অভিমত

গবেষণা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল লক্ষ্য অর্জন হয় না

ড. মো. গোলাম ছারোয়ার

ছবি : বণিক বার্তা

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কল্যাণে পৃথিবী গ্লোবাল ভিলেজে পরিণত হয়েছে। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি গ্লোবাল পরিমণ্ডলের একটি অংশ। সবার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে আমাদেরও একই গতিতে চলতে হবে। ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালাম বাংলাদেশে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভোকেশন বক্তৃতায় বলেছিলেন দেশের আভিজাত্যের বহিঃপ্রকাশ বোঝা যায় সেই দেশের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে প্রত্যেক বছর কতগুলো গুণগতমানসম্পন্ন গবেষণাপত্র প্রকাশ হয়। বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কর্তৃক পরিচালিত জরিপে দেখা যায়, র‍্যাংকিংয়ের দিক থেকে এক হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নেই। এই র‌্যাংকিংয়ের একটি বড় ক্রাইটেরিয়া হলো গবেষণা ও গুণগত মানের গবেষণাপত্র প্রকাশ। 

বিশ্ববিদ্যালয় তথা উচ্চ শিক্ষার আধুনিক গবেষণার কনসেপ্ট আমাদের দেশে প্রবর্তন হয় ব্রিটিশ শাসনামলে। এ উপমহাদেশে প্রথম ১৮৫৭ সালে ২৪ জানুযারি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়। তারও ৬৪ বছর পর ১৯২১ সালে আমাদের দেশে প্রতিষ্ঠিত হয় প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের গোড়াপত্তন ব্রিটিশদের হাতেই। আর পাকিস্তান শাসন আমলের ২৩ বছরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়—রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৫৩), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৬১), চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৬৬) এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৭০)। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ২০২৪ সাল পর্যন্ত মোট পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫৮। অথাৎ ব্রিটিশের সময় একটি এবং পাকিস্তানের সময় পাঁচটি মোট ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয় বাদ দিলে স্বাধীনতার ৫৪ বছরে ৫২টি সরকারি ও ১১৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এখন এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গুণগত মান বিবেচনায় ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সময় খুবই প্রণিধানযোগ্য। এত দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের মান কি বাড়ছে না কমছে তা আমাদের সবারই জানা। 

সময়ের ব্যবধানে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা গাণিতিক থেকে জ্যামিতিক হারে বাড়লেও গুণগত মানে কি পরিবর্তন হয়েছে—তা সবারই জানা। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য হলো গবেষণা ও গবেষণালব্ধ ফলাফল দেশের মানুষের কল্যাণে কাজে লাগানো। দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীরাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ভর্তি হবেন এবং মুক্ত জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে সমাজ ও মানবজাতির উন্নয়ন প্রগতিশীল সব দিকনির্দেশনা প্রদান করবেন। দেশে এখন বিভিন্ন ক্যাটাগরির বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। জেনারেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, সিভিল এভিয়েশন বিশ্ববিদ্যালয়, মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তবে এখনো পাবলিক হেলথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে বিষয়টি উল্লেখ আছে। আশা করছি, অচিরেই তা বাস্তবায়ন হবে। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংখ্যিক বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে গুণগত বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে না পারলে জাতি হিসেবে বিশ্বদরবারে মাথা হেট হতে বাধ্য। যখন এমআইটি বা কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় উঁচুমাথায় বলবে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণার জন্য কতগুলো নোবেল অর্জন করেছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতও একইভাবে গর্বভরে যখন বলবে আমাদের গবেষণায় বিশ্বের প্রগতিতে এ ভূমিকা রেখেছে। 

বাংলাদেশে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভূত গবেষণার ফলাফলে আমরা অনেকগুলো সূচকে বিশ্বদরবারে স্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছি। জাতিসংঘ আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে সেরেস উপাধিতে ভূষিত করেছেন। আমরাও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছি। মাছ, মাংস, ডিম, দুধ উৎপাদনেও বিশ্বের তালিকায় আমরা শীর্ষের দিকে অবস্থান করছি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় জ্ঞান আর মেধা চর্চার জায়গা যদি অন্যকিছুতে রূপান্তরিত হয়, তবে তা হবে জাতি হিসেবে বড়ই দুর্ভাগ্যের। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম বিদ্যাপিঠ বাংলাদেশের কৃষিশিক্ষার আঁতুড়ঘর বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করার। আমার মনে পড়ে, আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র তখন জাপানের হোক্কাইডো বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে আমাদের ক্যাম্পাসে এসেছিলেন। তার লেকচারে তিনি বলেছিলেন প্রফেসরের উৎপত্তি হয়েছে প্রোফেট থেকে। কথাগুলো মনের মধ্যে গেঁথে গিয়েছিল। বুঝেছিলাম একজন প্রফেসর কখনই মিথ্যা বলতে পারেন না। কখনই অমূলক কোনো কাজ করতে পারেন না। কোনো হয়রানি তো অনেক দূরের কথা একজন প্রফেসরের প্রতিটি অঙ্গভঙ্গিই অনুকরণীয়, অনুসরণীয়। একজন ঐশীবাণী বাহক যেমন কখনই তার অনুসারীর কোনো অনিষ্ট ভাবতেও পারেন না। তার শুধুই চিন্তা ও আরাধ্য হলো অনুসারীর সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল কামনা। চারিত্রিক উত্তম বৈশিষ্ট্য দিয়েই আকৃষ্ট হবে তার অনুসারী। একইভাবে একজন অধ্যাপক তার ছাত্র/ছাত্রীর চালচলন, বিনয়, ভদ্রতা, নম্রতা, বাস্তবতা, মানবিকতা, সততা, ন্যায়পরায়ণতা, নৈতিকতা, মানবতা, শেখানোর পুরোধা। তার ব্যবহার ও কার্যক্রম দিয়ে ছাত্রছাত্রীর আইডল বা আইকনে পরিণত হবেন। জীবনে চলার পথে সঠিক দিকনির্দেশনা ও তার বাস্তবায়নের আধার যদি হয় বিশ্ববিদ্যালয় তবে তার সঠিক নির্দেশক হলেন শিক্ষক। অধ্যাপকরা যেমন জীবনদর্শন শেখাবেন, দর্শনের বাস্তবতা কতটা সহজ, কতটা কঠিন তার পুরোটাই পাওয়া যাবে তার প্রতিটি কর্মে। তার গবেষণা যেমন ত্বরান্বিত করবে সমাজকে, মানুষের ভাগ্যকে ঠিক তেমনি তার উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ এবং কৃত প্রতিটি কর্ম উদ্ভাসিত করবে তার প্রতিটি ফেলোকে। এখানে কোনো অপ্রত্যাশিত নোংরা চিন্তাভাবনার কোনো স্থানই নেই। যে চিন্তার আলেখ্য ও জীবনদর্শনে একজন মহামানব তার অনুসারীকে দীক্ষা দেবেন, পথ দেখাবেন সঠিকতার। সেই জীবন দর্শনই প্রতিফলিত হবে একজন শিক্ষার্থীর জীবনে। শিক্ষার্থী নিজেকে সেই উচ্চতায় অধিষ্ঠিত করবেন। আমাদের এখানে এমনটা হয় না। মনে রাখা দরকার, সৃষ্টিকর্তা কখনই সবাইকে ঐশীবাণী প্রদান করে দায়িত্ব অর্পণ করেন না। খুবই সিলেকটেড ও পরিপূর্ণভাবে আদর্শিক চারিত্রের ব্যক্তিই বাণীবাহক হিসেবে নির্বাচিত হন। 

একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যদি আমরা চিন্তা করি, এটা একটা গুরুদায়িত্ব। মানবিক আদর্শ প্রতিষ্ঠার এক মহান কর্মযজ্ঞ। এ দায়িত্বে ব্যত্যয় ঘটলে শুধু যে প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা নয়। ক্ষতিগ্রস্ত হবে মানবতা, মানবিক আদর্শের। প্রগতিশীল গ্লোবাল ভিলেজে গুরুত্বপূর্ণ যে অবদান রাখার কথা তা তো বিলীন হবেই। খাতওয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় যদি সুনির্দিষ্ট গবেষণা জোরদার করা যায়, তাহলে আমরাও গর্ব করে বলতে পারব ওমুক ক্ষেত্রে আমরা অমুক ভূমিকার জন্য এতটা নোবেল পুরস্কার পেয়েছি। বিশ্ব উপকৃত হবে আমাদের কর্মকাণ্ডে। বিকাশিত হবে মানবতা। আমরা হয়ে উঠব সোনার মানুষ আর বাংলাদেশ হবে সোনার বাংলা। 

ড. মো. গোলাম ছারোয়ার: অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, কীটতত্ত্ব বিভাগ, জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম)

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন