দৃশ্যমান স্থানে ভাড়ার তালিকা প্রদর্শনের বিধান মানছে না রাজধানীর বিভিন্ন রুটের বাস

নিজস্ব প্রতিবেদক

রাজধানী শহরে গণপরিবহন ছবি: ফাইল/নিজস্ব আলোকচিত্রী

রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় গণপরিবহনের দূরত্বভিত্তিক ভাড়ার তালিকা নির্ধারণ করে দেয় বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ)। সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮ অনুযায়ী, এ ভাড়ার তালিকা গণপরিবহনের দৃশ্যমান স্থানে প্রদর্শন করার কথা। এর অন্যথায় শাস্তির বিধানও রাখা হয়েছে আইনটিতে। যদিও রাজধানীর বাসগুলো আইনের ধারাটি লঙ্ঘন করে চলেছে নিয়মিতভাবে। সরজমিনে ঢাকার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ভাড়ার তালিকা সংবলিত চার্ট টাঙানো নেই অধিকাংশ বাসেই।

সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, বিআরটিএ বা ট্রাফিক বিভাগসহ রাজধানীর গণপরিবহনের শৃঙ্খলা তদারকির দায়িত্বে নিয়োজিত সংস্থাগুলোর কার্যকর পদক্ষেপ না থাকায় সড়ক পরিবহন আইনের যথাযথ পরিপালন নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। যদিও পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ বলছে, বিষয়টি তাদের এখতিয়ারে পড়ে না। এ-সংক্রান্ত ব্যবস্থা নিতে পারে শুধু বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। আর বিআরটিএ কর্মকর্তাদের ভাষ্য হলো জনবল সংকট এখন তাদের এ-সংক্রান্ত কার্যক্রম বাস্তবায়নের পথে বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

বিআরটিএর উপপরিচালক (এনফোর্সমেন্ট) মো. হেমায়েত উদ্দিন এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ঢাকায় আমাদের দশজনের মধ্যে মাত্র চারজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রয়েছেন। নিয়মিত আমরা মোবাইল কোর্ট করছি। হয়তো সেভাবে দৃশ্যমান হচ্ছে না। শুধু ভাড়ার তালিকা নয়, গাড়ির নম্বরও গণপরিবহনের ভেতরে দৃশ্যমান স্থানে প্রদর্শন করতে হবে। এটা মালিক সমিতির সবাই জানেন।’

রাজধানীর বাস রুটগুলোয় চলাচলকারী গণপরিবহনের বিশৃঙ্খল দশা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ তুলছেন যাত্রী, পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বিভিন্ন নাগরিক সংগঠনের প্রতিনিধিরা। ভাড়া নিয়ে যাত্রীদের সঙ্গে হেলপারদের তুমুল বচসাও এসব বাসের ভেতরের নিয়মিত দৃশ্য। এমনকি জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরসহ সরকারি বিভিন্ন সংস্থার কর্তাব্যক্তিরাও বিভিন্ন সময় রাজধানীর বাস রুটে চলাচলকারী গণপরিবহনের বিশৃঙ্খল দশা নিয়ে বক্তব্য রেখেছেন। বিষয়টি নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে আইন করা হলেও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো এখনো এর পরিপালন নিশ্চিতে সমন্বিত কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি বলে অভিযোগ তুলছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞরা। এক্ষেত্রে বাস রুট রেশনালাইজেশনের পাশাপাশি সব বাসকে এক কোম্পানির অধীনে নিয়ে এলে সমস্যার অনেকাংশেই সমাধান হবে বলে মনে করছেন তারা।  

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ড. মো. হাদিউজ্জামান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘জনবল সংকটের অভিযোগ একটা অজুহাত। তাদের রাজস্ব আহরণের তো সংকট নেই। জনবল বাড়াতে হবে। ই-টিকিটিং সিস্টেমে যেতে হবে। কিলোমিটার হিসেবে ভাড়া নিতে হবে। বাস রুট রেশনালাইজেশন করতে হবে। রাজধানীর গণপরিবহনের সংকট কাটাতে হলে সব বাসকে এক কোম্পানিতে নিয়ে আসতে হবে। তখন তদারকি বাড়বে। তদারকির সক্ষমতা যাদের আছে, তাদের দেয়া যেতে পারে। যত কিছুই করি, ঢাকা শহরের মূল গণপরিবহন হতে হবে সিটি বাস সার্ভিস।’ 

ট্রাফিক বিভাগের ভাষ্যমতে, সড়ক পরিবহন আইন প্রয়োগের দায়িত্ব বিআরটিএর। এক্ষেত্রে পুলিশের নজরে কোনো অভিযোগ এলে তা বিআরটিএকে জানানো ছাড়া পুলিশের আর কিছু করার থাকে না। 

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) মো. মুনিবুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আইনটি বিআরটিএর জন্য প্রযোজ্য। কোনো অভিযোগ পুলিশের নজরে এলে বিআরটিএকে জানানো হয়। এছাড়া পুলিশের আর কিছু করার থাকে না।’

আইনটিতে গণপরিবহনের ভাড়া নির্ধারণ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, কোনো গণপরিবহন সহজে দৃশ্যমান স্থানে ভাড়ার চার্ট প্রদর্শন ছাড়া যাত্রী পরিবহন করতে পারবে না। কোনো গণপরিবহনের মালিক, চালক, কন্ডাক্টর, ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নির্ধারিত ভাড়ার অতিরিক্ত ভাড়া দাবি বা আদায় করতে পারবে না।

এর অন্যথা ঘটলে তা অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে বলে আইনে বলা হয়েছে। এ অপরাধের জন্য দায়ী ব্যক্তিকে অনধিক এক মাসের কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে বলেও আইনে উল্লেখ করা রয়েছে। 

এ প্রসঙ্গে বিআরটিএর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ সাজিদ আনোয়ার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮-এর ৮০ ধারা অনুযায়ী ভাড়ার তালিকা প্রদর্শন করতে হবে। এ তালিকা মেনে চলতে হবে। এর অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা যাবে না। এজন্য ১০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। আমরা জরিমানা করি। নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়।’

বিষয়টি বিআরটিএ ছাড়া অন্য কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান তদারক করতে পারবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পুলিশের এনফোর্সমেন্ট আরো ব্যাপক। তারাও করতে পারে।’

সংশ্লিষ্টরা জানান, গণপরিবহনে ভাড়ার তালিকা প্রদর্শন না করা হলে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরও ব্যবস্থা নিতে পারে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সংস্থাটির মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমরা এবারের ঈদেও সায়েদাবাদে অভিযান পরিচালনা করেছি। আমরা নিয়মিত অভিযান করছি। কোনো কর্তৃপক্ষ মূল্য নির্ধারণ করে দেয়ার পর সেটির লঙ্ঘন হলে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারি। প্রশাসনিক ব্যবস্থায় আমরা জরিমানা করে থাকি।’

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বিআরটিএর পরিচালক (এনফোর্সমেন্ট) মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মালিক সমিতিকে বলা আছে ভাড়ার তালিকা টাঙিয়ে রাখতে। বিআরটিএ ও জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের বলা আছে ব্যবস্থা নিতে। ঢাকার বাইরে বিআরটিএর আরো তিনজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রয়েছেন। পুলিশও ব্যবস্থা নিতে পারে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন