বিদায় ফেইথ রিংগোল্ড

শাকেরা তাসনীম ইরা

দি আমেরিকান পিপল সিরিজ #২০: ডাই ছবি: ফেইথ রিংগোল্ড

নাগরিক অধিকার আন্দোলন ও নারীবাদের সঙ্গে দৃঢ় সম্পৃক্ততার জন্য সুপরিচিত চিত্রশিল্পী ফেইথ রিংগোল্ড। ১৪ এপ্রিল ৯৩ বছর বয়সে চলে গেছেন না ফেরার দেশে। 

ষাটের দশকের গোড়ার দিকে শক্তিশালী রাজনৈতিক চিত্রকর্মের জন্য খ্যাতি অর্জন করেছিলেন রিংগোল্ড। ১৯৬৭ সালে তার করা ‘দি আমেরিকান পিপল সিরিজ #২০: ডাই’ বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। সিরিজটিকে বিশ শতকের আমেরিকান শিল্প ইতিহাসের মাইলফলক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তিনি ছিলেন চিন্তা ও চেতনায় তার সময়ের সবচেয়ে অগ্রগামী শিল্পী। সামাজিক বৈষম্য, জাতিগত পক্ষপাত এবং লিঙ্গ স্টেরিওটাইপ মোকাবেলায় অক্লান্ত প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন।

ফেইথ রিংগোল্ডের জন্ম হয় নিউইয়র্ক সিটির হারলেমে, ১৯৩০ সালে। তার শৈশব কেটেছে সুগার হিল জেলায়, যেখানে হারলেম রেনেসাঁ বিকাশ লাভ করছিল। সমকালীন সুপরিচিত লেখক, সংগীতজ্ঞ ও শিল্পীর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল তার পরিবারের। ছবি আঁকার হাতেখড়ি রিংগোল্ডের হয়েছিল শৈশবেই। তবে তাকে অনন্য উচ্চতায় আসীন করে দি আমেরিকান পিপল সিরিজ। নাগরিক অধিকার আন্দোলনে তার সক্রিয় অংশগ্রহণের সময় ১৯৬৩-৬৭ সালের মধ্যবর্তী সময়ে আঁকা ২০টি চিত্রকর্ম নিয়ে তৈরি হয় ‘দি আমেরিকান পিপল’ সিরিজ। এ সিরিজের মাধ্যমেই তার কর্মজীবনে আসে গুরুত্বপূর্ণ বাঁক। 

পাবলো পিকাসোর চিত্রকর্ম গুয়ের্নিকা দ্বারা অনুপ্রাণিত; ষাটের দশকের দাঙ্গা এবং বিদ্রোহের মধ্যে আঁকা ‘ডাই’ হলো একটি দ্বি-প্যানেলের কাজ। সেখানে তিনি কালো ও সাদা পুরুষ, মহিলা ও শিশুদের একটি দল চিত্রিত করেছেন। ‘ডাই’-এর মাধ্যমে রিংগোল্ড মূলত দাঙ্গা, ঘৃণা ও সহিংসতার অবসানের জন্য তার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছেন।

ফেইথ রিংগোল্ড ষাট থেকে সত্তরের দশকে ব্ল্যাক ফেমিনিজমের একজন বিশিষ্ট কর্মী ছিলেন। ১৯৭০ সালে তিনি লুসি লিপার্ড, পপি জনসন, ব্রেন্ডা মিলার এবং পরে ন্যান্সি স্পেরোর সঙ্গে নারী শিল্পীদের অ্যাডহক কমিটি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭১ সালে রিংগোল্ড কৃষ্ণাঙ্গ নারী শিল্পীদের জন্য ‘হোয়্যার উই অ্যাট’ প্রতিষ্ঠা করেন। নিজ শহরে রিংগোল্ডের উল্লেখযোগ্য দুটি কাজ রয়েছে। এর বাইরে ১৯৭১ সালে তিনি রাইকার্স দ্বীপে ফর দ্য উইমেন’স হাউজ নামে একটি পোর্টেবল ম্যুরাল তৈরি করেন। বর্তমানে ম্যুরালটি ব্রুকলিন মিউজিয়ামে রয়েছে। এছাড়া ১৯৯৬ সালে রিংগোল্ড ম্যানহাটনের ১২৫তম স্ট্রিট সাবওয়ে স্টেশনের জন্য ‘ফ্লাইং হোম: হারলেম হিরোস অ্যান্ড হিরোইনস (ডাউনটাউন ও আপটাউন)’ শিরোনামের এক জোড়া বড় মোজাইক ম্যুরাল তৈরি করেছিলেন। দিনা ওয়াশিংটন, জোরা নিল হার্স্টন, সুগার রে রবিনসন ও জোসেফাইন বেকারের মতো বিখ্যাত কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তিত্বদের আদলে তৈরি হয়েছিল ম্যুরাল জোড়া। 

সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে আমস্টারডামের রিজকস মিউজিয়াম পরিদর্শনের সময় রিংগোল্ডের টেক্সটাইল ও কুইল্টের অন্বেষণ শুরু হয় তার তিব্বতি থাংকাস, লিনেন বা তুলার ওপর জটিল স্ক্রোল পেইন্টিং আবিষ্কারের মাধ্যমে। তাদের ফর্ম দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি তার নিজস্ব তিব্বতিশৈলী শিল্পকর্ম তৈরি করতে শুরু করেন। একই সময়ে তিনি আফ্রিকান শিল্প থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে নরম ভাস্কর্য এবং মুখোশের ওপর কাজ শুরু করেছিলেন। থাংকাস সম্পর্কে তার অন্বেষণের পর রিংগোল্ড তার মায়ের সহযোগিতায় কুইল্ট তৈরির কাজে আত্মপ্রকাশ করেন। তার মা তাকে তার পেইন্টিংগুলোকে আলাদা কাপড়ে সেলাই করতে শিখিয়েছিলেন। তার প্রথম কুইল্ট ‘হারলেমের প্রতিধ্বনি’ ১৯৮০ সালে তৈরি হয়েছিল। ১৯৯৮ সালে নিউইয়র্কের নিউ মিউজিয়ামে একক প্রদর্শনীতে রিংগোল্ড তার গল্পের কুইল্ট পেইন্টিংয়ের দুটি উল্লেখযোগ্য সিরিজ প্রদর্শন করেছিলেন—‘দ্য ফ্রেঞ্চ কালেকশন’ এবং ‘দি আমেরিকান কালেকশন’ নামে। রিংগোল্ড শুধু একজন খ্যাতিমান শিল্পীই ছিলেন না, ছিলেন একজন মনোমুগ্ধকর গল্পকারও। তিনি এক ডজনেরও বেশি শিশুতোষ গল্প লিখেছেন। তার বহুল প্রশংসিত বই ‘টার বিচ’ (১৯৯২), ‘উইম্যান অন আ ব্রিজ #১ ​​অব ৫: টার বিচ’ (১৯৮৮) শিরোনামে তার নিজের গল্পের কুইল্ট দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিল। ‘উই ফ্লু ওভার দ্য ব্রিজ: দ্য মেমোয়ার্স অব ফেইথ রিংগোল্ড’ (১৯৯৫) শিরোনামে স্মৃতিকথা লিখে গেছেন ফেইথ রিংগোল্ড। বহুমাত্রিক প্রতিভাধর এ শিল্পী কর্মমুখর জীবনে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তার প্রভাব থাকবে দীর্ঘদিন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন