![](https://bonikbarta.net/uploads/news_image/news_387293_1.jpg?t=1722040156)
চলতি
বছর বর্ষা মৌসুম এখনো শুরু হয়নি। এর আগেই মুন্সিগঞ্জের
লৌহজংয়ে পদ্মা নদীর ভাঙন তীব্র হয়েছে। গত এক সপ্তাহে
ভিটেমাটি হারিয়ে আকাশের নিচে দিন কাটছে অর্ধশত পরিবারের। অথচ প্রায় ৪৮০ কোটি টাকা ব্যয়ে ওই এলাকায় চলছে
পদ্মা সেতুর বাম তীর সংরক্ষণ প্রকল্প। স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রকল্পকাজে ধীরগতির কারণে নদীভাঙন ঠেকানো যাচ্ছে না।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা যায়, নদী তীর রক্ষা প্রকল্পে ৯ দশমিক ১০ কিলোমিটার এলাকায় নির্মাণ হচ্ছে স্থায়ী বাঁধ। আর ৪ দশমিক ৬২ কিলোমিটার এলাকায় নেয়া হচ্ছে ভাঙন প্রতিরোধক অস্থায়ী ব্যবস্থা। ২০২১ সালের মে মাসে কাজ শুরু হয়। আগামী সেপ্টেম্বরে প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হবে। তিন বছরে কাজ হয়েছে ৩৩ শতাংশ। আগামী তিন মাসের মধ্যে প্রকল্পের অবশিষ্ট ৬৭ শতাংশ কাজ শেষ করার নির্দেশনা রয়েছে।
প্রকল্পসংশ্লিষ্টদের দেয়া তথ্যানুযায়ী, এক দশক আগে পদ্মায় স্রোতের যে গতিপথ ছিল, বর্তমানে তা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষ করে পদ্মা সেতু তৈরি হওয়ার পর এটা ঘটছে। খনন না করায় পদ্মার বুকে জেগে উঠছে একাধিক বালিচর। যার প্রভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে নদীর পানিপ্রবাহ। ফলে তীরের দিকে পানির চাপ বেড়ে সৃষ্টি হচ্ছে স্রোতের ঘূর্ণি। এ কারণে ব্যাপক ভাঙনের শঙ্কা প্রকাশ করেছেন খোদ পাউবো কর্মকর্তারা।
গত রোববার ওই এলাকায় গেলে কথা হয় বাসুদেব-পার্বতী রাজবংশী দম্পতির সঙ্গে। তারা জানান, তিন কক্ষের পাকা ভবন ও একটি টিন-কাঠের ঘর ছিল তাদের। বাড়ির সঙ্গে নদী থাকলেও জিও ব্যাগ ফেলা ছিল। শুকনো মৌসুমে ব্লক ফেলে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করা হবে, তাই নিশ্চিন্তে ছিলেন তারা। কিন্তু মুহূর্তে বাড়িটি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে।
নতুন করে পদ্মার ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে লৌহজং-তেউটিয়া, কুমারভোগ, গাঁওদিয়া, কলমাসহ আরো বেশ কয়েকটি ইউনিয়ন। তবে গত এক সপ্তাহের ভাঙনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নদী তীরবর্তী গ্রাম শিমুলিয়া, খড়িয়া, দক্ষিণ হলদিয়া, সিংহেরহাটি, তেউটিয়া, রাউৎগাঁও, বাগেরবাড়ী, সুন্দিসার, ডহরীসহ আরো কয়েকটি গ্রাম।
ক্ষতিগ্রস্তদের অভিযোগ, ভাঙন ঠেকাতে পাউবোর ফেলে রাখা জিও ব্যাগ তীব্র ঢেউয়ে তলিয়ে গেছে। এ কারণে বড় আকারের ফাটল ধরে মাটি ভেঙে পড়েছে নদীতে। এরই মধ্যে বিলীন হয়েছে অন্তত অর্ধশতাধিক বসতঘর, গাছপালা ও কৃষিজমি। এছাড়া হুমকির মুখে স্কুল, মসজিদ, মাদ্রাসাসহ নানা স্থাপনা। যাদের ভিটা ভাঙেনি তারা এখন নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন। আতঙ্কে অনেকে ঘরবাড়ি ভেঙে সরিয়ে নিচ্ছেন। তাৎক্ষণিক শ্রমিক না পাওয়ায় ঘরবাড়ি ভেঙে সরিয়ে নিতে বেগ পেতে হচ্ছে তাদের।
স্থানীয় প্রশাসনের তথ্যানুযায়ী, গত এক সপ্তাহে ভাঙন আতঙ্কে ব্যক্তি উদ্যোগে ঘরবাড়ি ভেঙে অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছে অন্তত ৩১টি পরিবার।
ভাঙন ঠেকাতে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় বালিভর্তি জিও ব্যাগ ফেলার কার্যক্রম শুরু করেছে পাউবো। গত দুইদিনে ভাঙন ঠেকাতে ফেলা হয়েছে কয়েক হাজারের বেশি জিও ব্যাগ। তবে নদীতে গভীরতা বেশি থাকায় ব্যাহত হচ্ছে এ কার্যক্রম।
সরজমিনে আরো দেখা যায়, রোববার সকালে ৪ ঘণ্টার ব্যবধানে প্রায় এক থেকে দেড়শ মিটার এলাকা নদীতে ভেঙেছে।
ক্ষতিগ্রস্তরা জানান, গত ২৭ মে সকাল সাড়ে ৬টার দিকে লৌহজং-তেউটিয়া ইউনিয়নের বড়নওপাড়ায় হঠাৎ পদ্মায় ভাঙন দেখা দেয়। ৪ ঘণ্টার ব্যবধানে একটি পাকা ভবন ও তিনটি বসতঘর তলিয়ে যায়। টানা কয়েকদিনের বৃষ্টি, নদীর ঢেউ ও স্রোতে ভাঙনের ভয়াবহতা দেখে নদীপারের বাসিন্দারা দিশেহারা হয়ে পড়েন। বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এলাকা। রাত নামলে আতঙ্ক বাড়ে।
পদ্মায় জেগে ওঠা চরের প্রভাবে নদীর গতিপথ পরিবর্তনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন পাউবো মুন্সিগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী তৌহিদুল ইসলাম। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কয়েক দিন ধরে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া, উজানের ঢলের পানি সাগরের দিকে যাওয়ায় নদীতে এখন প্রচণ্ড স্রোত বইছে। মূল পদ্মায় চর জেগেছে। সেজন্য জলযানগুলো নদীর এ অংশের তীরঘেঁষে যাতায়াত করছিল। স্রোতে হঠাৎ করেই নদীর তলদেশ থেকে মাটি ও জিওব্যাগ সরে ভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙন প্রতিরোধে জিও ব্যাগ ফেলা হচ্ছে।’
অন্যদিকে অবৈধ বালি উত্তোলনসহ তীরঘেঁষে অবৈধ বাল্কহেড চলাচল বন্ধে শিগগিরই স্থায়ী পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. জাকির হোসেন।
তিনি বলেন, ‘ভাঙনের খবর শুনে চারবার ওই এলাকা পরিদর্শন করেছি। ক্ষতিগ্রস্তদের শিগগিরই পুনর্বাসনে উদ্যোগ নেয়া হবে।’
ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত গৃহবধূ পূর্ণিমা হালদার বলেন, ‘বিয়ের পর থেকে পদ্মাপারে শ্বশুরবাড়িতে নতুন সংসার গুছিয়েছি। দুদিনের ব্যবধানে মাথাগোঁজার ঠাঁইটুকু হারালাম। এখন বাঁচব কীভাবে? পদ্মার ভাঙন সব কেড়ে নিয়েছে আমাদের।’ তিনি অভিযোগ করেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। যদি বর্ষা মৌসুমের আগে দ্রুতগতিতে বালিভর্তি জিও ব্যাগ ফেলা হতো তাহলে এভাবে নদী ভাঙত না।’
আরেক ক্ষতিগ্রস্ত তপন হালদার বলেন, ‘২৪ লাখ টাকা খরচ করে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থাকার জন্য নতুন ভবন উঠিয়েছি মাত্র। ভাগ্য আমাদের সহায় হয়নি, পদ্মার ভাঙন পথে বসিয়ে দিল আমাদের। স্থানীয় চেয়ারম্যান-মেম্বারদের কতবার বলেছি, পদ্মায় বালি কাটা বন্ধে ব্যবস্থা নিন। কেউ কথা শোনেননি।’
ভাঙনের শিকার পিন্টু মোল্লা বলেন, ‘নদীশাসনের সময় এভাবে ঘর বিলীন হবে ভাবতেও পারিনি। আমার তিনটি ঘরের মধ্যে একটি বিলীন হয়েছে। একটি সরিয়ে নিয়েছি, অন্যটিও সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছি।’ তিনি জানান, বর্তমান জায়গায় প্রায় ১০০ বছরের বসতি তাদের। ৩৫ বছর আগে বাড়ির এক একর জমি পদ্মার পেটে গেছে। বাকি ছিল ৩৬ শতাংশ। তাও চলে গেল।
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ভাঙন প্রতিরোধের কাজ ঠিকঠাক হলে এমন পরিস্থিতি তৈরি হতো না। মাঝখানে এক মাসের মতো এ প্রকল্পের কাজ বন্ধ ছিল। যদি বন্ধ না থাকত, তাহলে ভাঙন নাও হতে পারত।’