আমদানি ব্যয় হ্রাসের প্রভাব নেই

রিজার্ভের ক্ষয় কমাতে না পারলে অর্থনীতির বড় ক্ষতি হতে পারে

ছবি : বণিক বার্তা

অর্থনীতির অন্যতম সূচক বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ ছাড়া একটি দেশ জ্বালানি তেল, খাদ্যদ্রব্য, ওষুধের মতো জরুরি পণ্য আমদানি করতে পারে না। দেশের বিদেশী ঋণ ও ঋণের সুদ পরিশোধও করা হয় রিজার্ভ থেকে। বেশকিছু কারণেই দুই বছরের বেশি সময় ধরে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচক রিজার্ভের স্থিতি কমছে। এ কারণে তৈরি হয়েছে অর্থনীতিতে নানা অস্থিরতা। রিজার্ভের স্থিতি ধরে রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উদ্যোগের কথা বলেছে। বাস্তবে এসব উদ্যোগ তেমন কাজ করেনি রিজার্ভ স্থিতি রক্ষার্থে। দেশের রিজার্ভ কমে যাওয়ার পেছনে রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিগত সমন্বয়হীনতা ও নেতৃত্বের অভাবকেই দায়ী করছেন অর্থনীতিবিদরা। তাই রিজার্ভের ক্ষয় কমাতে না পারলে অর্থনীতির বড় ক্ষতি হতে পারে। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব হিসাবায়ন পদ্ধতি অনুসারে, ১৬ মে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার গ্রস রিজার্ভ ছিল ২ হাজার ৩৯০ কোটি বা ২৩ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলার। তবে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসারে (বিপিএম৬) ওইদিন রিজার্ভ ১৮ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলার ছিল। এ দুই হিসাবের বাইরেও নিট রিজার্ভের হিসাব রাখে বাংলাদেশ ব্যাংক। আইএমএফকে জানানো সে হিসাব অনুযায়ী, দেশের ব্যবহারযোগ্য নিট রিজার্ভ এখন ১৩ বিলিয়ন ডলারেরও কম। যদিও ২০২১ সালের আগস্টে দেশের গ্রস রিজার্ভ রেকর্ড ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছিল। 

প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী, কোনো দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি দায় মেটানোর মতো রিজার্ভ থাকতে হয়। এখন প্রতি মাসে ৫ বিলিয়ন ডলারের আমদানি দায় পরিশোধ করতে হচ্ছে। সে হিসাবে দেশের নিট রিজার্ভ দিয়ে তিন মাসের আমদানি দায়ও পরিশোধ সম্ভব হবে না। এ পরিস্থিতিকে যেকোনো দেশের জন্য ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ বলে মনে করা হয়ে থাকে।

রিজার্ভ কমে যাওয়াকে বাণিজ্য ও মুদ্রানীতি দিয়ে মোকাবেলার চেষ্টা করা হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে টাকার মূল্যমান কৃত্রিমভাবে ধরে রাখা হয়েছে। অর্থনীতিবিদরা ডলারের বিনিময় হারকে বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে বলেছিলেন শুরু থেকেই। বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া হলে এ সংকট এত প্রকট হতো না। টাকার মূল্যমানকে কৃত্রিমভাবে ধরে রেখে চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির রাশ কিছুটা টেনে ধরা যাবে বলে মনে করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। তাতেও কাজ হয়নি। কারণ এ ব্যবস্থা টেকসই নয়। অর্থশাস্ত্র বলে, মুদ্রানীতির সঙ্গে আর্থিক নীতির সমন্বয় করতে হয়। মূল্যস্ফীতি কমাতে হলে সুদের হার বাড়াতে হয়, কিন্তু সরকার তা পারেনি। 

বৈদেশিক মুদ্রার আয় ও ব্যয়ের মধ্যে ভারসাম্য নেই। ফলে রিজার্ভ ধরে রাখা যাচ্ছে না। তাই রিজার্ভ বাড়তে আয় ও ব্যয়ের মধ্যে ভারসাম্য বিধান করতে হবে। 

বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানি নিয়ন্ত্রণ করায় বাণিজ্য ভারসাম্য কিছুটা ভালো হয়েছ। কিন্তু সামগ্রিক অর্থনীতিতে তা নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিয়েছে। আমদানি নিয়ন্ত্রিত থাকায় উৎপাদন কমেছে ও উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে, যা মূল্যস্ফীতিতেও প্রভাব ফেলেছে। 

কভিডের পরপরই অর্থনীতিবিদরা বলেছিলেন, ২০২৩-২৪ সালে দায়-দেনার ক্ষেত্রে বড় ধরনের ধাক্কা আসবে। সে ধাক্কা এখন এসেছে। বড় বড় প্রকল্পের জন্য যে বিভিন্ন সুদে অর্থ নেয়া হয়েছে, তা পরিশোধের সময় এসেছে। কিন্তু এসব প্রকল্প থেকে রাতারাতি আয় আসছে না। এলেও তা বিদেশী মুদ্রায় নয়। বিশেষত বিদেশী দায়দেনা শোধ করার কারণে বৈদেশিক রিজার্ভের ওপর চাপ বেড়েছে। সেই সঙ্গে তেলসহ বিভিন্ন পণ্যের অপরিশোধিত দেনা শোধ করতে হচ্ছে। আবার বাজার স্থিতিশীল রাখতে ডলার বিক্রি করতে হয়েছে। ফলে মজুদের ওপর চাপ আরো বেড়েছে। এ পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে মূলত অব্যবস্থাপনা ও সমন্বয়হীনতার কারণে। 

সরকার এক লাফে সুদহার বাড়িয়েছে, যেটা ধীরে ধীরে বাড়াতে পারত। একই সঙ্গে ধীরে ধীরে টাকার মূল্যমান সমন্বয় করা দরকার ছিল। দীর্ঘদিন ধরেই বলা হ্চ্ছে, বিনিময় হারকে বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে। কিন্তু তা করা হয়নি। এক্ষেত্রে সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতিমালা প্রণয়নে চিন্তার বিন্যাস ও সমন্বয়ের অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। নীতি প্রণয়নে যে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব দেয়ার কথা ছিল, তারা অকার্যকর বলে মনে হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তথ্য-উপাত্তের অপর্যাপ্ততা ও তথাকথিত গোপনীয়তা। তাই এ অবস্থা থেকে উত্তরণে দরকার সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতিমালা প্রণয়নে সমন্বয়। 

ব্যাংক খাতের অবস্থা শোচনীয় এবং এটি আরেকটি বড় সমস্যা। অনেক দিন ধরেই এ খাতের অবস্থা খারাপ, এখন সবচেয়ে খারাপ। ব্যাংকের সঞ্চিতির অবস্থা খারাপ। এরপর রাজস্ব আদায় কম। আমদানি নিয়ন্ত্রণ ও ঋণপ্রবাহ কমে যাওয়ার কারণে বিনিয়োগ কমছে। ফলে আয় ও কর্মসংস্থান কমছে।

রফতানির বড় অংকের অর্থ অপ্রত্যাবাসিত থেকে যাচ্ছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) পরিসংখ্যান থেকে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সংকলিত তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) বিশ্ববাজারে ২ হাজার ৭৫৪ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছে। ব্যাংকিং চ্যানেলে আসা অর্থপ্রবাহের পরিসংখ্যান থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, পণ্য রফতানি বাবদ জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে অর্থপ্রাপ্তি হয়েছে ১ হাজার ৮৯৬ কোটি ডলার। এ হিসাবে ঘোষিত রফতানি ও অর্থপ্রাপ্তির পার্থক্য প্রায় ৮৫৮ কোটি ডলার বা ৩১ শতাংশের কিছু বেশি। এ হিসাব থেকে বলা যায়, রফতানির অর্থ অপ্রত্যাবাসিত থাকার কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে তেমন ভূমিকা রাখতে পারছে না। সাধারণত আমদানি-রফতানির আড়ালে অর্থ পাচার হয় বেশি। পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে মূল্য বেশি দেখানো (ওভার ইনভয়েসিং) এবং রফতানির ক্ষেত্রে মূল্য কম দেখানো (আন্ডার ইনভয়েসিং) অর্থ পাচারের অন্যতম কৌশল। এছাড়া ভুয়া রফতানি লেটার অব ক্রেডিট (এলসি) এবং ক্রয়চুক্তির মাধ্যমেও অর্থ পাচার হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর নজরদারি ও তদন্ত প্রক্রিয়া জোরদার করা প্রয়োজন। পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার কাজটি যেহেতু অপেক্ষাকৃত জটিল, সেহেতু পাচার রোধের বিষয়টিতে জোর দেয়া উচিত বেশি। অন্যদিকে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনতে এ-সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহের জন্য বিদেশে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে। রফতানির অর্থ প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নিতে হবে। রফতানি আয় যথাযথভাবে প্রত্যাবাসিত হলে দেশের রিজার্ভ বাড়বে বলে আশা করা যায়। 

রিজার্ভ বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরেই ডলারের বিনিময় হার আনুষ্ঠানিক চ্যানেলের চেয়ে হুন্ডি মার্কেট বা খুচরা বাজারে বেশি। এ সুযোগে বেড়েছে হুন্ডি ও হাওলার দৌরাত্ম্য। আনুষ্ঠানিক চ্যানেলের চেয়ে হুন্ডির মাধ্যমে দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে। সংকটের সময় সাধারণত অনানুষ্ঠানিক বাজারের বাড়বাড়ন্ত হয়, এবারো তা-ই হচ্ছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে এসব বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। ফলে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে দেশে বৈদেশিক মুদ্রা আসা কমে যাওয়ায় ধারাবাহিকভাবে টাকার অবমূল্যায়ন হচ্ছে এবং রিজার্ভ কমছে। রিজার্ভ বাড়াতে হুন্ডির দৌরাত্ম্য কমাতে ডলারের বিনিময় হারকে বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। সর্বশেষ চলতি মাসে দেশীয় মুদ্রাকে অবমূল্যায়ন করে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম ১১৭ টাকা নির্ধারণ করেছে। যদিও এ দর আরো আগে নির্ধারণ করা দরকার ছিল। 

দেশে সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের ব্যয় বেড়েছে। তাই ঋণের চাহিদা বাড়ছে। ঋণের মাধ্যমে অবকাঠামো হচ্ছে, কিন্তু যানজট ও লোডশেডিং কমছে না। ভোক্তা ও ব্যবহারকারীরা ঋণের কল্যাণকর প্রভাব থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। সেই সঙ্গে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে বেরিয়ে পরিবেশবান্ধব জ্বালানির দিকে যাওয়ার কোনো পরিকল্পনা সরকারের নেই। ফলে জ্বালানি মূল্যবৃদ্ধিজনিত কারণেও বিপুল পরিমাণ ডলার বেরিয়ে গেছে এবং আরো যাবে।

বর্তমানে রিজার্ভ যে অবস্থায় রয়েছে বা আরো কমে হুট করে কোনো সংকট এলে তা মোকাবেলা করা উঠিন হবে। এক্ষেত্রে দেশে দুটি ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। একটি হলো ডলারের জোগান কমে এলে তা মোকাবেলায় সক্ষমতা না থাকা এবং যেকোনো ধরনের দুর্যোগ এলে তা সামাল দেয়া। রিজার্ভ যথাযথ না থাকলে উভয় ক্ষেত্রেই ঝুঁকিতে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হবে। রিজার্ভ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার একটা মাধ্যম। ডলারের দর বেঁধে দিলেই হবে না। বরং জোগান নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু আমাদের রফতানি আর রেমিট্যান্স ছাড়া ডলারের আর কোনো উৎস নেই। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দেশের নিজস্ব মুদ্রার দেনা পরিশোধ ও মুদ্রানীতি প্রভাবিত করতে ব্যবহার হতে পারে। পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দেশের অর্থনৈতিক বিপর্যয় এড়ানোর ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। দেশীয় মুদ্রামানের দ্রুত অবমূল্যায়ন ঘটলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ব্যবহার করে বাজারের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তাই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতিমালা প্রণয়নে ও সময়োচিত উদ্যোগ নিতে হবে। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন