অফশোর ব্যাংকিং

ইতিবাচক ফল পেতে হলে ব্যাংক খাতে আস্থা বাড়াতে হবে

ছবি : বণিক বার্তা

বাংলাদেশে অফশোর ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু হয়েছিল ১৯৮৫ সালে। চলতি বছর অফশোর ব্যাংকিং আইন ২০২৪-এর খসড়ার নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়। নতুন আইনে অফশোর ব্যাংকিংয়ে বিদ্যমান আগের অনেক নিয়মকানুন সংস্কার ও শিথিল করা হয়েছে, যা বৈদেশিক মুদ্রার সংকট কাটাতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়। ডলারের প্রবাহ বাড়লে দেশে রিজার্ভ পতনও রোধ করা যাবে। এছাড়া বিনিয়োগ আকর্ষণেও এটি সহায়ক হবে। 

অফশোর ব্যাংকিং হলো ব্যাংকের ভেতরে পৃথক ব্যাংকিং সেবা। প্রচলিত ব্যাংকিং বা শাখার কার্যক্রমের চেয়ে ভিন্ন অফশোর ব্যাংকিং। আমানত গ্রহণ ও ঋণ দেয়া—দুটিই বৈদেশিক উৎস থেকে আসে ও বিদেশী গ্রাহকদের দেয়া হয়। অর্থাৎ এই ব্যাংকিং কার্যক্রম শুধু অনিবাসীদের মধ্যেই সীমিত থাকে। 

সব পদ্ধতিরই কিছু সুবিধা ও অসুবিধা থাকে। অফশোর ব্যাংকিংয়ের অন্যতম অসুবিধা হলো, এর মাধ্যমে অর্থ পাচার হয় বেশি। এর বাইরে সঠিক ব্যবস্থাপনায় অফশোর ব্যাংকিংয়ের সুবিধাই বেশি, বিশেষ করে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বৃদ্ধিতে। কেননা এতে সব লেনদেন হয় বৈদেশিক মুদ্রায়। অফশোর ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে পাঁচ ধরনের বিদেশী মুদ্রা ডলার, পাউন্ড, ইউরো, জাপানি ইয়েন ও চীনা ইউয়ানে। 

প্রবাসী বাংলাদেশীদের জন্য ডলারে আমানত রাখার সুযোগ দিয়ে ২০২৩ সালের ২৯ নভেম্বর প্রজ্ঞাপন জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, ব্যাংকের অফশোর ইউনিটের মাধ্যমে হিসাব খুলে প্রবাসী বাংলাদেশীরা বৈদেশিক মুদ্রা বা ডলারে মেয়াদি আমানত রাখতে পারবেন। মেয়াদ শেষে কিংবা যেকোনো সময়ে প্রবাসীরা ডলারে ওই আমানত তুলে নিতে পারবেন। বাংলাদেশের বাইরে অবস্থানকারী প্রবাসী বাংলাদেশী, বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত বিদেশী নাগরিক, বিদেশে নিবন্ধিত ও পরিচালিত প্রতিষ্ঠান এবং প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী এ আমানত হিসাব পরিচালনার সুযোগ পাবেন। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা মেনে প্রবাসীদের জন্য দুই ধরনের ব্যাংক হিসাব চালু করে দেশের কয়েকটি ব্যাংক। প্রথমটি হলো আন্তর্জাতিক ব্যাংক হিসাব বা আইবি অ্যাকাউন্ট। প্রবাসীদের দেশে অবস্থানরত যেকোনো স্বজন ব্যাংকে গিয়ে এ হিসাব চালু করতে পারবেন। প্রবাসী বাংলাদেশী ওই ব্যাংক হিসাবে ডলার পাঠাবেন এবং দেশে থাকা স্বজন ব্যাংক হিসাবটি পরিচালনার দায়িত্বে থাকবেন। অন্যটি হলো অফশোর ব্যাংকিং ফিক্সড ডিপোজিট অ্যাকাউন্ট। যেকোনো প্রবাসী বাংলাদেশী সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের ওয়েবসাইটে গিয়ে এ হিসাব খুলতে পারবেন। হিসাব খোলার পর যেকোনো মেয়াদে প্রবাসীরা ডলারে বা বিদেশী মুদ্রায় আমানত রাখতে পারবেন। পরবর্তী সময়ে যেকোনো সময় জমাকৃত আমানত মুনাফাসহ প্রত্যাবাসন করা যাবে। এ দুই ধরনের ব্যাংক হিসাবে জমাকৃত আমানতের মুনাফার ওপর বাংলাদেশে কোনো কর পরিশোধ করতে হবে না। একইভাবে এ হিসাব পরিচালনায় কোনো চার্জও প্রদান করতে হবে না। এসব সুবিধার কারণে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন প্রবাসীরা অফশোর ব্যাংকিংয়ে আকৃষ্ট হবেন এবং বৈদেশিক মুদ্রার আমানত বাড়বে, যা দেশে ডলার সংকট মোকাবেলায় ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে।

উদাহরণস্বরূপ পাকিস্তানের দিকে লক্ষ করতে পারি আমরা। বণিক বার্তার প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেউলিয়াত্বের দ্বারপ্রান্তে চলে যাওয়া পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নেমে এসেছিল মাত্র ৩ বিলিয়ন ডলারের ঘরে। কিছুদিন হলো নাজুক সে পরিস্থিতি থেকে কিছুটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে দেশটি তাদের ‘রোশান ডিজিটাল অ্যাকাউন্ট’ নামের একটি ব্যাংক সেবার মাধ্যমে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা প্রবাসী পাকিস্তানিরা এরই মধ্যে এ ব্যাংক হিসাবে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার জমা করেছেন। এ মুহূর্তে মুদ্রাবাজারে পারফরম্যান্সে এশিয়ার শীর্ষ মুদ্রা পাকিস্তানি রুপি। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে প্রতি ডলারের বিনিময় হার ছিল ৩০৮-৩১০ রুপি। বর্তমানে তা ২৭৮ রুপিতে নেমে এসেছে। এ সময়ে ডলারের বিপরীতে পাকিস্তানি রুপি ১০ শতাংশের বেশি শক্তিশালী হয়েছে। আর পাকিস্তানের নিট রিজার্ভ ৩ বিলিয়ন থেকে বেড়ে ৯ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে।

বিদেশে অবস্থানকারী পাকিস্তানিরা অল্প কিছু নথিপত্র দিয়ে অনলাইনেই রোশান ডিজিটাল অ্যাকাউন্ট চালু করতে পারেন; পুরো প্রক্রিয়াটিই সম্পাদন হচ্ছে ডিজিটাল প্রক্রিয়ায়। অর্থাৎ এ হিসাব চালুর ক্ষেত্রে ব্যক্তির উপস্থিতির প্রয়োজন নেই। আবার ডলারে জমাকৃত আমানত প্রত্যাহার প্রক্রিয়াটিও বেশ সহজ। আকর্ষণীয় মুনাফার পাশাপাশি প্রক্রিয়াগত জটিলতা না থাকায় রোশান ডিজিটাল অ্যাকাউন্টে ডলার জমা রাখতে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন ও হচ্ছেন প্রবাসী পাকিস্তানিরা। 

আড়াই বছর ধরে বাংলাদেশে ডলার সংকট বিরাজমান। এ সময়ে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন ঘটেছে প্রায় ৪০ শতাংশ। ডলারের গ্রস রিজার্ভ ১৮ বিলিয়নের ঘরে (আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী বিপিএম৬ পদ্ধতির হিসাবায়নে) নেমে এসেছে। আর ব্যবহারযোগ্য নিট রিজার্ভ নেমে এসেছে মাত্র ১৩ বিলিয়ন ডলারে। ডলারের জোগান বাড়াতে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। রোশান ডিজিটাল অ্যাকাউন্টের মতো অফশোর ডিপোজিট অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে বাংলাদেশের পরিস্থিতির উন্নয়ন হতে পারে। যদিও অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন এ অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ডলারে আমানত সংগ্রহ করতে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে দেশের ব্যাংক খাতের প্রতি জনগণের আস্থাহীনতা। মানুষের হাতে নগদ অর্থ ধরে রাখার প্রবণতা বাড়ার পেছনে অন্যতম কারণ এটি। সুতরাং এক্ষেত্রে অনাস্থা দূরীকরণে সর্বপ্রথম কাজ করতে হবে। এ বিষয়ে প্রবাসীদের পুরো প্রক্রিয়ার স্পষ্ট স্বরূপ তুলে ধরতে হবে এবং বাংলাদেশ ব্যাংককে কাজ করতে হবে ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায়। ব্যাংক খাতে আস্থা ফিরলে অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে—এ প্রত্যাশা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন