মূলধারার সঙ্গে উদ্যোক্তাদের সম্পৃক্ত করতে কাজ করে যাচ্ছে ফাউন্ডেশন

ছবি : বণিক বার্তা

অধ্যাপক ড. মো. মাসুদুর রহমান,২০২০ সালে এসএমই ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন হিসেবে যোগদান করেন। বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গৃহীত এসএমই নীতি কৌশল বাস্তবায়ন, এসএমইর বৃদ্ধির জন্য নীতি সমর্থন ও হস্তক্ষেপ, এসএমইর জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদান, দক্ষতা উন্নয়ন ও সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রশিক্ষণ প্রদান, উপযুক্ত প্রযুক্তির সঙ্গে অভিযোজন সহজতর করা এবং প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এসএমই ফাউন্ডেশনের কীভাবে কাজ করছে তা নিয়ে বণিক বার্তার সঙ্গে কথা বলেন তিনি। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ফারিন জাহান সিগমা

এসএমই ফাউন্ডেশনের দীর্ঘ ১৫ বছরের পথচলা। এ দীর্ঘ যাত্রায় প্রাপ্তির জায়গাগুলো কী কী ছিল? 

এসএমই ফাউন্ডেশন ২০ লক্ষাধিক উদ্যোক্তাকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সেবা প্রদান করেছে। ২ লাখ ৪৬ হাজার ৫৭২ জন উদ্যোক্তা সরাসরি ভারভোগী যার মধ্যে প্রায় ৪৫ শতাংশ নারী উদ্যোক্তা। নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি ও এসএমই উদ্যোক্তাদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এসএমই ফাউন্ডেশন এ যাবত প্রায় ২ হাজার প্রশিক্ষণ কর্মসূচির আওতায় এক লাখেরও বেশি উদ্যোক্তা-প্রশিক্ষনার্থীকে বিভিন্ন ধরণের প্রশিক্ষণ প্রদান করেছে, যার ৬০ শতাংশ নারী। ৪০টির বেশি ক্লাস্টারে চাহিদার ভিত্তিতে প্রায় ৩৫০টি প্রশিক্ষণ কর্মসূচির মাধ্যমে ১০ হাজার উদ্যোক্তা-কর্মীকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে।

নারী উদ্যোক্তা সৃষ্টি ও নারী উদ্যোক্তাদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রায় ৫০০টি বিশেষ প্রশিক্ষণ কর্মসূচির মাধ্যমে ২০ হাজারের বেশি নারী উদ্যোক্তা-প্রশিক্ষণার্থীকে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে।’ নারী আইসিটি ফ্রিল্যান্সার এবং উদ্যোক্তা উন্নয়ন কর্মসূচি’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় ৬৪ জেলায় িতন হাজার নারী-আইসিটি উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে। নারী উদ্যোক্তাদের রপ্তানি বাণিজ্যে অংশগ্রহণ বৃদ্ধির লক্ষ্যে TFO Canada এর সঙ্গে পাঁচ বছর মেয়াদি Women in Trade for Inclusive & Sustainable Growth (WITISG) প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। ৮২৭২ জন উদ্যোক্তার অনুকূলে ৭১৫ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে।

২০১১-১২ থেকে এ পর্যন্ত ৫৫৭টি এসএমই বান্ধব বাজেট প্রস্তাবনা জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও অন্যান্য সংস্থা বরাবর প্রেরণ করা হয়েছে যার মধ্যে ৮৩টি প্রস্তাবনা আংশিক/সম্পূর্ণরূপে গৃহীত হয়েছে।

বিভিন্ন বিষয়ের গবেষণা কার্যক্রম, নির্দেশিকা, প্রোডাক্ট ডিরেক্টরি, বিজনেস ম্যানুয়াল ও অন্যান্য বিষয়ে ৩০টি বই প্রকাশ করা হয়েছে। ফাউন্ডেশনের সহায়তায় এ পর্যন্ত ৩১টি প্রতিষ্ঠান আইএসএও ২২০০০ সনদ অর্জন করেছে।

বিগত বছরগুলোয় যে লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছিল তার কতটুকু অর্জিত হয়েছে এবং অর্জিত না হলে সেক্ষেত্রে কী কী বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে?

এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। এ চলমান প্রক্রিয়ার অধীনে যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, সে লক্ষ্যমাত্রাগুলো ধীরে ধীরে অর্জন করা হবে। গত ১৫ বছরের কাজের মধ্য দিয়ে কিছু লক্ষ্যমাত্রা আমরা অর্জন করতে পেরেছি। যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির ক্ষেত্রে এসএমই উদ্যোক্তারা মূল ভূমিকা পালন করতে পারেন। জাপানের জিডিপির ৯০ শতাংশ আসে এসএমই উদ্যোক্তাদের মধ্য থেকে। ভারতে ৬০ শতাংশ ও চীনে ৭০ শতাংশ জিডিপির ক্ষেত্রে এসএমই উদ্যোক্তারা কাজ করে। সেক্ষেত্রে আমরা কিন্তু এখনো অনেক পিছিয়ে আছি। আমাদের লক্ষ্যমাত্রা আছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে এসএমই খাত, যাতে মূল ভূমিকা পালন করে এবং এ লক্ষ্যমাত্রা পালন না করা পর্যন্ত আমি বলব না যে আমি আমাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পেরেছি। আমাদের মূল লক্ষ্য ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত জাতিরাষ্ট্র তৈরি করার ক্ষেত্রে আমাদের এসএমই উদ্যোক্তাদের মূল শিল্পায়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। 

এসএমই ফাউন্ডেশন নিয়ে আগামী পাঁচ বছরে আপনাদের পরিকল্পনা কী?

আমাদের মূল কাজ হলো জাতীয় পর্যায়ে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে নীতিনির্ধারণ করা হয় সেখানে সম্পূরক নীতি তৈরি করা। অষ্টম যে জাতীয় পরিকল্পনা আছে পাঁচ বছর মেয়াদি। ২০২২ সালে যে শিল্পনীতি তৈরি করা হয়েছে সেখানে কৌশলগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অর্থনৈতিক উদ্যোক্তাদের জন্য যে নীতিগত কৌশলগুলো তৈরি করা হয় সেগুলো বাস্তবায়ন করার জন্য আমরা আমাদের নীতিগত কৌশলগুলো তৈরি করি। এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া।

ডিজিটালাইজেশনের ক্ষেত্রে এসএমই কী কী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে?

ডিজিটালাইজেশন এ যুগে উন্নয়নের মূল মাইলফলক হিসেবে কাজ করছে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আইসিটি মন্ত্রণালয় তৈরি করা এবং সারা দেশে ডিজিটাল অবকাঠামো তৈরি করতে আমরা কার্যক্রম হাতে নিয়েছি। অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী অনেক বেশি। গত বছরে বাংলাদেশে উদ্যোক্তাদের পণ্য ও সেবা বিক্রি করার ক্ষেত্রে মূল প্লাটফর্ম ছিল ডিজিটাল প্লাটফর্ম। আজকের বাজার নির্দিষ্ট একটা ভৌগোলিক অবস্থানে সীমাবদ্ধ নেই। এ ডিজিটাল প্লাটফর্ম ব্যবহার করে আমাদের ছোট ছোট উদ্যোক্তা যে পরিমাণ পণ্য বিক্রি করেছে, তার পরিসংখ্যান আপনি যদি দেখেন তাহলে আপনি দেখতে পাবেন যে আমাদের উদ্যোক্তারা এরই মধ্যে এটি ব্যাপক হারে ব্যবহার শুরু করেছে। এ প্লাটফর্ম ব্যবহার করার ক্ষেত্রে আমাদের উদ্যোক্তাদের কারিগরি জ্ঞান, নীতিগত জ্ঞানের অভাব রয়েছে। আমরা আইসিটি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আমরা কাজ করছি। করোনার সময় সাতটি আঞ্চলিক মেলা আমরা করেছি। পাশাপাশি ইউনিয়ন লেভেলে আইসিটি যে হাবগুলো তৈরি হয়েছে, ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারগুলো তৈরি হয়েছে সেখানে এসএমই উদ্যোক্তাদের অ্যাকসেসিবিলিটি আমরা তৈরি করেছি।

দক্ষতার ঘাটতি ও যথাযথ তথ্যের অভাবে এসএমই উদ্যোক্তারা পিছিয়ে পড়ছেন। এসব সমস্যা থেকে উত্তরণে করণীয় কী?

সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছার অনেকগুলো উপায় আছে। আমরা ডিজিটালি প্রচুর ইনভলভ আমাদের কাস্টমারদের সঙ্গে বা আমাদের টার্গেট অডিয়েন্সের সঙ্গে। প্রতিটি ডিজিটাল প্লাটফর্মের সঙ্গে আমরা অ্যাকসেস করার চেষ্টা করি। জেলা পর্যায়ে যে চেম্বারগুলো আছে, মহিলা পর্যায়ে তাদের সঙ্গে আমাদের কিন্তু একটা সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রয়েছে, একটি বিরাট ভূমিকা রয়েছে। সেক্ষেত্রে গণমাধ্যমেরও একটা ভূমিকা রয়েছে। প্রিন্ট মিডিয়া, ইলেকট্রনিক মিডিয়া আমাদের কার্যক্রমগুলো তুলে ধরছে। এর মধ্যে আমরা কিন্তু আমাদের টার্গেট অডিয়েন্সের কাছে পৌঁছার চেষ্টা করছি। পাশাপাশি এসএমই ফাউন্ডেশনের প্রতি উদ্যোক্তাদের একটা আস্থার জায়গা তৈরি হচ্ছে। স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তারা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। আমাদেরও কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। আর্থিক ও কারিগরি সীমাবদ্ধতা আমরা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি এবং কাটিয়ে উঠে আমরা আরো ব্যাপক জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারি।

এক্ষেত্রে সরকার থেকে কী ধরনের সহযোগিতা পাচ্ছেন?

যেকোনো দেশের সরকারি মূল ভূমিকা হচ্ছে সহযোগী ভূমিকা পালন। সেই সহযোগী ভূমিকা পালন করার ক্ষেত্রে শিল্প মন্ত্রণালয়, এসএমই ফাউন্ডেশন, আইসিটি মন্ত্রণালয়, তথ্য মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়—যারা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত তাদের সঙ্গে আমরা অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করি। প্রাইভেট সেক্টরের সঙ্গেও কিন্তু আমাদের পার্টনারশিপের প্রচুর কাজ। হাতেকলমে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়। বড় বড় ইন্ডাস্ট্রিতে আমরা আমাদের উদ্যোক্তাদের নিয়ে যাচ্ছি। এর মাধ্যমে যা হচ্ছে সরকারি যে নীতিসহায়তা বেসরকারি খাতের যে কর্মযজ্ঞ এর মধ্য দিয়ে তাদের একটা সংযোগ তৈরি করছি। এর মাধ্যমে হাতেকলমে কাজ শেখা হচ্ছে, বড় উদ্যোক্তাদের সঙ্গে ছোট উদ্যোক্তাদের একটি সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে। যার মধ্য দিয়ে ব্যাকওয়ার্ড ও ফরোয়ার্ড লিংকেজের যে ব্যাপারটা আছে তা তৈরি হচ্ছে। আমাদের ছোট উদ্যোক্তারা বড় উদ্যোক্তাদের সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। আমি মনে করি, সরকারি-বেসরকারি পার্টনারশিপকে আমরা যত বেশি বাড়াতে পারব তত বেশি আমাদের ছোট ছোট উদ্যোক্তার দক্ষতা বাড়বে, তাদের কাজের ক্ষেত্র আরো প্রসারিত হবে। 

ভবিষ্যতে এলডিসি-পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আপনাদের পরিকল্পনা কী?

২০২৬ সালে এলডিসির গ্র্যাজুয়েশন হবে। আমরা বর্তমানে যেসব সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছি—আর্থিক ও অ-আর্থিক দুই ধরনের সুযোগ-সুবিধাই পাচ্ছি—তার কিছুটা কিন্তু আমরা পাব না। ফলে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য করার ক্ষেত্রে, ফাইন্যান্সিং করার ক্ষেত্রে সুযোগ-সুবিধা আছে। এর পাশাপাশি বড় রকমের সুবিধা আসবে কমপ্লায়েন্সের ক্ষেত্রে, রেগুলেশনের ক্ষেত্রে, সার্টিফিকেশনের ক্ষেত্রে, স্ট্যান্ডার্ডাইজেশনের ক্ষেত্রে, আমাদের ওয়ার্কপ্লেস এনভায়রনমেন্টের ক্ষেত্রে, আমাদের এমপ্লয়িদের ক্ষেত্রে আমরা কীভাবে ট্রিট করছি সেসবের ক্ষেত্রে। অর্থাৎ প্রচুর পরিমাণ কমপ্লায়েন্স (অনুমতি) ইস্যু কিন্তু চলে আসে। এ ইস্যুগুলো অ্যাড্রেস করে আমাদের উদ্যোক্তাদের ব্যবসাগুলোকে কম্পেটবেল করতে হবে এলডিসির যে নীতি তৈরি আছে তার সঙ্গে। আপনি জানেন যে এসএমই ফাউন্ডেশন কিন্তু এলডিসির গ্র্যাজুয়েশন নিয়ে কাজ করছে। সরকারের একটা টাস্কফোর্স আছে তার সঙ্গেও কাজ করছে। পাশাপাশি আমরা ডব্লিউটিওর এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনে যারা কাজ করছেন তাদের সঙ্গে কাজ করি এবং ঢাকায় কয়েকটা ওয়ার্কশপের কাজ করছি। সেই ওয়ার্কশপে আমাদের যে স্টেকহোল্ডাররা আছে তাদের সঙ্গে আমরা কাজ করছি। তার মধ্য দিয়ে আমরা তুলে ধরার চেষ্টা করছি আমাদের কী প্রতিবন্ধকতাগুলো আছে এবং কী সুযোগগুলো তৈরি হবে। 

এসএমই খাতের উদ্যোক্তাদের জন্য ওয়ান স্টপ সার্ভিস (ওএসএস) চালুর বিষয়ে অগ্রগতি হয়েছে কি?

আমাদের এসএমই ফাউন্ডেশনের একটি ওয়ান স্টপ ডেস্ক আছে। তবে প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমরা অত্যন্ত ছোট। শুধু ঢাকা শহরে আমাদের অফিস আছে। কিন্তু আমরা সারা দেশেই কাজ করি। সারা দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে যে অজস্র উদ্যোক্তা রয়েছেন তাদের প্রতিনিয়ত যে সমস্যাগুলো আছে, সেগুলো ঢাকায় বসে অ্যাড্রেস করা কঠিন। এখন আমাদের সামর্থ্য বাড়াতে হবে। আমাদের আর্থিক যে সামর্থ্য আছে সেটা বাড়ানো দরকার। সেজন্য আমরা সরকারের কাছে অনুরোধ জানিয়েছে আমরা যাতে আরো বেশি আর্থিকভাবে সচ্ছল হতে পারি সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে। পাশাপাশি আমরা ঢাকার বাইরেও অফিস তৈরি করতে পারব। আমাদের ডিজিটাল প্লাটফর্মগুলোকে আরো বেশি সক্রিয় করতে পারব। আপগ্রেড করতে পারব। যার মধ্য দিয়ে ওয়ান স্টপ যে সার্ভিসের কথা বলছি তা আরো বেশি সক্রিয় করতে পারব।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন