নাব্য হারিয়েছে মাগুরার খরস্রোতা নবগঙ্গা

এম এম আলিমুজ্জামান উজ্জ্বল, মাগুরা

অপরিকল্পিত বাঁধ ও সেতু নির্মাণের কারণে পলি জমে ভরাট হয়ে যাচ্ছে নবগঙ্গা নদী ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

একসময় মাগুরায় নৌ-বাণিজ্যের অন্যতম রুট ছিল নবগঙ্গা নদী। জেলায় ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটে নদীটি কেন্দ্র করেই। চলাচল করত জাহাজ, লঞ্চ, স্টিমারসহ বড় নৌযান। তবে দূষণ আর পলি জমে নাব্য হারিয়েছে খরস্রোতা নদীটি। এখন নৌকারও দেখা মেলা ভার। ২০১৭ সালে ৪১ কোটি টাকা ব্যয়ে পারনান্দুয়ালী থেকে সদর উপজেলার আলোকদিয়া পর্যন্ত ১১ কিলোমিটার নদী খনন করা হয়। তবে তাতেও নাব্য ফেরেনি। বরং অর্থের অপচয় হয়েছে বলে মনে করেন নদীপাড়ের বাসিন্দারা।

শহরের পারনান্দুয়ালীর বাসিন্দা তোতা বিশ্বাস তার ৮৪ বছরের জীবনে খুব কাছ থেকে দেখেছেন নবগঙ্গা নদীকে। একসময় মাগুরা থেকে জাহাজ, লঞ্চ বা স্টিমারে খুলনায় গেছেন। নদীতে ইলিশ মাছও দেখেছেন। পাওয়া যেত বড় রুই, কাতল, মৃগেলসহ দেশী প্রজাতির মাছ। নদী থেকে মাছও ধরেছেন তোতা বিশ্বাস। তার পূর্বপুরুষের পেশাই ছিল মাছ ধরা। বলতে গেলে এর কোনো কিছুই এখন নদীতে নেই।

নদীটির করুণ দশা নিয়ে আক্ষেপ করেন শহরের বরুণাতৈল এলাকার সিরাজুল ইসলাম। বলেন, নদীর এ পরিণতির জন্য শুধু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতাই দায়ী।

একই কথা বলেন নবগঙ্গা নদীপাড়ের বাসিন্দা মাগুরা জেলা বণিক সমিতির আহ্বায়ক হুমায়ন কবির রাজা। তিনি জানান, নবগঙ্গা নদীকে কেন্দ্র করে মাগুরা জেলায় ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটে। আজকের যে জেটিসি রোড অর্থাৎ জুট ট্রেডিং করপোরেশনের অফিস ও গুদাম সেটি নবগঙ্গা নদীর কারণেই হয়েছিল। পাট নিয়ে বড় বড় নৌযান খুলনা ও ঢাকায় যেত। এখন নৌকা চলা তো দূরে থাক, নদীটি নাব্য হারিয়ে মরতে বসেছে।

নবগঙ্গা নদীই মাগুরাবাসীর পরিচয় বলে মনে করেন নদী বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি বারিক আনজাম। সেই নদী আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। অচিরেই ড্রেজিং না করলে নদীটির আরো করুণ দশা হবে বলে আশঙ্কা তার।

চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার মাথাভাঙ্গা নদী থেকে উৎপত্তি হয়ে ১৪৫ কিলোমিটার দীর্ঘ কুমার নদ মাগুরা শ্রীপুর উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবেশ করেছে। এ নদীই মাগুরা পৌরসভার পারনান্দুয়ালী এলাকায় এসে নবগঙ্গা নাম ধারণ করেছে। ভারতের উজান থেকে পানিপ্রবাহ কমে যাওয়া, নদীর বিভিন্ন অংশে অপরিকল্পিত বাঁধ ও সেতু নির্মাণ, পলি পড়ে নদীটি ভরাট হয়ে যাচ্ছে। নদীর বিভিন্ন স্থানে জেগে উঠেছে চর।

মাগুরা পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালে ৪১ কোটি টাকা ব্যয়ে নবগঙ্গার পারনান্দুয়ালী থেকে আলোকদিয়া পর্যন্ত ১১ কিলোমিটার খনন করা হয়।

তবে নদীপাড়ের বাসিন্দারা বলছেন, নদীর গড় প্রস্থ যেখানে ৩০০ মিটার, সেখানে খনন করা হয়েছে মাত্র ৮০ মিটার। এছাড়া খননের মাটি ফেলা হয়েছে নদীর মধ্যেই। এ কারণে নদীর মাঝে ঢিবি তৈরি হয়েছিল, বর্ষা মৌসুমে সেটা নদীতে মিশে গেছে। এ কারণে নদী খনন করা হলেও সুফল পাওয়া যায়নি। বরং বলা যায় খননের অর্থই গচ্চা গেছে।

শুধু নবগঙ্গা নয়, জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত গড়াই, কুমার নদ; চিত্রা, বেগবতী, মধুমতী, ফটকী নদীও নাব্য হারিয়েছে। পানি ধারণক্ষমতা কমে যাওয়ায় এসব নদী বর্ষা মৌসুমে তীরবর্তী এলাকাগুলোকে প্লাবিত করছে। আবার শুষ্ক মৌসুমে নদীগুলোর বেশির ভাগ অংশ শুকিয়ে চর জেগে উঠছে। এর মধ্যে ফটকী, চিত্রা ও বেগবতী নদী খননের অভাবে পানিপ্রবাহ হারিয়েছে।

পাউবোর তথ্যমতে, অনুমোদন হওয়া প্রকল্পের অর্থায়নে নদী খনন, বিভিন্ন স্থানে গোসলের জন্য আটটি ঘাট নির্মাণ, পানি নিয়ন্ত্রণে শহরের ঢাকা রোডে নদীর ওপর থাকা পুরনো রেগুলেটরের সংস্কার করা হবে। ফলে নদীতে মাছের উৎপাদন বাড়বে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা এবং উদ্ভিদ ও প্রাণীর নিরাপদ বংশ বিস্তারও নিশ্চিত হবে। পাশাপাশি নদীর তীরবর্তী এলাকার বাসিন্দারা কৃষিজমিতে সেচ সুবিধাসহ শুষ্ক মৌসুমে পানি ব্যবহার করতে পারবে।

এ ব্যাপারে পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সারোয়ার জাহান সুজন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘২০১৭ সালে ৪১ কোটি টাকা ব্যয়ে নবগঙ্গা নদীর ১১ কিলোমিটার খননসহ অন্যান্য সংস্কারকাজ করা হয়েছে। তাতে জীববৈচিত্র্য, প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও পরিবেশ কিছুটা রক্ষা হয়েছে। পাশাপাশি কৃষিজমিতে সেচ কার্যক্রম চালানোসহ নদী-তীরবর্তী এলাকার মানুষের জীবনমানের উন্নয়নও হচ্ছে। তবে জেলার অন্যান্য নদী পুনর্খনন জরুরি হয়েছে। মাগুরার ওপর দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলো খননের প্রস্তাবসহ দেশের ৬৪টি জেলায় জলাশয় পুনর্খনন প্রকল্পের প্রস্তাব করা হয়েছে। যদি প্রকল্পটি পাস হয়, তাহলে শুধু মাগুরা কেন, সারা দেশে নদ-নদীতে পানিপ্রবাহ ফিরে আসবে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন