অনুদানের চলচ্চিত্রেও অবহেলিত ভাষা আন্দোলন!

রাইসা জান্নাত

চলচ্চিত্র শিল্পে মেধা সৃজনশীলতাকে উৎসাহিত করা এবং বাংলাদেশের আবহমান সংস্কৃতি সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে স্বাধীনতা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, মানবীয় মূল্যবোধসম্পন্ন জীবনমুখী, রুচিশীল শিল্পমানসমৃদ্ধ পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা সহায়তা প্রদানের উদ্দেশ্যে... নীতিমালা প্রণয়ন করা হলো’—এমনটাই বলা আছে উন্নত মানের পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণে সরকারি অনুদান প্রদান নীতিমালা ২০১২ (সংশোধিত)-এর উপক্রমণিকায়

বিবেচনায় স্বাধীনতা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সৃষ্টিতে যেহেতু ১৯৫২ সালে সংঘটিত ভাষা আন্দোলন অন্যতম সোপান হিসেবে ভূমিকা রেখেছিল, সেহেতু বিষয়কে কেন্দ্র করেও চলচ্চিত্র নির্মাণে সরকার নির্মাতা, প্রযোজকউভয় পক্ষের সমান আগ্রহের দাবি রাখে যদিও দুঃখজনক হলেও সত্যি, কোনো পক্ষ থেকেই সেই অর্থে ভাষা আন্দোলন নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণে বিশেষভাবে উদ্যোগ নেয়া হয়নি


ভাষা আন্দোলনের প্রায় ছয় দশক পেরিয়ে গেলেও জহির রায়হানের জীবন থেকে নেয়া (১৯৭০), শহীদুল আলম খোকনের বাঙলা (২০০৬ ) খুব সম্প্রতি তৌকীর আহমেদের ফাগুন হাওয়ায় নামের ছবিটি ছাড়া ইতিহাসের সেই তাত্পর্যময় ঘটনা সেভাবে উঠে আসেনি চলচ্চিত্রের পর্দায় এমনকি সরকারি অনুদানের তালিকাতেও দেখা মেলে না ভাষা আন্দোলন নিয়ে তরুণ নির্মাতাদের পক্ষ থেকে দেয়া চলচ্চিত্রের প্রস্তাবনা কিংবা বিষয়ে ছবি নির্মাণের নির্দিষ্ট কোনো পদক্ষেপ

সর্বশেষ ২০১৮-১৯ অর্থবছরেও চলচ্চিত্রে সরকারি অনুদান প্রদানের তালিকায় ভাষা আন্দোলন নিয়ে কোনো চলচ্চিত্র প্রস্তাবের উল্লেখ পাওয়া যায়নি এর আগের অনুদান প্রদানের তালিকার চিত্রও প্রায় একই মোদ্দা কথা, সরকারি অনুদানে ভাষা আন্দোলনের ওপর ছবি নেই বললেই চলে কেন নেই?

ভাষা আন্দোলন নিয়ে বিশেষ কোনো ছবি নির্মাণ না হওয়ার পেছনের দায়ভার কি কেবলই সরকারের? নাকি নির্মাতাদেরও ব্যর্থতা রয়েছে? বিষয়ে প্রশ্ন করা হয় জ্যেষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্মাতা মোরশেদুল ইসলামকে নিজের অভিজ্ঞতা বিনিময় করে মোরশেদুল ইসলাম বলেন, সরকারি অনুদানে মুক্তিযুদ্ধের ওপর প্রতি বছরই অনেক প্রস্তাব জমা পড়ে কিন্তু ভাষা আন্দোলন নিয়ে সেই অর্থে কোনো প্রস্তাব জমা পড়তে দেখা যায় না আর বিষয়কে একটি সংকট হিসেবে দেখছেন নির্মাতা

এর পেছনে নির্মাতাদের দায়ভার প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে তার উত্তর, ভাষা আন্দোলন নিয়ে বিশেষ কোনো চলচ্চিত্র নির্মাণ না হওয়ার পেছনে নির্মাতাদেরও দায় রয়েছে তার ভাষ্যে, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ছবি নির্মাণের বিষয়টি আমাদের যতটা টেনেছে, ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গে ছবি নির্মাণের বিষয়টি হয়তো সেভাবে টানেনি পুরো বিষয়টির রূপান্তর ঘটে গেছে

নির্মাতাদের পাশাপাশি সরকারের গাফিলতির কথাও উল্লেখ করেন মোরশেদুল ইসলাম তার মতে, ভাষা আন্দোলনের ৫০-৬০ বছর পেরিয়ে গেলেও বিষয়ে ছবি নির্মাণে সরকার তেমন কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি ভাষা আন্দোলন নিয়ে ছবি নির্মাণের ওপর সরকার যদি আলাদা অনুদান ব্যবস্থা চালু করে, তাহলে প্রস্তাবনা জমা পড়বে বলে আশা প্রকাশ করেছেন দীপু নাম্বার টু আমার বন্ধু রাশেদখ্যাত নির্মাতা ধরনের ছবি নির্মাণের পেছনে নির্মাতা, সরকারসবারই উদ্যোগ থাকা দরকার বলে তার মত


মোরশেদুল ইসলামের কথার সঙ্গে মিল পাওয়া যায় মাটির প্রজার দেশেখ্যাত ছবির প্রযোজক আরিফুর রহমানের কথাতেও তিনি বলেন, আমাদের এখানে স্বাধীনতা সংগ্রামকে নিয়ে যে ছবিগুলো হয়েছে, সেগুলো সবই মোটামুটি একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রকম পুনরাবৃত্তি হয়তো বায়ান্নকে নিয়ে কম করার সুযোগ আছে তিনি আরো বলেন, ৭১ হলো অনেকগুলো যুদ্ধ, সংগ্রামের চূড়ান্ত স্ফুরণ যে কারণে একাত্তরের ব্যাপ্তি আমাদের নির্মাতাদের কাছেও অনেক বেশি বলে মনে হয় তার পরও এটা মেনে নিতে হবে যে, আমরা বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনকে এক্সপ্লোর করার চেষ্টা করিনি কিন্তু আমার মনে হয়, বায়ান্ন হলো আমাদের বীজ, সময়কেও সমানভাবে গুরুত্ব দেয়া উচিত বিষয়ে ছবি নির্মাণকে উৎসাহিত করতে হলে সরকারকে অনুদান নীতিমালায় নির্দিষ্ট করে বলে দেয়া উচিত যে, এবারের অনুদানে ভাষার ওপর ছবি করতে হবে, কিংবা কেউ আগ্রহী হয়ে করতে চাইলে তার প্রস্তাবকে উৎসাহ দেয়া হবে

এদিকে ভাষা আন্দোলনের ওপর ছবি না হওয়ার পেছনে আরেকটি কারণ হিসেবে অর্থ সংকটকে দায়ী করেছেন নির্মাতা অমিতাভ রেজা টকিজকে তিনি বলেন, ভাষা আন্দোলন নিয়ে সময়ে ছবি নির্মাণ না হওয়ার পেছনে দেশের অর্থনৈতিক বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ভাষা আন্দোলন একটি নির্দিষ্ট সময়ের ঘটনা পিরিয়ডিক্যাল ছবি নির্মাণের পেছনে যে পরিমাণ অর্থ লগ্নি করতে হয়, তা আমাদের নেই

ভাষা আন্দোলন নিয়ে ছবি নির্মাণের স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজেও দেখেছিলেন ১৯৫৭ সালে বঙ্গবন্ধু এফডিসি চালু করেন সময় বঙ্গবন্ধু একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনা নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন বিষয়ে নির্মাতা ফতেহ লোহানীর সঙ্গে আলাপ-আলোচনাও করেছিলেন আইয়ুব খানের শাসনামলে শেষ পর্যন্ত তা করা হয়ে ওঠেনি দেশ স্বাধীন হয়েছে, মাঝখানে দীর্ঘসময় কেটে গেছে অথচ দীর্ঘ পথচলায় বঙ্গবন্ধুর সে স্বপ্ন পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি বললেই চলে সুতরাং এখন থেকেই বায়ান্নর মতো ব্যাপকতর ঐতিহাসিক সময়কালকে চলচ্চিত্রের পর্দায় নানাভাবে তুলে ধরা উচিত বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন

 


এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন