উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এমএসএমই খাতে বিনিয়োগের বিকল্প নেই

ছবি : বণিক বার্তা

মো. কায়সার হামিদ, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও), বাংলাদেশ ফাইন্যান্স। এর আগে তিনি আইপিডিসি ফাইন্যান্সের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর এবং হেড অব রিটেইল বিজনেস হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এমএসএমই খাতের উদ্যোক্তাদের নানা প্রতিবন্ধকতা ও সম্ভাবনা নিয়ে সম্প্রতি বণিক বার্তার সঙ্গে কথা বলেন তিনি

দেশের এমএসএমই খাতের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাই?

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নে এসএমই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অর্থনৈতিক দায়িত্ব, উদ্ভাবন ও বাণিজ্যসহ বিভিন্নভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখছে এসএমই খাত। বৈশ্বিকভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যের ৯০ শতাংশই কটেজ মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের (সিএমএসএমই) দখলে। মোট কর্মসংস্থানের অর্ধেকের বেশি হয় এ খাতের মাধ্যমে। প্রকৃত পক্ষে এসএমই বা সিএমএসএমই কর্মসংস্থান সৃষ্টি, আয় বৃদ্ধি, ব্যাকওয়ার্ড ও ফরওয়ার্ড শিল্প সংযোগের মাধ্যমে সামাজিক চাহিদা পূরণের প্লাটফর্ম হিসেবে কাজ করে। টেকসই উন্নয়নের অন্যতম পূর্বশর্ত দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় অন্তর্ভুক্তীকরণ। এসএমই বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ চালক। বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতিতে এসএমই একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান দখল করে আছে। সারা দেশে প্রায় ৭৮ লাখ সিএমএসএমই এন্টার প্রাইজ রয়েছে যার মধ্যে ৮ লাখ ৫৯ হাজার ক্ষুদ্র এবং প্রায় ৭ লাখ ১০ হাজার মাঝারি। ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে এ খাতের ঋণ স্থিতি প্রায় ২ লাখ ৮৩ হাজার কোটি টাকা, এর মধ্যে ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতে ঋণ স্থিতি প্রায় ২ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এ খাতে ফাইন্যান্সিং গ্যাপ রয়েছে প্রায় ২৮০ কোটি ডলার। এই গ্যাপ পূরণে প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ: বাংলাদেশ ব্যাংক, বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, এসএমই ফাউন্ডেশন ও শিল্প মন্ত্রণালয় অ্যাকসেস টু ফাইন্যান্স নিশ্চিতকরণের যৌথ উদ্যোগে নিতে পারে।

দক্ষতার ঘাটতি এবং যথাযথ তথ্যের অভাবে এমএসএমই উদ্যোক্তারা পিছিয়ে পড়ছেন। এসব সমস্যা থেকে উত্তরণে করণীয় কী?

বাংলাদেশে এসএমইতে অনানুষ্ঠানিক খাতের প্রাধান্য এবং প্রত্যন্ত এলাকায় অবস্থিত হওয়ার কারণে দক্ষতার ঘাটতি ও বিশেষ করে তথ্যের অভাবে এসএমই উদ্যোক্তারা অনেক পিছিয়ে পড়ছেন, যা এ খাতের এগিয়ে যাওয়ার জন্য বড় অন্তরায়/প্রতিবন্ধকতা। এসএমই উদ্যোক্তারা কোথায়, কীভাবে ঋণ পাবেন, পণ্যটি কোথায় রফতানি করতে হবে, সেটি কখন-কীভাবে সে সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য না থাকা, পরিচালন দক্ষতার ঘাটতিসহ বেশকিছু কারণে এসএমই খাতের উদ্যোক্তারা নানা সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। এ সমস্যা থেকে উত্তরণে প্রয়োজন সরকার, এসএমই ফাউন্ডেশন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ সব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সম্মিলিত ও সমন্বিত উদ্যোগ।

ভবিষ্যতে এলডিসি-পরবর্তী সময়ে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আপনাদের পরিকল্পনা কী?

এলডিসি হিসেবে প্রাপ্ত সুবিধাগুলো চলে গেলে বাংলাদেশের ক্ষতি সীমিত থাকবে। বরং অন্যদিকে এলডিসি হতে উত্তরণ হলে বাংলাদেশের ইমেজ বিশ্বে আরো বাড়বে। তবে এলডিসি হতে উত্তরণই বাংলাদেশের অর্জনের শেষ সীমা নয়। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশকে আরো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। এসএমই খাতের উন্নয়নে উদ্যোক্তাদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা উন্নয়ন, অবকাঠামো উন্নয়ন, মূলধনের জোগান, নীতিসহায়তা দেয়া খুবই জরুরি। আন্তর্জাতিক বাজারে এসএমই খাতের সরব অবস্থান তৈরি করতে হলে পণ্যের বৈচিত্র্য নিয়ে আসতে হবে, বিভিন্ন বাজারে উদ্যোক্তাদের যোগাযোগ বাড়াতে হবে।

এমএসএমই খাতের ব্যবসায় তথ্যপ্রযুক্তির সুবিধা কতটুকু কাজে লাগাতে পারছেন উদ্যোক্তারা?

দেশের এসএমই শিল্প উদ্যোক্তারা প্রযুক্তির ব্যবহারে অনেকটা পিছিয়ে আছেন। এমনকি প্রযুক্তি যথাযথ কাজে লাগাতে না পেরে নিজেদের ব্যবসাও এগিয়ে নিতে পারছেন না। তবে দেশের অনেক তরুণ উদ্যোক্তা সম্পূর্ণ প্রযুক্তিনির্ভর সিএমএসএমই উদ্যোগ করে ভালো করছে, যা আমাদের আশার সঞ্চার করছে। প্রযুক্তির ব্যবহারের সীমাবদ্ধতা ও দক্ষতার অভাব দেশের এসএমই খাতের উন্নয়নে বড় বাধা। আগামীতে স্মার্ট অর্থনীতি বিনির্মাণের ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার অবশ্যম্ভাবী। এজন্য ব্যবসার প্রসার এবং উত্তরোত্তর সমৃদ্ধির জন্য প্রযুক্তির যথোপযুক্ত ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। 

এমএসএমই খাতের উন্নয়নে সরকারের কাছ থেকে কী ধরনের পদক্ষেপ প্রত্যাশা করছেন

বাংলাদেশে কটেজ মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ (সিএমএসএমই) সেক্টরের উন্নয়নের জন্য সরকার প্রবৃদ্ধি, টেকসই এবং প্রতিযোগিতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন কৌশলগত পদক্ষেপ নিতে পারে। সরকারের ফোকাসের সম্ভাব্য মূল ক্ষেত্রগুলো হতে পারে—সিএমএসএমইর আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ সহজতর করার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠান নিবন্ধকরণ এবং বিভিন্ন লাইসেন্সিং প্রক্রিয়া স্ট্রিমলাইন করা, ট্যাক্স ইনসেনটিভ প্রদান—নতুন এবং ছোট উদ্যোগ প্রাতিষ্ঠানিক আনুষ্ঠানিককরণের লক্ষ্যে এবং গ্রোথ উৎসাহিত করার জন্য ট্যাক্স রিবেট প্রদান, নীতিসহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে এসএমই-বান্ধব নীতিমালা প্রণয়ন, আমলাতান্ত্রিক বাধা এবং ব্যয় হ্রাস, সরকারি ও বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে স্বল্প সুদে অ্যাকসেস টু ফাইন্যান্স নিশ্চিত করা। এর মধ্যে কম সুদে ঋণ, ক্ষুদ্র ঋণ এবং ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে, ডিজিটাল ফাইন্যান্স—সুবিধাবঞ্চিত এলাকায় পৌঁছাতে এবং লেনদেন সহজতর করতে ডিজিটাল ব্যাংকিং এবং আর্থিক পরিষেবার কাঠামো প্রণয়ন, প্রয়োজনীয় অবকাঠামোসহ ডেডিকেটেড সিএমএসএমই শিল্প অঞ্চল বা ক্লাস্টার তৈরীকরণ, এমএসএমইকে উন্নত প্রযুক্তি এবং গবেষণা ও উন্নয়ন সুবিধা প্রদানের জন্য প্রযুক্তি পার্ক এবং টেকনোলজি হাব স্থাপন করা, প্রশিক্ষণ কর্মসূচি—এমএসএমইর চাহিদা অনুযায়ী বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ এবং দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন, উদ্যোক্তা উন্নয়ন—সম্ভাব্য এবং বিদ্যমান উদ্যোক্তাদের, ব্যবসা ব্যবস্থাপনা এবং ডিজিটাল দক্ষতার ওপর প্রশিক্ষণ প্রদান, পরিবেশগতভাবে টেকসই প্র্যাকটিস এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়নের জন্য এসএমই উদ্যোগে প্রণোদনা সহায়তা প্রদান, রফতানি প্রণোদনা—রফতানি প্রণোদনা, বাণিজ্য মেলা এবং আন্তর্জাতিক মান পূরণে সহায়তাসহ আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের জন্য সহায়তা প্রদান, ই-কমার্স প্লাটফর্মের বিকাশে সহায়তা করা যাতে এমএসএমইগুলো বিস্তৃত বাজারে পৌঁছাতে সক্ষম হয়। এ ক্ষেত্রগুলোয় ফোকাস করে, বাংলাদেশ সরকার আরো শক্তিশালী এবং গতিশীল এমএসএমই সেক্টর তৈরি করতে পারে, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং দারিদ্র্য হ্রাস করতে পারে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন