উন্নয়নশীল অর্থনীতির জীবনরেখা ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প

নিজস্ব প্রতিবেদক

ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

বৈশ্বিকভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির বড় অংশই ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের (এসএমই) ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়নে এসএমইর ভূমিকা আরো বেশি। বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে বড় আকারের অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতি বিদ্যমান সেখানে এসএমইর গুরুত্ব আরো বেশি। বিশেষ কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং কৃষির বাইরে গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশে খাতটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

বিশ্বজুড়েই ব্যবসা-বাণিজ্য, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে কুটির শিল্প, ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্প খাত (সিএমএসএমই)। জাতিসংঘের তথ্যানুসারে, বৈশ্বিক ব্যবসার ৯০ শতাংশ, কর্মসংস্থানের ৭০ শতাংশ এবং মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৫০ শতাংশই এ খাতের অবদান। বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের জিডিপিতে এসএমই খাতের অবদান এখনো বেশ কম। এসএমই খাতের ওপর কভিডের প্রভাব নিয়ে করা লাইট ক্যাসেল পার্টনার্সের এক প্রতিবেদনে তথ্যানুসারে, ইন্দোনেশিয়ার জিডিপিতে এসএমই খাতের অবদান ৫৯ শতাংশ। একইভাবে কম্বোডিয়ার ক্ষেত্রে ৫৮ শতাংশ, শ্রীলংকায় ৫২ শতাংশ, ভিয়েতনামে ৪০ শতাংশ এবং ভারতের জিডিপিতে এসএমই খাতের অবদান ২৯ শতাংশ। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এর পরিমাণ ২৫ থেকে ২৭ শতাংশ। এ বছরের মধ্যে এটি ৩২ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে সরকারের।

দেশের মোট কর্মসংস্থানের ৮০ শতাংশই হচ্ছে এসএমই খাতের মাধ্যমে। ছোট আকারের কৃষি উদ্যোগ কিংবা পশুপালন খামার, ছোট আকারের উৎপাদনমুখী শিল্প কিংবা সেবা খাতের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার মাধ্যমে দেশের অসংখ্য উদ্যোক্তা নিজেদের স্বাবলম্বী করার পাশাপাশি আরো অনেকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন। এসব উদ্যোগের কোনো কোনোটি ব্যবসায়িক সাফল্যের মাধ্যমে নিজেদের আরো বড় পরিসরে বিস্তৃত করতে সক্ষম হয়েছেন। বর্তমানে প্রচলিত এমএমই উদ্যোগের পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠছে। এসব প্রতিষ্ঠান স্থানীয় কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখছে। 

দেশের গ্রামীণ অর্থনীতি মূলত কৃষিনির্ভর। তবে বর্তমানে কৃষিভিত্তিক পণ্যসহ ছোট আকারের নানা ধরনের উৎপাদন ও সেবামুখী এসএমই উদ্যোগগুলো গ্রামীণ অর্থনীতির রূপান্তরে বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছে। এতে গ্রামাঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। দেশের এসএমই উদ্যোগের বড় একটি অংশই কোনো ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক অর্থায়ন ছাড়াই নিজেদের চেষ্টায় গড়ে উঠেছে। তবে এসব প্রতিষ্ঠানের টিকে থাকা ও ভবিষ্যৎ ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধির জন্য সহজ অর্থায়ন সুবিধা প্রয়োজন। সরকারের দিক থেকে এসএমইদের জন্য অর্থায়ন বাড়ানো ও সহজ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। যদিও এখনো অনেক এসএমই উদ্যোগ অর্থায়ন সুবিধার বাইরে রয়েছে। বিশেষ করে নারী উদ্যোক্তারা। ডিজিটাল মাধ্যমের প্রসারের সুবাদে অনেক নারী উদ্যোক্তা অনলাইনভিত্তিক ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। যদিও এমএসএমই খাতের অর্থায়নের ৫ থেকে ৬ শতাংশ পাচ্ছেন নারী উদ্যোক্তারা।

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২৪ এর তথ্যানুসারে, গত ১০ বছরে দেশের সিএমএসএমই খাতে ঋণের পরিমাণ বেড়েছে সাড়ে তিন গুণ। যদিও এ সময়ে নারী উদ্যোক্তাদের ঋণের পরিমাণ ৩ দশমিক ৯০ শতাংশ থেকে বেড়ে ৬ দশমিক ৪৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ২০১৪ সালে দেশের সিএমএসএমই খাতে মোট ১ লাখ ৯১০ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। এর মধ্যে ৩ দশমিক ৯০ শতাংশ বা ৩ হাজার ৯৩৮ কোটি ৭৫ লাখ টাকার ঋণ পেয়েছেন নারী উদ্যোক্তারা। ২০১৫ সালে এ খাতের বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ১৫ হাজার ৮৭০ কোটি টাকা এবং নারী উদ্যোক্তারা পেয়েছেন ৪ হাজার ২২৭ কোটি টাকার ঋণ। ২০১৬ সালে সিএমএসএমই খাতে বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৪১ হাজার ৯৩৫ কোটি টাকা এবং এর মধ্যে নারী উদ্যোক্তারা পেয়েছেন ৫ হাজার ৩৪৫ কোটি ৬৬ লাখ টাকার ঋণ। ২০১৭ সালে নারী উদ্যোক্তাদের দেয়া ঋণের পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৭৭৩ কোটি টাকা এবং এ খাতে মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৬১ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে সিএমএসএমই খাতে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৫৯ হাজার ৫১০ কোটি টাকা এবং এর মধ্যে নারীরা পেয়েছেন ৫ হাজার ৫১৭ কোটি টাকার ঋণ। ২০১৯ সালে বিতরণ করা ১ লাখ ৬৭ হাজার ৯৭০ কোটি ৬৭ লাখ টাকার ঋণের মধ্যে নারীরা পেয়েছেন ৬ হাজার ১০৯ কোটি টাকা।

কভিডের বছর ২০২০ সালে দেশে সিএমএসএমই খাতে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৬ হাজার ৮০৩ কোটি ৬৩ লাখ টাকা এবং এর মধ্যে নারী উদ্যোক্তারা পেয়েছেন ৮ হাজার ২৪৪ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। ২০২১ সালে এ খাতের বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ১৫ হাজার ৭৮৬ কোটি টাকা এবং এর মধ্যে নারী উদ্যোক্তাদের দেয়া ঋণের পরিমাণ ছিল ৮ হাজার ৮০১ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। ২০২২ সালে ২ লাখ ৪২ হাজার ৩৭৫ কোটি ৭৮ লাখ টাকার ঋণ বিতরণ করা হয়েছে সিএমএসএমই খাতে এবং এর মধ্যে নারীরা পেয়েছেন ১৩ হাজার ৭৪৪ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। সর্বশেষ ২০২৩ সালে সিএমএসএমই খাতে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৪ হাজার ২৪২ কোটি টাকা এবং এর মধ্যে নারী উদ্যোক্তাদের দেয়া ঋণের পরিমাণ ছিল ১৯ হাজার ৬১৩ কোটি টাকা। গত ছয় বছর সিএমএসএমই খাতের যে পরিমাণ ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল সেটি পুরোপুরি অর্জন করা সম্ভব হয়নি। 

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মূলত ডকুমেন্টেশনের সমস্যার কারণেই নারী উদ্যোক্তারা ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছেন। ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়ার জন্য বিভিন্ন ধরনের কাগজপত্র জমা দিতে দিতে হয়। এসব কাগজপত্র অনেক ক্ষেত্রে নারীদের জন্য সংগ্রহ করাটা কঠিন হয়ে যায়। কভিডের সময়ও দেখা গেছে ডকুমেন্টেশন সমস্যার কারণে সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া প্রণোদনার অর্থ নারী উদ্যোক্তাদের অনেকেই নিতে পারেননি। ব্যবসা জন্য কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) প্রয়োজন, যা অনেক নারী উদ্যোক্তাদের নেই। এসব কারণেই মূলত ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে নারীরা পিছিয়ে রয়েছেন।’

পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত চার দশকে দেশের এসএমই খাতের উৎপাদন ক্রমে বাড়ছে। আর গত দুই দশক দেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) এ খাতের অবদান বাড়ছে ধারাবাহিকভাবে। দেশের এসএমই খাতের আকার ও জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে এ খাতের অবদান নিয়ে ২০২২ সালের বছরের নভেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয়, উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোয় টেকসই উন্নয়ন অর্জনের অন্যতম একটি মূল উপাদান হয়ে উঠেছে এসএমই খাত। উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর জাতীয় আয়ে আনুষ্ঠানিক এসএমই খাতের অবদান ৪০ শতাংশ। এশিয়ার অনেক দেশেই শিল্প খাতে এসএমইর অবদান ৯০ শতাংশ এবং মোট জনশক্তির ৬০ শতাংশের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে থাকে এ খাত। 

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের ক্ষেত্রে এসএমই খাতের অবদান আরো অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। কারণ এ খাতের উৎপাদন প্রক্রিয়া ও পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে বড় আকারের শিল্পের তুলনায় অনেক কম বিনিয়োগের প্রয়োজন হয়। অর্থনৈতিক স্থায়িত্ব, উদ্ভাবন ও বাণিজ্যসহ বিভিন্নভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখছে এসএমই খাত। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গবেষণা প্রতিবেদনে ১৯৭৮ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত দেশের এসএমই খাতের উৎপাদনের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এতে দেখা যায়, ১৯৭৮ সালে দেশের এসএমই খাতের উৎপাদন ছিল ৪ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। এরপর থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত এ খাতের উৎপাদন ৫ হাজার থেকে ৬ হাজার কোটি টাকার মধ্যেই স্থিতিশীল ছিল। ১৯৯২ সালের পর এ খাতের উৎপাদন বাড়তে শুরু করে। ১৯৯৪ সালে এসএমই খাতের উৎপাদন দাঁড়ায় ৬ হাজার ৭৫৬ কোটি টাকায়। ২০০০ সালে এটি আরো বেড়ে ৯ হাজার ৪৩৩ কোটি হয়। পরবর্তী পাঁচ বছরে এটি ১০০ শতাংশের বেশি বেড়ে ২০০৫ সালে দাঁড়ায় ১৯ হাজার ৪৮৫ কোটি টাকায়। এর ১০ বছর পর ২০১৫ সালে এসএমই খাতের উৎপাদন দাঁড়ায় ২০ হাজার ৪০ কোটি টাকায়। ২০২০ সাল নাগাদ এটি বেড়ে ৪৩ হাজার ৭৮০ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। একইভাবে গত দুই দশকে দেশের জিডিপিতে এসএমই খাতের অবদানও বেড়েছে। ১৯৯৪ সালে যেখানে জিডিপিতে এসএমই খাতের অবদান ছিল ২ দশমিক ৫৫ শতাংশ, সেটি বেড়ে ২০২০ সাল শেষে ৩ দশমিক ৭৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

সর্বশেষ অর্থনৈতিক শুমারি অনুসারে, দেশের শিল্প খাতের প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৭৮ লাখ ১৮ হাজার ৫৬৫। এর ৯৯ শতাংশই হচ্ছে সিএমএসএমই (কুটির, ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি উদ্যোগ) খাতের। এর মধ্যে ৮৭ দশমিক ৫ শতাংশ কুটির, ১ দশমিক ৩৩ শতাংশ ক্ষুদ্র, ১০ দশমিক ৯৯ শতাংশ ছোট ও দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ মাঝারি প্রতিষ্ঠান। শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেশি। সব মিলিয়ে এ খাতে ২ কোটি ১০ লাখের বেশি মানুষ সম্পৃক্ত। এর মধ্যে নারীর সংখ্যা ২৪ লাখেরও বেশি। সর্বশেষ অর্থনৈতিক শুমারি প্রকাশিত হয়েছে ২০১৩ সালে। এরপর আর এ-সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশিত হয়নি। ফলে এ বিষয়ে হালনাগাদ তথ্য পাওয়া না গেলেও খাতসংশ্লিষ্টদের মতে, বর্তমানে এ খাতের প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা আরো অনেক বেড়েছে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২৪-এর তথ্যানুসারে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সাময়িক হিসাব অনুসারে জিডিপিতে কুটির শিল্পের অবদান ছিল ১ লাখ ৪৩ হাজার ৩৫১ কোটি টাকা এবং ছোট, মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্পের অবদান ছিল ২ লাখ ৪৯ হাজার ৬৯৬ কোটি টাকা। বৃহৎ শিল্পের তুলনায় এ সময়ে সিএমএসএমই খাতের উৎপাদন সূচকের প্রবৃদ্ধি ছিল বেশি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন