উচ্চ মূল্যস্ফীতি

চলমান সংকট সাধারণ মানুষের ওপর চাপ আরো বাড়াবে

ছবি : বণিক বার্তা

উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে দেশের সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ। দুই বছর ধরেই দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিদ্যমান। সরকারের নানা পদক্ষেপেও মূল্যস্ফীতি কমেনি। ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য চাল, ডাল, পেঁয়াজ, রসুন, শাকসবজি ও মাছ-মাংসের দাম নিম্ন ও সীমিত আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। কোটা সংস্কার আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ ও কারফিউ দিয়ে সরকার তা নিয়ন্ত্রণে আনার উদ্যোগ নেয়। ফলে সারা দেশের সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে পড়ে। ভেঙে পড়ে সরবরাহ ব্যবস্থাও। দেশের শিল্প খাতসহ বিভিন্ন খাতের উৎপাদন কার্যক্রমও বন্ধ হয়ে পড়ে। এ পরিস্থিতিতে জিনিসপত্রের দাম বাড়তে শুরু করে। এতে বিপাকে পড়ে খেটে খাওয়া মানুষ। এছাড়া ইন্টারনেট সেবা বন্ধ থাকায় ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) কার্ডধারী সদস্যরাও ভর্তুকি মূল্যে নিত্যপণ্য পাচ্ছেন না। গত বুধবার থেকে রাজধানীর সঙ্গে পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা সচল হতে শুরু করেছে। কিন্তু গত কয়েক দিন উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে পড়ায় নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়ে যেতে থাকে। অর্থাৎ দেশের চলমান পরিস্থিতি মূল্যস্ফীতিকে আরো বাড়িয়ে দেবে। এর প্রভাব পড়বে দেশের সাধারণ মানুষের ওপর। এজন্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বার্ষিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশে দাঁড়ায়, যা ২০১১-১২ অর্থবছরের পর সর্বোচ্চ। সরকার ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশে রাখার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। অবশ্য অর্থবছর শুরুর মাসে অর্থাৎ জুলাইয়ে তা কিছুটা কমে ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশে দাঁড়ায়, জুনে ছিল ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ। গ্রাম ও শহরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের ওপরেই ছিল। 

বাংলাদেশ ব্যাংক বিলম্বে উদ্যোগ নেয়ার কারণে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। বর্তমান সংকটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন মুদ্রানীতি কীভাবে কাজ করবে তা এ মুহূর্তে বলা কঠিন। কেননা এর আগে দুই বছরেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতি তেমনভাবে কার্যকর হয়নি। বর্তমানে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো তাতে সরবরাহ ব্যবস্থা মারাত্মক বিঘ্নিত হয়েছে। নতুন করে সৃষ্ট রাজনৈতিক সংকট অর্থনৈতিক ঝুঁকি আরো বাড়িয়ে দেবে বলে শঙ্কা রয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের যে লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে তা কীভাবে পূরণ হবে বলা মুশকিল। সংকট পুরোপুরি কেটে গেলে তা বোঝা যাবে। নতুন করে অর্থনীতিতে যে ঝুঁকি সৃষ্টি হলো, তা কিন্তু মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে দেবে। এক্ষেত্রে সরকারের আরো সতর্ক হওয়া দরকার। 

বাংলাদেশ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে প্রতিবেশী শ্রীলংকা, নেপাল ও ভারতের উদাহরণ কাজে লাগাতে পারে। শ্রীলংকা এত খারাপ অবস্থানে থাকার পরও সেখানে বাজারে সিন্ডিকেট না থাকায় অবস্থার দ্রুত উন্নতি ঘটেছে। অর্থাৎ সুশাসন নিশ্চিত হওয়ায় এ ধরনের সমস্যা কমে এসেছে। 

দক্ষিণ এশিয়ার দ্রুত অগ্রসরমাণ দেশ শ্রীলংকা নজিরবিহীন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট মোকাবেলা করছে। দেশটি সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার হয় ২০২২ সালে। দ্বীপরাষ্ট্রটির মূল্যস্ফীতি ঠেকে প্রায় ৬০ শতাংশে। রিজার্ভ সংকটে বন্ধ হয়ে যায় জ্বালানি তেলের মতো অতিপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি। আমদানি দায় আর বিদেশী ঋণ পরিশোধের ব্যর্থতায় নিজেদের দেউলিয়াও ঘোষণা করে শ্রীলংকা সরকার। কিন্তু ইতিহাসের সবচেয়ে নাজুক সে পরিস্থিতি দ্রুতই কাটিয়ে উঠছে শ্রীলংকা। মূল্যস্ফীতির হার কমতে কমতে গত জুনে নেমে আসে ১ দশমিক ৭ শতাংশে। দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, মে মাসে এ হার ছিল ১ শতাংশের নিচে। প্রতিবেশী দেশ ভারতের মূল্যস্ফীতিও দুই বছরের মধ্যে সর্বনিম্নে নেমেছে। ভারতের পরিসংখ্যান মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, মে মাসে দেশটির মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ। নেপালেও গত ৩১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থানে রয়েছে মূল্যস্ফীতি। দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, মে মাসে নেপালের মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৪ দশমিক ৪ শতাংশ। এক বছর আগে এ হার ছিল ৭ দশমিক ৪১ শতাংশ। 

মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে বাংলাদেশ বরাবরই ব্যর্থ হচ্ছে। এর পেছনে অর্থনৈতিক কারণ ছাড়াও নানা বিষয়ের প্রভাব রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে অর্থ পাচার এবং বাজার সিন্ডিকেট দমনে ব্যর্থতা। এছাড়া দেশে ডলার ও রিজার্ভ সংকট থাকলেও সরকার নিজস্ব ব্যয় কমাতে পারেনি। উল্টো টাকা ছাপানোর মতো পদক্ষেপের কারণে বাজারে অর্থ সরবরাহ বাড়ায় মুদ্রাস্ফীতিজনিত মূল্যস্ফীতি ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। 

চলমান সংকট মোকাবেলা করে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণই সরকারের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। জিনিসপত্রের দাম বাড়লে কিংবা উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাব সাধারণ মানুষের ওপর সরাসরি পড়ে। কেননা ব্যয় বাড়লেও আয় বাড়ে না। ফলে সীমিত আয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়। তাই বাড়তি দাম নিয়ে সাধারণ মানুষ অস্বস্তিতে রয়েছে। মানুষের আয় বৃদ্ধির দিকে সরকারকে মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। স্থবির সরবরাহ শৃঙ্খল ঠিক করে দ্রুততম সময়ে স্বাভাবিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিবেশ তৈরি করতে হবে। 

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে জনজীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে সরকারের দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া দরকার। নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের যে সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে, তা ভাঙতে তৎপরতা প্রয়োজন। এটি না করে শুধু অভিযান পরিচালনা করে ব্যবসায়ীদের জরিমানা করলে কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যাবে না। এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ীর তৎপরতা আমরা দীর্ঘদিন ধরেই লক্ষ করছি। এদের সিন্ডিকেট দমন না করে দাম নির্ধারণ করলে যে কোনো সুফল পাওয়া যায় না, নিকট অতীতেও সেটি ফুটে উঠেছে। তাই এখন বাজার নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। এজন্য যথাযথ প্রক্রিয়ায় ব্যবস্থা নিতে হবে। বাজারে খাদ্যদ্রব্যের সরবরাহ বাড়ানোর পাশাপাশি প্রয়োজনে আমদানিকারকের সংখ্যা আরো বাড়াতে হবে। বাজারে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ সৃষ্টিতে সরকারের পদক্ষেপ জরুরি। এছাড়া নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের জন্য টিসিবি আরো সক্ষম করে গড়ে তোলা দরকার। দেশে বাজার তদারকির যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে তাদের সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন