অভিমত

পৌর এলাকায় বিরোধ মীমাংসা সহজীকরণ করতে প্রয়োজন আইনি সংস্কার

মো. মোস্তফা হুছাইন

ছবি : বণিক বার্তা

বিচার ব্যবস্থা একটি রাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ। মানুষের সর্বশেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে বিবেচনা করা হয় এ বিভাগকে। বাংলাদেশে বর্তমানে বিচার ব্যবস্থায় আদালতের পাশাপাশি বিকল্প পদ্ধতিতে বিরোধ নিরসন করার সুযোগ রয়েছে। দেওয়ানি কার্যবিধি, অর্থঋণ আদালত আইন, সালিশ আইনসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন আইনে বিকল্প ব্যবস্থায় বিরোধ মীমাংসার বিধান অন্তর্ভুক্ত করেছে। এর মাধ্যমে রাষ্ট্র মূলত আদালতে মামলার জট কমানোর জন্যই বিকল্প ব্যবস্থায় মীমাংসার ওপর নির্ভর করছে, যাতে সাধারণ জনগণ বিচার প্রার্থনায় হয়রানির শিকার না হয়। 

একটি সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়েছে যে বাংলাদেশের আদালতগুলোয় ৪২ লাখ মামলা বিচারাধীন। যেখানে একজন বিচারকের অধীনে প্রায় ১ হাজার ৮৮৩টি মামলা চলমান। রাষ্ট্রে বর্তমানে ৯ হাজার ৪৪৪ জন নাগরিকের বিপরীতে একজন বিচারক নিয়োজিত রয়েছেন। বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা ছাড়া ভবিষ্যতে মামলার জট কমানো যথেষ্ট কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। এমনকি প্রতিনিয়ত মামলার সংখ্যা বাড়ার সম্ভাবনাই বেশি। জাস্টিস নিরীক্ষার সমীক্ষা অনুসারে, বাংলাদেশে ৯ শতাংশ মানুষ আদালতের মাধ্যমে, ৪ শতাংশ মানুষ পুলিশের মাধ্যমে এবং ৮৭ শতাংশ মানুষ স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং গণ্যমান্য ব্যক্তির মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তিতে আগ্রহী। বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে প্রাচীনকাল থেকেই এখানে সালিশ বা গোত্রীয় মাধ্যমে সমাজের সমস্যাগুলো সমাধান করা হতো। এমনকি সুলতানি-মুঘল এবং পরবর্তী ব্রিটিশ উপনিবেশিক আমলেও স্থানীয় সালিশ ব্যবস্থার মাধ্যমেই বেশির ভাগ বিরোধের মীমাংসা করা হতো। সুতরাং এটি স্পষ্ট যে বাংলা অঞ্চলে বিরোধ নিষ্পত্তিতে সালিশের মাধ্যমেই সমাধানে মানুষের আগ্রহ বেশি ছিল। বিকল্প ব্যবস্থায় বিরোধ নিষ্পত্তি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এবং সময়োপযোগী ব্যবস্থা।

বিকল্প ব্যবস্থায় বিরোধ মীমাংসার জন্য বর্তমান বাংলাদেশের শহর ও গ্রামাঞ্চলে ভিন্ন ব্যবস্থা বিদ্যমান। গ্রাম আদালত আইন ২০০৬-এর মাধ্যমে ইউনিয়ন পরিষদে গ্রাম আদালত প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এ আদালত মূলত ইউনিয়ন চেয়ারম্যান, মেম্বার এবং মামলার পক্ষদ্বয়ের মাধ্যমে মনোনীত সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত হয়। পক্ষান্তরে পৌর এলাকায় বিরোধ মীমাংসা (পৌর এলাকা) বোর্ড আইন, ২০০৪-এ পৌরসভার চেয়ারম্যান, কমিশনারসহ অন্যদের নিয়ে ‘বিরোধ মীমাংসা বোর্ড’ গঠনের কথা বলা হয়েছে। মামলার আর্থিক এখতিয়ার সময়োপযোগী করার জন্য গ্রাম আদালত আইনটিতে বেশ কয়েকবার সংশোধনী আনা হয়েছে। যেমন গ্রাম আদালতের আর্থিক এখতিয়ার ৭৫ হাজার থেকে ৩ লাখ টাকা করা হচ্ছে এবং বিরোধ পরিচালনা ও নিষ্পত্তির জন্য গ্রাম আদালত বিধিমালা-২০১৬ প্রণয়ন করা হয়েছে। এসব ব্যবস্থা না থাকলে ইউনিয়ন পর্যায় থেকে আদালতে মামলা-মোকাদ্দমা দায়েরের সংখ্যা আরো অনেক বাড়ত। গ্রাম আদালতকে সময়োপযোগী করা হলেও পৌর এলাকার বিরোধ মীমাংসা আইনে গত ২০ বছরে তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আসেনি। যদিও গ্রামের তুলনায় পৌর এলাকায় বিরোধের সংখ্যা সংগত কারণেই বেশি। 

কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণেই পৌর এলাকায় বিরোধ নিষ্পত্তির যথাযথ এবং সময়ানুপযোগী বিকল্প ব্যবস্থা থাকা খুবই প্রয়োজন। প্রথমত, বাংলাদেশে দ্রুত নগরায়ণের ফলে পৌর এলাকার আয়তন বাড়ছে। এখানকার সম্পত্তির মূল্য যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে তেমনি জীবন যাত্রার মানোন্নয়ন ঘটছে প্রতিনিয়ত। 

দ্বিতীয়ত, বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ পৌর এলাকায় বাস করলেও অদূরভবিষ্যতে এ সংখ্যা দ্রুত বাড়বে। সার্বিক পরিস্থিতির আলোকে এটি স্পষ্ট যে পৌর এলাকায় বিরোধ বাড়ছে এবং মীমাংসার ক্ষেত্রে ২০ বছর আগের নির্ধারিত আর্থিক এখতিয়ার পক্ষান্তরে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বিরোধ মীমাংসা (পৌর এলাকা) বোর্ড আইন ২০০৪-এর দুটো তফসিলেই বিরোধসংশ্লিষ্ট সম্পত্তির আর্থিক মূল্য সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা করা হয়েছিল। ওই সময়ের প্রেক্ষাপটে ২৫ হাজার টাকায় পৌর এলাকায় যদিও বিবাদ মীমাংসার জন্য বোর্ডে আসত, বর্তমান চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। জীবনযাত্রার মূল্য বহুগুণে বৃদ্ধির ফলে কয়েক ধরনের সমস্যা তৈরি হচ্ছে। প্রথমত, বর্তমানে প্রায় সব ধরনের বিরোধই আর্থিক বিবেচনায় ২৫ হাজার টাকার ঊর্ধ্বে। ফলে অতীতে বিরোধ মীমাংসার আবেদন যে সংখায় আসত, এখন এ সংখ্যাটা খুবই কম। দ্বিতীয়ত, মীমাংসা বোর্ড এসব বিরোধ নিষ্পত্তির চেষ্টা করলেও আইনগতভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ২০০৪ সালের আইনে নির্ধারিত আর্থিক মূল্য বৃদ্ধি ছাড়া বিরোধ মীমাংসা বোর্ড যথাযথভাবে বিবাদ নিষ্পত্তি করতে পারছে না। ফলে আইন প্রণয়নের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে। 

কাজেই আইনে সংশোধনের মাধ্যমে আর্থিক মূল্য নতুনভাবে নির্ধারণ করা সময়ের দাবি। এক্ষেত্রে দুটো গুরুত্বপূর্ণ প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন। প্রথমত, গ্রাম আদালত আইনে যেখানে আর্থিক এখতিয়ার ৩ লাখ টাকা করা হয়েছে, সেখানে পৌর এলাকায় আর্থিক এখতিয়ার কয়েক গুণ বেশি হওয়া সমীচীন। খুব সাধারণভাবে দেখতে গেলে এটা স্পষ্ট যে গ্রামের তুলনায় পৌর এলাকার জমির মূল্য অন্তত পাঁচ-সাত গুণ বেশি। দ্বিতীয়ত, আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে শুধু বর্তমান প্রেক্ষাপট নয়, বরং ভবিষ্যতের প্রয়োজনীয় অবস্থার পরিবর্তন বিবেচনায় আনতে হবে। যেহেতু আইনের পরিবর্তন বা সংশোধন সময়সাপেক্ষ, কাজেই আর্থিক মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে অন্তত আগামী ২০ বছরের আর্থিক মূল্য বিবেচনায় আনা যুক্তিসংগত হবে। ২০০৪ সালের আইন সংশোধনের বিষয়টি যেহেতু ২০২৪-এ অর্থাৎ ২০ বছর পর আলোচনায় আসছে, তাই পরবর্তী ২০ বছর বিবেচনায় আনা যুক্তিযুক্ত হবে। এতে দুই ধরনের সুবিধা পাওয়া যাবে। এক. কার্যকর হওয়ার পর আইনটি বাস্তবতার নিরিখে প্রাসঙ্গিক হিসেবে অন্তত বেশকিছু বছর পৌর এলাকার মানুষকে বিরোধ মীমাংসায় সুবিধা দেবে। দ্বিতীয়ত, বিকল্প ব্যবস্থায় অধিক বিরোধ মীমাংসা করার মাধ্যমে একদিকে যেমন আদালতের ওপর নতুনভাবে মামলা দায়েরের সংখ্যা কমে আসবে, অন্যদিকে দ্রুত নগরায়ণের ফলে সৃষ্ট বিবাদগুলোর দ্রুত সমাধানে অত্র বোর্ড কার্যকরী ভূমিকা পালন করবে। মাদারীপুর আইন সহায়তা সংস্থা (এমএলএএ) বিরোধ মীমাংসা (পৌর এলাকা) বোর্ড আইন, ২০০৪-এর সংশোধনের জন্য বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ প্রণয়ন করেছে যেগুলো বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, আর্থিক মূল্য বৃদ্ধি করে ১০ লাখ টাকা নির্ধারণ করা। যেখানে বাংলাদেশ ২০৪১ সালে উন্নত দেশ হিসেবে নিজেকে এগিয়ে নিতে প্রস্তুতি নিচ্ছে, সেখানে ভবিষ্যৎ বিবেচনায় আর্থিক মূল্য নির্ধারণ করা প্রয়োজন। আরেকটি প্রস্তাব হচ্ছে, আইন সংশোধনের পাশাপাশি গ্রাম আদালত আইনের অধীনে যেমন বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে, এ বিরোধ মীমাংসা (পৌর এলাকা) বোর্ড আইন, ২০০৪-এর অধীনেও বিধিমালা প্রণয়ন করা। আর্থিক মূল্য বৃদ্ধির পাশাপাশি বিরোধ মীমাংসার জন্য নির্ধারিত অফিসের ব্যবস্থা করা। যাতে প্রয়োজনীয় জনশক্তি এবং অন্যান্য সুবিধা থাকবে। একই সঙ্গে মেয়র, কমিশনার এবং আরো যারা বোর্ডের সদস্য হবেন, তাদের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, যাতে করে বিকল্প বিরোধ ব্যবস্থা বিচার বিভাগের সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হয় এবং জনগণ যেন বিচারিক প্রক্রিয়া অনুভব করতে পারে।

আমেরিকান রিয়ালিস্ট স্কুলের অন্যতম প্রবক্তা জাস্টিস অলিভার ওয়েনডেল হোমস আইনে লজিকের বা যুক্তির চেয়ে অভিজ্ঞতাকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচনা করেছেন। বিরোধ মীমাংসা (পৌর এলাকা) বোর্ড আইন ২০০৪-এর গত ২০ বছরের অভিজ্ঞতাকে গুরুত্ব দিয়ে প্রয়োজনীয় সংশোধনীর মাধ্যমে আগামী দিনে পৌর এলাকার জনগণের জীবনযাত্রাকে সহজ করতে পারলেই আইনটি প্রণয়নের প্রকৃত লক্ষ্য-উদ্দেশ্য অর্জন হবে। এক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে কার্যকরি ভূমিকা নিতে হবে। 

মো. মোস্তফা হুছাইন: সহকারী অধ্যাপক, ল স্কুল, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন