কর্মে থেকেও খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় দেশের ২২ শতাংশ মানুষ

ইয়াহইয়া নকিব

ছবি: বণিক বার্তা

রাজধানীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন আল-মামুন। চাকরির বেতন দিয়ে দুজনের সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয় তাকে। তাই অফিসে যাওয়া-আসার পথে মোটরসাইকেলে ‘রাইডশেয়ার’ করেন তিনি। আরেক চাকরিজীবী মাহমুদুল হাসান (ছদ্মনাম) বেতনের টাকায় সংসার চালাতে না পেরে ঋণের জন্য ব্যাংকের দ্বারস্থ হয়েছেন। গত এক বছরে দুটি ক্রেডিট কার্ডও নিয়েছেন তিনি। এভাবে চাকরির বাইরে অন্য কাজ করে কিংবা ঋণ নিয়েও সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে মামুন ও হাসানদের। এমনকি কর্মে থেকে নিজেদের খাদ্যনিরাপত্তাও নিশ্চিত করতে পারছেন না তারা।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘‌খাদ্যনিরাপত্তা পরিসংখ্যান-২০২৩’-এ উঠে এসেছে, মামুন ও হাসানের মতো কর্মে থেকেও দেশের ২১ দশমিক ৭৭ শতাংশ মানুষ খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।

বিবিএসের পরিসংখ্যান বলছে, যারা গৃহস্থালির কাজ করেন কিংবা কর্মের সন্ধানে আছেন, খাদ্যনিরাপত্তায় তাদের চেয়েও পিছিয়ে আছেন কর্মজীবীরা। গৃহস্থালির কাজে যুক্ত ২১ দশমিক ৬৭ শতাংশ মানুষ খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। কর্মের সন্ধানে থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে এ হার ১৮ দশমিক ৫১ শতাংশ। তবে যারা কোনো কাজ করেন না, তাদের মধ্যে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার হার সবচেয়ে বেশি; ২২ দশমিক ৩৮ শতাংশ। 

বিবিএসের পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে, দেশের ২১ দশমিক ৯২ শতাংশ মানুষ খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। এদের মধ্যে গ্রামে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার হার ২৩ দশমিক ৮৯ শতাংশ। শহরে এ হার ২০ দশমিক ৫৬ শতাংশ। সবচেয়ে কম সিটি করপোরেশন এলাকায়, ১৩ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে রয়েছে ১৮ শতাংশ মানুষ। আর ২২ শতাংশ মানুষ খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। তার মানে, যারা দারিদ্র্যসীমার ওপরে আছে, তারাও উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে পড়েছে।

বিবিএসের প্রতিবেদনের তথ্যমতে, শ্রেণীভিত্তিক বিভাজনে অতিদরিদ্রদের মধ্যে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার হার ৭০ দশমিক ৩৭ শতাংশ। দরিদ্রদের মধ্যে ২২ দশমিক ৯ শতাংশ। মধ্যবিত্তদের মধ্যে এ হার ১৪ দশমিক ৮৮ শতাংশ। ধনীদের মধ্যে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভোগে ১ দশমিক ১১ শতাংশ। 

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. কাজী মো. রেজাউল করীম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌খাদ্যের জোগান থাকার পরও প্রয়োজনীয় খাদ্য গ্রহণ করতে না পারলে তাকে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা বলা হয়। এখন আগের চেয়ে মূল্যস্ফীতি অনেক বেশি। আয় করার পরও মানুষ হয়তো জিনিসের দাম বাড়ার কারণে প্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয় করতে পারছে না। ক্রয়ক্ষমতা না থাকায় মাংসের বদলে হয়তো মানুষ ডিম খাচ্ছে।’

বিভাগভিত্তিক হিসাবে বিবিএসের তথ্য বলছে, সবচেয়ে বেশি খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে রংপুরের মানুষ। বিভাগটির ২৯ দশমিক ৪২ শতাংশ মানুষ খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। এরপর আছে ময়মনসিংহ। এ বিভাগে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার হার ২৮ দশমিক ৬৫ শতাংশ। এছাড়া সিলেটের ২৭ দশমিক ৩৫ শতাংশ, রাজশাহীর ২৪ দশমিক ৪৪, বরিশালে ২৩ দশমিক ২৪, খুলনার ২০ দশমিক ৫৯ ও চট্টগ্রাম বিভাগের ১৯ দশমিক ৬৫ শতাংশ মানুষ খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। এ হার সবচেয়ে কম ঢাকা বিভাগে, ১৭ দশমিক ২৫ শতাংশ।

এ বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দেশের দারিদ্র্যসীমার নিচে রয়েছে ১৮ শতাংশ মানুষ আর ২২ শতাংশ মানুষ খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, যারা দারিদ্র্যসীমার ওপরে আছে তারাও উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে পড়ছে। স্বল্প আয়ের চাকরিজীবীদেরও ক্রয়ক্ষমতার ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। তারা সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে। এমনকি মধ্যবিত্তরা টিসিবির ট্রাকের পেছনে লাইনে দাঁড়িয়ে নিত্যপণ্য কিনতে বাধ্য হচ্ছে। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংক বলছে, ৭০ শতাংশ মানুষ পুষ্টিনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। এসব পরিসংখ্যানের মাধ্যমে দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক অস্থিরতার চিত্রটি সামনে আসছে।’

বিবিএস ২০২৩ সালের ১৫ থেকে ২৫ জুন পর্যন্ত নির্বাচিত খানায় দেশের প্রথমবারের মতো খাদ্যনিরাপত্তা জরিপ পরিচালনা করে। জরিপ পরিচালনার প্রকল্প পরিচালক মো. আব্দুল হালিম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌দেশের ২৭ হাজার ৭৬০টি খানা থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। মাঠ পর্যায়ে ৫৪১ জন কর্মকর্তা তথ্য সংগ্রহ করেন। আর মান বজায় রাখার জন্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের মাধ্যমে একটি উচ্চ পর্যায়ের বিশেষজ্ঞ প্যানেল কাজ করেছে। তথ্য সংগ্রহে বিশ্ব খাদ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী আটটি প্রশ্ন সেট তৈরি করা হয়।’ 

কর্মজীবীদের খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার বিষয়ে বিবিএসের এ যুগ্ম পরিচালক বলেন, ‘খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা মানে তাদের মধ্যে খাবার নিয়ে চিন্তা রয়েছে। হয়তো সামনের মাসে চাকরি থাকবে কিনা, সেটাও এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।’ 

সার্বিক বিষয়ে সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী ড. শামসুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দুই বছর ধরে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। গত বছর খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল প্রায় ১২ শতাংশ। সার্বিক মূল্যস্ফীতিও ছিল ঊর্ধ্বমুখী। আর খাদ্যে মানুষ ৬৫ শতাংশ পর্যন্ত ব্যয় করে থাকে। তাই মূল্যস্ফীতির কারণে এটা হতে পারে। তবে গত ১৫ বছরে বেতনও বাড়ানো হয়েছে। ফলে কর্মজীবীদের ব্যাংকে জমাও বেড়েছে। যাদের মজুরি কম, তাদের মধ্যে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা হতে পারে। তবে এত বেশি পরিমাণ মানুষের খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার তথ্য আমার কাছে অসংগতিপূর্ণ মনে হচ্ছে। এক্ষেত্রে বস্তুনিষ্ঠভাবে তথ্য সংগ্রহের বিষয়েও প্রশ্ন থেকে যায়।’


এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন