শিল্পী কিংবা শিল্পের সত্য

মাহমুদুর রহমান

অমর সিং চমকিলা সিনেমার একটি দৃশ্য ছবি: হিন্দুস্তান টাইমস

মানুষের জীবন কতই না অদ্ভুত হতে পারে। একজন ব্যক্তির জীবন বদলে যায় ছোট ছোট নানা ঘটনায়। এর মধ্যে শিল্পীদের জীবন আরো অদ্ভুত। তাদের কারো প্রয়োজন ছোট একটা সুযোগ। এমন গল্প আমরা নানা সময়ই শুনে থাকি। প্রায় কাছাকাছিই একটি গল্প ‘অমর সিং চমকিলা’র। এক সাধারণ মোজা নির্মাতা থেকে সে হয়ে উঠেছিল পাঞ্জাবের সেরা গায়ক। কিন্তু সেরার সঙ্গেই লেগে থাকে নানা বিতর্ক। আর চমকিলা তার ক্যারিয়ারেই এমন কিছু কাজ করেছিলেন, যা সাধারণ সামাজিক নীতির বাইরে। কিন্তু তাতে তার জনপ্রিয়তা কমেনি। চমকিলা ছিলেন এমন এক গায়ক, যাকে স্বীকার না করলেও লোকে তার গান শুনেছে লুকিয়ে। তার মৃত্যুতে কেঁদেছে।

ইমতিয়াজ আলী পরিচালিত অমর সিং চমকিলা শুরুই হয়েছে অমর সিংয়ের মৃত্যুর দৃশ্য দিয়ে। মৃত্যু নয়, খুনই বলা চলে। তার স্ত্রী অমরজোতের কপালে গুলি লাগে। সেখানেই শুরু। কিন্তু কেন এ হত্যা? সে গল্পই আছে পুরো সিনেমায়। শুরুতেই বোঝা যায়, এ খুনের পেছনে আছে কোনো বড় শক্তি। একটা দল। এরপর ইমতিয়াজ আমাদের নিয়ে যান এ গল্পের শুরুতে। অমরের এককালের বন্ধু বলে যায় অমরের গল্প। মাতালের জবানিতে গল্প শুরু হয়, এরপর সে গল্প বলে অমরের অন্য স্যাঙাতরা। সেটা অবশ্য বলে পুলিশের সামনে। 

অমরের গল্পটা আসলে কী? আর পাঁচটা সফলতার গল্পের মতোই তার গল্প। পাঞ্জাবের এক ‘চামার’ কেমন করে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে যায়, সেখানে কেমন করে নিজের জায়গা ধরে রাখে আর শেষ পর্যন্ত মারা যায়, ইমতিয়াজ সে গল্পই বলছেন। অমর সিং গাইতে চাইত। কিন্তু গাওয়ার সুযোগ তার ছিল না নানা কারণে। এক তো সে জাতে চামার, তার ওপর নেই কোনো পরিচিতি। এরই মধ্যে নানা কসরত করে টিক্কির মনোযোগ আকর্ষণ করে। টিক্কি নানা জায়গায় গানের আসর বসায়। সে আসরেই অভিষেক অমরের। তাও সুযোগের ফলে। মূল গায়ক না আসায় সুযোগ পায় সে। এরপর তার জনপ্রিয়তা বাড়ে উত্তরোত্তর।

ইমতিয়াজ আলীর সিনেমার একটা নির্দিষ্ট টোন আছে। অন্তত ছিল, চমকিলার আগ পর্যন্ত। তার প্রধান চরিত্ররা যাপিত জীবনের ঊর্ধ্বে গিয়ে জীবনের বড় মানে খোঁজে। সে গল্প প্রেমের হোক বা শিল্পের, ইমতিয়াজের নায়করা অপার্থিব কিছুর তালাশে থাকে। ‘তামাশা’ ও ‘রকস্টার’-এ বিষয়টি স্পষ্ট, ‘লাভ আজ কাল’-এর দুই পর্বও ভিন্ন নয়। কিন্তু এবার সেখান থেকে সরে এলেন ইমতিয়াজ। তার অমর সিং অনেক বেশি কনফিডেন্ট। সে নিজে যা ঠিক মনে করে তা-ই করে। বেদের (তামাশা) মতো কনফিউডজ না অমর কিংবা জর্ডানের (রকস্টার) মতো বিশৃঙ্খলও নয়। এর বাইরে বিশেষ বিষয় হলো গল্প বলার ধরন। ইমতিয়াজ তার নিজের মতো গল্প বলার পাশাপাশি নেটফ্লিক্সের কিছু নীতি অনুসরণ করেছেন, তা নেটফ্লিক্স দেখা দর্শকরা বুঝতে পারবেন। তবে অমর ও অমরজোতের পারফরম্যান্সের অন স্ক্রিন ক্রিয়েশন বাস্তবের পাশে রেখে দেখলে মনে হবে হুবহু সে সময়কেই নতুন করে তৈরি করেছেন ইমতিয়াজ। আর বলাই বাহুল্য, অদ্ভুত সুন্দর সংগীত তৈরি করেছেন এআর রহমান। 

অভিনয়ে বলতে হয়, সিনেমাটা দিলজিতের ‘ওয়ান ম্যান শো’। পরিণীতি কেবলই একজন সাপোর্টিং অ্যাকট্রেস সেখানে। এর কারণও আছে। সিনেমাটা আসলে অমর সিংয়ের আর সেখানে দিলজিত নিজেকে অমর সিং করে তুলেছেন। অবশ্য মুখভঙ্গি ও অঙ্গভঙ্গিতে রণবীর কাপুরের সঙ্গে মিলটা অনেকের চোখে পড়তে পারে। তবে এর মধ্যে আনজুম বাত্রা, অনুরাগ অরোরা কখনো দর্শকের মনোযোগ টেনে নিয়েছেন। ভালো লাগবে মোহিত চৌহান ও কুমুদ মিশ্রর অতিথিসুলভ উপস্থিতিও।

অমর সিং চমকিলার গল্প এ মুহূর্তে অনেক প্রাসঙ্গিক। প্রথমত, সিধু মুসেওয়ালার মৃত্যু। তাদের দুজনকেই হত্যা করা হয়। হত্যা করে দুটি ভিন্ন গোষ্ঠী। কিন্তু এখানে মূল বিষয় শিল্পীর মৃত্যু। শিল্পের ওপর আক্রমণ। দ্বিতীয়ত, নিজের অন্যান্য সিনেমার মতো এখানেও ইমতিয়াজ কিছু প্রশ্ন তুলছেন। কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল, সমাজ কেন শিল্পের ওপর খবরদারি করে সে প্রশ্ন রেখেছেন ইমতিয়াজ আলী। এসব দর্শককে ভাবায়। এর বাইরে, পাঞ্জাবি গানের একটা অধ্যায়ের খবর জানতে হলে সিনেমাটা দরকারি। পাঞ্জাবের গানের নিজস্ব একটা ধারা আছে। সুফি ধারার গান যেমন সেখানে আছে, তেমনি আছে পপ ধারার গান, আছে ফোক ধারার গান। কিন্তু এর বাইরে একটা ধারা জনপ্রিয় হয়েছিল—সোজা কথায় বলা হতো অশ্লীল গান। ফুটপাতের চটি বইয়ের মতো তথাকথিত ‘আদিম রস’ নিয়ে রচিত সেসব গান। গাওয়া হতো আসরে, ডুয়েটে। বহু মানুষ সে গান শুনত। অমরও সে গানেরই শিল্পী।

প্রতিটি শিল্পেরই আছে ভোক্তা। শিল্প কোনো না কোনো সময় পণ্য আর তা তৈরি হয় ভোক্তার চাহিদা অনুসারে। অন্তত তার রূপটা দেয়া হয় ভোক্তার কথা ভেবে। কিন্তু দোষটা হয় শিল্পীর। পাঞ্জাবি গানের ওই বিশেষ ধারায় অমর সিং হয়ে উঠেছিলেন জনপ্রিয়তম। রেকর্ডসংখ্যক কপি বিক্রি হতো তার গানের ক্যাসেটের। কিন্তু তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল অশ্লীলতার। ইমতিয়াজ সে শিল্পীর সত্যটাকে তুলে ধরেছেন সিনেমার মধ্যে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন