ঘর কিংবা ঋত্বিক ঘটকের খোঁজে

মাহমুদুর রহমান

আয়নায় শমী কায়সারের প্রতিবিম্ব ছবি: আইএমডিবি

ঋত্বিক ঘটকের সিনেমা নিয়ে লেখা হয়েছে অনেক। আলোচনা হয়েছে হয়তো তারও বেশি। ঋত্বিককে সম্মান জানিয়েছেন বহুজন। কিন্তু তাকে বুঝতে পারেননি সবাই। কেননা ঋত্বিক ঘটকের যা মানস, তাকে বোঝা কঠিন। তানজানিয়ায় তার জন্ম, পরবর্তী সময়ে ভারতে বসবাসকারী একজন ‘উদ্বাস্তু’র পক্ষে ঋত্বিকের মনোভাব বোঝা হয়তো সহজ, কেননা তার মধ্যে ছিল ঘরে ফেরার টান। ঘর খুঁজে গেছেন তিনি নিজে, এমনকি তার সিনেমায়। ঋত্বিকের প্রতিটা কাজের মধ্যে সে সুরই আমরা শুনি। আর ছিল নদী। নদী বেয়ে তিনি পৌঁছতে চেয়েছেন ফেলে আসা ঘরে।

অনুপ সিং ঋত্বিকের সে কথাই বলেন। সেই সঙ্গে নিজের সিনেমার মধ্য দিয়ে ঋত্বিককে দেখাতে চান। হয়তো নিজেও দেখতে চান। কেননা অনুপ ঋত্বিককে গুরু মনে করেন। একাধিক সাক্ষাৎকারে তিনি সে কথা বলেছেন। রীতিমতো একটা সিনেমাই নির্মাণ করেছেন ঋত্বিকের সিনেমা নিয়ে। বোধ হয় গুরুদক্ষিণা দিতেই নিজের প্রথম ফিচার ফিল্ম তৈরি করলেন ঋত্বিকের ওপর। ঠিক ঋত্বিকের ওপর নয়। এখানে তার জীবনী নেই। জীবন বা জীবনীর হিসেবে বললে ঋত্বিকের ওপর সিনেমা মূলত কমলেশ্বরের ‘মেঘে ঢাকা তারা’। অনুপ ঋত্বিকের সিনেমার নির্যাস নিয়ে নতুন করে তৈরি করেছেন একটা নদীর গল্প। এ নদী আসলে নারী। কখনো ঘরে ফেরার টান। আবার কখনো এ নদী খোদ ঋত্বিক।

বলা যেত ‘একটি নদীর নাম’ ঋত্বিকের প্রতি সম্মাননা, কিন্তু অনুপ যেভাবে সিনেমার গল্প বলে গেছেন সেখানে নানাভাবে তার জীবন, দর্শন আলোচিত হয়েছে। ফলে কেবল সম্মান নয় বরং ঋত্বিককে বোঝার, ব্যাখ্যা করার চেষ্টা হয়েছে এ সিনেমায়। তাই তাকে যদি কেউ জানতে বা বুঝতে চায়, এ সিনেমা দেখা তার কর্তব্যও বলা যেতে পারে। অবশ্য ঋত্বিককে প্রথমবার জানার জন্য এ সিনেমা উপযুক্ত নয়। বরং যারা ‘ভবা’কে কিছুটা চেনেন, তারা এ সিনেমা থেকে অনেক কিছু বের করে নিতে পারবেন।

স্রেফ সিনেমা নিয়ে বলতে গেলে বলতে হয়, এ সিনেমা ঠিক সিনেমা নয়। একটা গল্প, একটা কবিতা কিংবা একটা মঞ্চ নাটক। একটি নদীর নামকে এমন অনেক কিছুতে ভূষিত করা যায়। পুরো গল্পটা যেন একটা কবিতা। তার উপস্থাপন সেলুলয়েডে হলেও তা হয়েছে মঞ্চের আদলে। মঞ্চকে সিনেমায় এনেছেন খুব কম পরিচালক। খোদ ঋত্বিক এনেছিলেন ‘যুক্তি তক্কো গপ্পো’ সিনেমায়। ‘কোমলগান্ধার’ মঞ্চের গল্প কিন্তু মঞ্চ সিনেমায় আসেনি। ‘যুক্তি তক্কো গপ্পো’ যেমন মঞ্চের আদলে উপস্থাপিত, অনুপের এ সিনেমাও অনেকটা সে রকম। অন্তত প্রথমার্ধ তো পুরোপুরি তাই।

চমৎকার সিনেমাটোগ্রাফির এ সিনেমায় চমৎকার কাজ করেছেন একেকজন অভিনেতা-অভিনেত্রী। অনসূয়া চরিত্রে শমী কায়সার অনবদ্য। তেমনি শিবোপ্রসাদ (যিনি আজ কলকাতার নামি পরিচালক) এখানেও প্রমাণ করেছেন অভিনেতা হিসেবে তিনি কতটা যোগ্য। অদ্ভুত হলো তাকে দেখে বারবার অনিল চট্টোপাধ্যায় বলে মনে হয়েছে। পাশাপাশি এখানে আছেন ঋত্বিকের সিনেমায় অভিনয় করা শিল্পী সুপ্রিয়া দেবী, রোজি সামাদ ও ববিতা। তারা সিনেমার বিভিন্ন জায়গায় তার সঙ্গে তাদের স্মৃতির কথা বলেছেন। এ সিনেমায় আমরা অবনীশ বন্দ্যোপাধ্যায়কে (কোমলগান্ধারের ভৃগু) দেখা যায় অনেকদিন পরে। অনুপ তাকেও বাদ দেননি।

কমলেশ্বরের ‘মেঘে ঢাকা তারা’র সঙ্গে আজ এ সিনেমার তুলনা এসেই যায় এবং বলতে হয় সিনেমা হিসেবে একটি নদীর নাম এগিয়ে থাকবে। অনুপের ক্যামেরার কাজ, প্রকাশভঙ্গি অনেক বেশি শৈল্পিক। আর অনুপের সিগনেচার (যারা ‘কিসসা’, ‘সং অব স্করপিয়ন্স’ দেখেছেন, তারা বুঝবেন) এখানে উপস্থিত। অনুপের কাজ খানিকটা ডার্ক, কিন্তু এখানে অনেক বেশি স্পষ্ট। সেই সঙ্গে সিনেমাটোগ্রাফিতে কিছু জিনিস খুবই চমৎকার এক্সিকিউট করেছেন। যেমন অনসূয়া যখন প্রথম কলকাতায় আসে, সে সময়ে সুপ্রিয়া আর শমীর প্রতিবিম্ব পানিতে দেখানো, নৌকার পালের পাশে বসা বাউলের পেছনে আকাশের পট থাকা ফ্রেমটা অসাধারণ।

সংগীতের ক্ষেত্রেও অসাধারণ কাজ রয়েছে এখানে। নৌকায় করে যখন রিফিউজিরা যায় তখন লালনের ‘লীলা দেখে লাগে ভয়’-এর একটি সংস্করণ, জগদ্দলকে ফেলে আসার সময় নচিকেতার ‘হংসধ্বনি’ এবং বিভিন্ন জায়গায় ‘যুক্তি তক্কো গপ্পো’র ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ব্যবহার করা হয়েছে। এ গান, মিউজিকের সঙ্গে পুরানের নানা গল্প থেকে ঋত্বিকের সিনেমার সঙ্গে মিলিয়ে দিয়ে অনুপ দেখিয়েছেন ঋত্বিকের কাজ কত গভীর ছিল।

পিপোলস থিয়েটার ভেঙে যাওয়া, ঋত্বিককে বের করে দেয়া, শম্ভু মিত্রের চলে যাওয়া সবকিছুই এ সিনেমায় এসেছে। ভাবতে অদ্ভুত লাগে বাঙালিরা (পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ উভয়ই) আজ এসব নিয়ে কথা না বললেও (এমনকি কমলেশ্বরের সিনেমাও সরাসরি বলে না) এক ভিনভাষী এসব নিয়ে ঠিকই কথা বলেছেন এবং একদম সরাসরি বলেছেন। আইপিটিএর ভেতর ঋত্বিকরা রাজনীতি, যুদ্ধ, দেশভাগ, শরণার্থী সমস্যা ইত্যাদি নিয়ে যত কথা বলেছিলেন, সে সময় তা কেউ বলেনি। সেখান থেকে বেরিয়ে ঋত্বিক সিনেমাকেই হাতিয়ার করেছিলেন। তখন সিনেমার সংজ্ঞাই বদলে গিয়েছিল। অনুপ তা আবার নতুন করে দেখান তার সিনেমায়।

‘সিনেমার ঋত্বিক বা ঋত্বিকের সিনেমা’ নিয়ে পাতার পর পাতা লেখা যায়। অনেকে লিখেছেন। সম্ভবত সুরমা ঘটক সবচেয়ে ভালো লিখেছেন। পাশাপাশি থাকা এ মানুষ দুটি নিজেদের ভালো জানতেন। কিন্তু ‘ভবা পাগলা’কে ফ্রেমে তুলে চলচ্চিত্রে দেখানো কঠিন। সে কাজও কমলেশ্বর চমৎকার করেছেন শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়ের অসাধারণ অভিনয়ের মধ্য দিয়ে (মেঘে ঢাকা তারা, ২০১৩)। কিন্তু তারও এক যুগ আগে (২০০২) ঋত্বিকের কাজকে ঋত্বিকের মতোই করে তুলে ধরেছিলেন অনুপ। ঋত্বিকের বেদনা অনুপের ফ্রেমে স্পষ্ট।

ঘর-ছাড়া, ঘর-হারা ঋত্বিক নাকি তিতাসের শুটিংয়ের সময় এক বর্ষা রাতে সারা রাত নদীর পারে দাঁড়িয়ে ছিলেন। খুঁজেছিলেন তার হারিয়ে যাওয়া ঘর। তিনি পাননি। কিন্তু এ সিনেমায় নচিকেতা অনসূয়াকে বলে, তারা একদিন ঠিক একটা ঘর খুঁজে পাবে। ঘর খোঁজার সে যাত্রার সঙ্গে অনুপ এ সিনেমায় ঋত্বিককে খুঁজেছেন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন