অভিমত

আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় বৈদেশিক বিনিয়োগ কমছে?

আবু তাহের খান

জাপান এক্সটার্নাল ট্রেড অর্গানাইজেশন (জেটরো) কর্তৃক বাংলাদেশে কর্মরত ২১৪টি জাপানি কোম্পানির ওপর পরিচালিত সাম্প্রতিক এক জরিপের ফলাফল থেকে জানা যায় যে ওই কোম্পানিগুলোর ৭০ দশমিক ৮০ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ৭১ শতাংশই বাংলাদেশের ব্যবসায়িক পরিবেশে অসন্তুষ্ট। বিনিয়োগের পরিমাণ, ডিভিডেন্ড, কর্মসংস্থান, পুনর্বিনিয়োগ ইত্যাদি সবকিছুর বিবেচনা থেকেই বাংলাদেশে বিনিয়োগকারী বিদেশী কোম্পানিগুলোর মধ্যে জাপান শীর্ষে। সেই শীর্ষস্থানীয় বিনিয়োগকারীদের ৭১ শতাংশই যদি বাংলাদেশের ব্যবসায়িক পরিবেশে সন্তুষ্ট না হয়ে থাকে, তাহলে তাতে খানিকটা হলেও দুশ্চিন্তার উপাদান আছে বলে মনে করার কারণ রয়েছে বৈকি! উত্তম বিনিয়োগ পরিবেশের আশ্বাস দিয়ে বিদেশীদের যখন এ দেশে বিনিয়োগের আহ্বান জানানো হয় এবং জেটরোর জরিপ যখন তার বিপরীত চিত্র তুলে ধরে, তখন সে আহ্বানের মধ্যে বিশ্বাসযোগ্যতা আর কতটাই-বা অবশিষ্ট থাকে! তবে উল্লিখিত জরিপ থেকে প্রাপ্ত ফলাফলে বাংলাদেশের কেউই যে অবাক হননি, তা প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায়। কারণ এ দেশের প্রায় সব নাগরিকই এখানকার কর্মপরিবেশ ও বিনিয়োগসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আচরণ সম্পর্কে কমবেশি অবহিত। সেক্ষেত্রে জাপানি কোম্পানিগুলোর ৭১ শতাংশের পরিবর্তে ৯১ শতাংশও যদি তাদের অসন্তুষ্টির কথা জানাত, তাহলেও তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকত না। 

এখন দেখা যাক, ৭২ শতাংশ জাপানি কোম্পানির অসন্তুষ্টির কারণ কী কী? পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের বিবরণ মতে উল্লিখিত কোম্পানিগুলোর প্রধান অভিযোগের ক্ষেত্র মূলত দুটি: এক. নিবন্ধন ও আনুষঙ্গিক আইনি অনুমোদন প্রাপ্তিতে বিলম্ব এবং দুই. আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। উল্লিখিত দুটি মিলে অভিযোগের ক্ষেত্র আসলে একটিই—প্রাতিষ্ঠানিক সেবা ও সহযোগিতা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে হয়রানি ও বিড়ম্বনার মুখোমুখি হওয়া, যার মূল নিয়ন্তা হচ্ছে আমলাতন্ত্র, ম্যাক্সওয়েভার যাকে দক্ষতার সঙ্গে রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যতম সহায়ক উপাদান হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশের মতো একাধিক মেয়াদের ঔপনিবেশিক শাসনের ভেতর দিয়ে আসা সমাজে আমলাতন্ত্র সে ভূমিকা পালনে শুধু ব্যর্থই হয়নি, বরং রাষ্ট্রকে তারা জনগণের (এক্ষেত্রে উদ্যোক্তার) প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলেছে। তারই ফল হচ্ছে, ৭১ শতাংশ জাপানি কোম্পানির কাছ থেকে শুনতে পাওয়া যে তারা বাংলাদেশের ব্যবসায়ের পরিবেশে সন্তুষ্ট নয়।

এখন কথা হচ্ছে, বাংলাদেশের আমলাতন্ত্রের আচরণ যদি এ দেশে কর্মরত জাপানি কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে সন্তোষজনক না হয়ে থাকে, তাহলে তা অন্য দেশের কোম্পানির জন্যও হওয়ার কথা নয়। তার মানে, বাংলাদেশের বিনিয়োগ পরিবেশ এখনো বিদেশী বিনিয়োগকারীদের জন্য সন্তোষজনক ও আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে পারেনি। এ অবস্থায় আমাদের নেতানেত্রী ও আমলারা যে বিশাল সব লটবহর নিয়ে বৈদেশিক বিনিয়োগ অনুসন্ধানের নাম করে দেশ-দেশান্তরে ঘুরে বেড়ান, সেটি করার আগে নিজ দেশের ব্যবসায়িক পরিবেশটিকে দেশী-বিদেশী উভয় শ্রেণীর বিনিয়োগকারীর জন্যই অনুকূল করে তোলাটা অধিক জরুরি নয় কি? একই সঙ্গে প্রশ্ন হচ্ছে, সে ধরনের বিনিয়োগ সহায়ক পরিবেশ গত ৫২ বছরেও দেশে গড়ে উঠল না কেন? তাহলে এ অর্ধশতকের ব্যবধানে কী ও কার উন্নয়ন করলাম আমরা?

এখন দেখা যাক, আমলাতান্ত্রিক যে জটিলতাগুলোর কথা জেটরো জরিপের উত্তরদাতারা উল্লেখ করেছেন বা তাদের উল্লিখিত বড় দাগের বিষয়গুলোর আওতায় যা যা পড়ে, সেগুলো কী কী? উল্লিখিত জটিলতাগুলোর মধ্যে একেবারে প্রথমেই রয়েছে শিল্প নিবন্ধন, ট্রেড লাইসেন্স, মূলধনি কোম্পানি হিসেবে অনুমোদন লাভ, পরিবেশের ছাড়পত্র গ্রহণ, আমদানি প্রাধিকার সনদ সংগ্রহকরণ ইত্যাদি, যেগুলো মূলত রাষ্ট্রীয় বিধিবদ্ধ কার্যক্রম। বিনিয়োগের দ্বিতীয় পর্যায়ের বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে অবকাঠামোসংশ্লিষ্ট সেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলোর কাছ থেকে বরাদ্দ গ্রহণ, যার মধ্যে বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি, জমি ইত্যাদির মতো অপরিহার্য সেবাগুলো অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। পরবর্তী স্তরে রয়েছে আমদানি-রফতানির জন্য বন্দর ব্যবহারের মতো সেবা গ্রহণ, যেটি আসলে সরাসরি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের অংশ। অন্যদিকে মধ্যবর্তী পর্যায়ের অন্যান্য সেবার মধ্যে রয়েছে মান সনদ গ্রহণ, ট্রেডমার্ক ও স্বত্ব নিবন্ধন, কর ও শুল্ক পরিশোধ ইত্যাদি। আর চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের জন্য লভ্যাংশ প্রত্যর্পণ।

সব মিলিয়ে বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদের জন্য প্রতিপালনীয় এই যে নানা বিষয়, এর প্রায় প্রতিটি অংশের সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে আমলাতন্ত্রের সরাসরি সংশ্লিষ্টতা। অপ্রিয় হলেও সত্য যে এসব সংশ্লিষ্টতার প্রায় প্রতিটি স্তরেই রয়েছে সীমাহীন দুর্নীতি, অনিয়ম ও হয়রানির ভয়ংকর প্রচণ্ডতা। এ ভয়ংকরতাই হচ্ছে জেটরো জরিপের আওতাধীন জাপানি কোম্পানিগুলোর ভাষায় আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। 

এখন প্রশ্ন, এ আমলাতান্ত্রিক জটিলতা হ্রাস না পেয়ে দিন দিন কেবলই বাড়ছে কেন? এটিকে নিয়ন্ত্রণ করা বা নিদেনপক্ষে কমিয়ে আনার কি কোনোই উপায় নেই? উল্লিখিত জটিলতা হ্রাস না পেয়ে উল্টো বেড়ে যাওয়ার প্রধান কারণ এই যে রাষ্ট্র এটিকে ইচ্ছা করেই হ্রাস করতে চায় না। বরং চায় যে সংশ্লিষ্ট আমলা যেন আরো বেশি করে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে, যাতে এরূপ সুবিধাভোগ ও দুর্বলতার কারণে তারা ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতায় টিকে থাকতে সহযোগিতা করে। বেতন-ভাতা ও আর্থিক সুবিধাদি বাড়লে আমলারা আর দুর্নীতি করবে না—এরূপ আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েই ২০১৫ সালে সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা এক লাফে দ্বিগুণেরও বেশি বাড়িয়ে দেয়া হলো। কিন্তু তাতে দুর্নীতি তো কমলই না, বরং তা আরো বেড়ে গেল। কারণ ওই বৃদ্ধির নেপথ্য কারণ আসলে দুর্নীতি হ্রাস ছিল না, ছিল সুবিধাভোগী শ্রেণীর সুবিধার ভাগকে আরো স্ফীত করে তাদের আনুগত্য নিজেদের পক্ষে নিশ্চিত করা। এরূপ একটি আবহের মধ্যে শুধু জাপানি কেন, সব বিনিয়োগকারীর অসন্তোষই যে বাড়বে, তাতে সন্দেহ পোষণের কোনোই অবকাশ নেই।

এদিকে দ্বিতীয় যে প্রশ্নটি, অর্থাৎ আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতি ও জটিলতাকে নিয়ন্ত্রণ বা কমিয়ে আনার কোনো উপায় আছে কিনা তার জবাবে বলব, উপায় অবশ্যই আছে, তবে সেটি বিদ্যমান রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সম্ভব নয় এবং সেটি না হওয়া পর্যন্ত বিনিয়োগ পরিবেশের যে কোনো উন্নতি ঘটবে না, তা তো বোঝাই যাচ্ছে। এ অবস্থায় বিনিয়োগকারীদের সব ধরনের দুর্নীতি ও জটিলতাকে মোকাবেলা করেই ব্যবসা করে যেতে হবে এবং সেই মানসিক প্রস্তুতি তাদের আছে বলেও মনে হয়, যা জেটরোর জরিপ থেকেও বেরিয়ে এসেছে। এরূপ দুর্নীতি ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা থাকা সত্ত্বেও জাপানি উদ্যোক্তাদের প্রায় ৭২ শতাংশ বাংলাদেশে ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে চায়। কারণ এখানে মুনাফার হার বেশি। আর দেশে দেশে এটা তো প্রমাণিত ঘটনা যে দুর্নীতি যেখানে যত বেশি, সেখানকার মুনাফার হারও তত উচ্চতর। অতএব, সে রকম একটি দুর্নীতি ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতাসংবলিত বিনিয়োগ পরিবেশের মধ্যে থেকেই যে বিদেশী কোম্পানিগুলোকে আরো কিছুকাল এ দেশে কাজ করে যেতে হবে, জেটরো জরিপের তথ্য অন্তত তা-ই বলছে। কিন্তু প্রায় ৫২ বছর পেরিয়ে আসা একটি রাষ্ট্রের জন্য সেটি কি মর্যাদাকর?

আবু তাহের খান: ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে কর্মরত;

সাবেক পরিচালক, বিসিক, শিল্প মন্ত্রণালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন