য থমকে যাওয়া ইত্যাদির প্রভাব তাদের ওপরই বেশি পড়ছে। এর ওপর বিদেশী তহবিলের প্রবাহ থমকে গেলে এসব দেশকে মূলধন সংকটে পড়তে হবে। আর মূলধন ঘাটতি হলো সব সংকটের মূল উৎস।

ব্যারি ইচেনগ্রিন তার সহযোগী অর্থনীতিবিদ রিকার্ডো হাউসমান তাদের অরিজিনাল সিন তত্ত্বের জন্য বিখ্যাত। নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে এশিয়ায় যে অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছিল, তার অন্তর্নিহিত কারণ হিসেবে তারা বৈদেশিক অর্থে ঋণগ্রহণের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতাকে দায়ী করেছিলেন। অগ্রসরমান অর্থনীতিগুলো এখনো প্রবণতা থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে আসতে পারেনি।

উন্নয়নশীল দেশগুলো অবশ্য নির্ভরশীলতা থেকে উত্তরণের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। তারা স্থানীয় ঋণবাজার গড়ে তুলেছে। একই সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানোর দিকেও জোর দিয়েছে যেন বিপদের সময় তা কাজে আসে। কিন্তু তার পরও পুরনো সমস্যাটি রয়েই গেছে। ২০১৩ ২০১৫ সালের দুটি ঘটনা তারই প্রমাণ দেয়। ২০১৩ সালে কোয়ান্টিটেটিভ ইজিং নীতি থেকে সরে আসার ঘোষণা দেয় যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ (ফেড) এতে মার্কিন ট্রেজারি ইল্ডের হারও বেড়ে যায়, যার কারণে বিপাকে পড়ে উন্নয়নশীল দেশগুলো। এছাড়া ২০১৫ সালে চীন ইউয়ানের অবমূল্যায়ন করলে অগ্রসরমান দেশগুলো মূলধন হারাতে থাকে।

একদিক থেকে এবার পরিস্থিতি আগের চেয়েও খারাপ। ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্সের (আইআইএফ) তথ্য বলছে, চীনে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ব্যাপক হারে বাড়তে থাকার পর অর্থাৎ ২১ জানুয়ারি থেকে গত ৭০ দিনে উন্নয়নশীল দেশগুলোয় অনিবাসীদের হাতে থাকা পোর্টফোলিও বিনিয়োগ কমেছে প্রায় হাজার ২৫০ কোটি ডলার। আর্থিক সংকটের সর্বশেষ তিন ঘটনার কোনোবারই উল্লিখিত সময়সীমায় অনিবাসীদের পোর্টফোলিও বিনিয়োগ আড়াই হাজার কোটি ডলারের বেশি কমেনি।

আরেকটি বিষয়, বর্তমান পরিস্থিতিতে উন্নয়নশীল দেশগুলো আর্থিক সম্প্রসারণ নীতি গ্রহণ করলে বৈদেশিক তহবিল সংকট তৈরি হতে পারে। ফলে দেশগুলো ঋণমান পতনের ঝুঁকিতে পড়ে যাবে। মেক্সিকো দক্ষিণ আফ্রিকার ঋণমান এরই মধ্যে কমেছে। ফিচ রেটিংস কম্বোডিয়ার ঋণমান কমিয়ে জাংক-এর এক ধাপ ওপরে রেখেছে।

কারণে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে করোনার ধাক্কা সামাল দিতে নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অন্যথায় কেবল ধনী দেশগুলোর দেখানো পথে চলতে গেলে তার ফল বিপরীত হতে পারে। ব্লুমবার্গ

 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন